সিলেটটুডে ডেস্ক

১৮ এপ্রিল, ২০২১ ১৮:০৩

মিডিয়াকে দুষলেন আব্বাস, বিব্রতকর প্রশ্ন না করার অনুরোধ

ইলিয়াস আলী নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য

আমার সহজ-সরল উক্তিগুলোকে বিকৃত করে যারা যেভাবে পেরেছে লিখেছে বলে দাবি করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। তিনি বলেন, আমার আংশিক বক্তব্য দেওয়া হয়েছে।

নয় বছর আগে বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী গুম ইস্যুতে বিধ্বংসী বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় আসার একদিন পর সংবাদ সম্মেলেনে একে উল্টে গেলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস।

গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে বক্তব্য বিকৃতি, যার যেটা প্রয়োজন, সেই অংশটুকু ব্যবহার করে মনের মাধুরি মিশিয়ে লেখার অভিযোগ আনার পর প্রশ্নোত্তর পর্বে এসে বিএনপি নেতা একেক সময় একেক কথা বলতে থাকেন।

একবার তিনি বলেন, ইলিয়াস আলীকে সরকার গুম করেনি-এমন কথা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হয়ে তিনি বলতে পারেন না।

এটি রেকর্ডে সাংবাদিকরা এই কথা বললে পরক্ষণেই বলেন, তিনি কটাক্ষ করে বলেছেন।

গণমাধ্যমকর্মীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা মাস্টার্স- এটি ‍উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, এটা তার বক্তব্যের ভেতরে আরোপিত ছিল, সেটা বুঝে নেয়া উচিত ছিল।

অন্তর্ধানের আগের রাতে বিএনপি কার্যাালয়ের নিচে একজনের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল বলে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, সেই প্রসঙ্গ তুললেও প্রথমে তিনি বলেন, এ কথা বলেননি। পরে বলেন, ঝগড়া হতেই পারে, এটা কোনো ধর্তব্যের বিষয় না।

এ রকম আরও নানা ধরনের দ্বিমুখী বক্তব্য দেয়া মির্জা আব্বাস এমনও অভিযোগ করেছেন যে, গণমাধ্যম তাকে টার্গেট করেছে। কেন করেছে, সেটা তিনি বুঝতে পারছেন না।

ইলিয়াস আলীর অন্তর্ধানের নয় বছর পূর্তিতে ১৭ এপ্রিল একটি অনলাইন আলোচনায় মির্জা আব্বাস বলেন,

‘বাংলাদেশের স্বাধীন-সার্বভৌমত্ব যে ভূলুণ্ঠিত হতে যাচ্ছে এটার জ্বলন্ত প্রমাণ হলো ইলিয়াস আলীর গুম। আমি জানি, বাংলাদেশ সরকার বা আওয়ামী লীগ সরকার ইলিয়াসকে গুম করে নাই। কিন্তু গুমটা করল কে? এই সরকারের কাছে আমি এটা জানতে চাই।’

এ নিয়ে বিএনপিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া হলে রোববার সংবাদ সম্মেলনে আসেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য।

বিজ্ঞাপন



‘বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে, টুইস্ট করা হয়েছে’

বিভিন্ন গণমাধ্যমের শিরোনাম তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘ইলিয়াস আলীর গুমের জন্য সরকার নয় বিএনপি দায়ী-এ কথা কি আমি বলেছি? আমার কোনো রেকর্ডে আছে কি? কেউ প্রমাণ করতে পারবে? অসম্ভব। সম্ভব নয়। কথা বিকৃত করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘সরকার বা আওয়ামী লীগ ইলিয়াসকে গুম করে নাই- এ কথাও আমি বলি নাই। আমার কথাকে বিকৃত করে প্যাঁচিয়ে লেখা হয়েছে, টুইস্ট করা হয়েছে।’

‘এই কথাটা কি আমি… বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য হয়ে আমার পক্ষে বলা সম্ভব? অর্থাৎ নিজের মাথার মধ্যে বন্দুক ধরা। এটা সম্ভব না, এটাকেও টুইস্ট করা হয়েছে।

অন্য একটি পত্রিকার শিরোনাম তুলে ধরে আব্বাস বলেন, ‘আমি কী নতুন তথ্য দিলাম আমার জানা নাই। বিকৃত নিউজ।’

পরে তিনি বলেন, ‘আমি একটা কথা পরিষ্কার বলতে চাই, আমার সহজ সরল মনের সরল উক্তিগুলোকে বিকৃত করে আমাদের যে সকল সাংবাদিক ভাইদের যা যেখানে প্রয়োজন, আমার সম্পূর্ণ বক্তব্যের, বিরাট বক্তব্য যদি বলি, তার একটা লাইন কোট করেছে। বিরাট বক্তব্য দেয়া হয়নি।

‘যার যেখানে প্রয়োজন, কেটে ছিড়ে পোস্ট মর্টেম করে কাটপিস করে ইচ্ছামতো লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। কী কারণে করা হয়েছে তাও আমি জানি না।’

‘ইলিয়াসের স্ত্রীর বাসায় সাংবাদিক কেন?’

গণমাধ্যমকর্মীরা ইলিয়াস আলীর স্ত্রীর বাসায় যাওয়ায়ও নাখোশ হয়েছেন মির্জা আব্বাস। বলেন, ‘আজকের সকালে ইলিয়াস আলীর বাসায় গেছে একদল সাংবাদিক। তাকে গিয়ে রীতিমতো চার্জ করেছে।

২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল নিখোঁজ হন বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী। এই ঘটনার জন্য সরকারকে দায়ী করলেও শনিবার মির্জা আব্বাস বলেন, গুমে সরকার দায়ী নয়

‘কী এমন ঘটনা ঘটল যে হঠাৎ করে এই বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে? গত নয়টি বছর ইলিয়াস গুম হওয়ার পরে কোনো পত্রপত্রিকা একটি দিবস পালন করে নাই ইলিয়াসের জন্য। এই একজন ইলিয়াস আলীর জন্য আজকে কেন সাংবাদিকদের মাথা খারাপ হয়ে গেল? আমি বুঝি না।‘

‘আমি কোনো সাংবাদিককে দোষারোপ করছি না’- এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘দয়া করে সত্য বক্তব্যটা যদি তুলে ধরতেন, বোধহয় ভালো হতো।’

পরক্ষণেই মির্জা আব্বাস বলেন, ‘আমি এমন কোনো কথা বলি নাই যার জন্য জাতির কাছে, দেশের কাছে, বিএনপির কাছে কিংবা আমার নেতা কর্মীর কাছে আমাকে বিব্রত হতে হবে। আমার বক্তব্য যারা পড়েছেন, তারা হয়ত বুঝে উঠতে পারেননি। আমি দুঃখিত আমি হয়ত বোঝাতে পারিনি।

‘আমি গতকালের বক্তব্য নিয়ে আবার বলছি। আমার বক্তব্যের কাটপিছকে তুলে ধরে সামনের অংশ পেছনের অংশ বাদ দিয়ে মাঝ থেকে যার যতটা প্রয়োজন নিয়ে মনের মাধুরি মিশিয়ে নিজের মতো করে লিখেছেন। এর সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নাই। এর জন্য আমার দল বা আমি কোনো দায় দায়িত্ব বহন করি না। যারা বলছেন, যারা লিখেছেন, তার জন্য তারাই দায়িত্ব বহন করবেন।’

এই সংবাদ সম্মেলনের পর বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে বলেও আশা করেন আব্বাস। বলেন, ‘আমি আমার বক্তব্যে যেটা বুঝাতে চেয়েছিলাম, আমি আশা করি আজকে সেটা বোঝাতে পেরেছি।

‘দয়া করে আপনারা আর কোনো পত্রপত্রিকায় টুইস্ট করে কেউ নিউজ করবেন না। আমি বুঝলাম না হঠাৎ আমাকে টার্গেট করার প্রয়োজন কেন হলো এই সরকারের কিংবা আমার সাংবাদিক ভাইদের। এত লোক থাকতে আমাকে টার্গেট করা কেন?’

‘ইলিয়াসকে উপলক্ষ করে আমাকে টার্গেট করা-এই লক্ষণটা কিন্তু ভালো না। এটাকে একটা অশুভ লক্ষণ বলে মনে করি’-বলেন মির্জা আব্বাস।

বিব্রতকর প্রশ্ন না করার অনুরোধ

সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই ‘বিব্রতকর’ প্রশ্ন না করারও অনুরোধ করেন মির্জা আব্বাস।

বলেন, ‘রোজার মাস। জানেন তো সাধারণত বিকেল বেলা শরীরে পানির ঘাটতি থাকে, পানির ঘাটতি থাকলে মাথায়ও পানির ঘাটতি থাকে। মেজাজও খারাপ থাকে। রোজা রেখে আমি সংক্ষেপে শেষ করব। আপনাদের কাছে তাই অনুরোধ করব আপনারা কেউ বিব্রতকর কোনো প্রশ্ন করবেন না।‘

প্রশ্নোত্তর পর্বে একেক সময় একেক কথা

একজন গণমাধ্যমকর্মী বলেন, ‘আপনি বলেছিলেন, একজনের সঙ্গে ইলিয়াস আলীর ঝগড়া হয়েছে। সে কেই ব্যক্তি, তার নামটা কি বলা যায়?

এরপর অনেক কথা বলেলেও এই প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট জবাব দেননি বিএনপি নেতা।

বলেন, ‘আমি বলছি, ইলিয়াস আলীর সাথে তো আমার ডেইলি ঝগড়া হতো। আমার সঙ্গে, এই প্রশ্নটা আপনারা করবেন আমি জানি। তাই আমি প্রস্তুত আছি।

বিজ্ঞাপন



‘ইলিয়াস আলী এমন মেজাজের লোক ছিল, এখানে রতন আছে না? এই যে রতন, ইলিয়াস ও রতন মানিকজোড় ছিল এক সময়। ইলিয়াস ও খোকন, আমাদের খায়রুল কবির খোকন, এই যে এখানে আছে খায়রুল কবির, খোকন, মিলন- এদেরকে সামাল দিতে, ইলিয়াসকে সামাল দিতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে আমাকে একটা সময়।

‘৯০ এর আন্দোলনের আগে-পরে, এদেরকে নিয়ে মামলা মোকদ্দমা, জেল জুলুম, কোর্ট কাচারি করতে করতে আমি আর আমার ওয়াইফ পাগল হয়ে যেতাম একটা সময়।’

পরক্ষণে আব্বাস বলেন, ‘একটা দলে কার সঙ্গে কার খোঁচাখুঁচি, ঝগড়াঝাটি আছে-এটা নিয়ে এত যদি মাথা ঘামানোর তো সময় নাই।’

এ নিয়ে আরও একজন গণমাধ্যমকর্মী প্রশ্ন করতে চাইলে আব্বাস বলেন, ‘এটা নিয়ে আর কোনো প্রশ্নের উত্তর দেব না।’

আরেকজন গণমাধ্যমকর্মী মির্জা আব্বাসের শনিবারের একটি উক্তি তুলে ধরে বলেন, ‘আপনার বক্তব্যটাই, ইলিয়াস যেদিন গুম হয়ে যায়, আমি খবর পেলাম সে টিটাগাং আছে। তার আগের দিন রাতে অফিসের কোনায় একজনের সাথে ঝগড়া…’

প্রশ্ন শেষ করতে না দিয়ে আব্বাস বলেন, ‘না, না, এ কথা আমি বলি নাই।’

‘আমি আপনার কথাটাই কোট করছি’-বলেন সেই গণমাধ্যমকর্মী।

পরক্ষণে আব্বাস বলেন, ‘নো, নো, নো, অফিসের কোণায় কারও সাথে ঝগড়া হয়েছে (বলেছি)?’

এরপর প্রশ্নের মুখে বিএনপি নেতা বলেন, ‘ওই দিন অফিসে কত লোকের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে, মনোমালিন্য হয়েছে, ভিন্নমত হয়েছে সেটা তো হতেই পারে। কার সঙ্গে কার হয়েছে সেটা বলা তো ডিফিকাল্ট।’

আরেকজন সংবাদকর্মী বলেন, ‘আপনি বলেছেন, মহাসচিবের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, এদের বিরুদ্ধে…’

এবারও প্রশ্ন শেষ করতে না দিয়ে আব্বাস বলেন, ‘আমি বলেছি, আমার দলের মধ্যে যদি কেউ থাকে যারা নাকি শয়তান, এদেরকে দলের একটু বাছাই করা দরকার।’

‘আপনি বলেছেন, আমি জানি যে এই সরকার গুম করে নাই। এই বক্তব্যে আপনি এখন অটল আছেন কি না’- জানতে চান আরও এক সংবাদকর্মী।

আব্বাস বলেন, ‘না না, আমার মনে হয় আমার সাংবাদিক ভাইয়েরা কেউ বোধ হয় মাস্টার্সের নিচে কেউ না, পলিটিক্যাল সায়েন্স অথবা কিছু একটা করা আছে।

‘আমি একজন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, আমি কেন বলব এ কথা যে আমি জানি যে সরকার জড়িত নয়?

অনরেকর্ড আছে-বলেন সেই সংবাদ কর্মী।

আব্বাস বলেন, ‘অন রেকর্ডই আছে। প্লিজ প্লিজ, লেট মি রিপ্লাই।’

এরপর কথা ঘুরিয়ে বিএনপি নেতা বলেন, ‘অন রেকর্ডই আছে। আমি জানি, সরকার গুম করে নাই, মিনস কটাক্ষ করে বলেছি। তাহলে সরকারই বলুক ইলিয়াস আলী কোথায় আছে। তাহলে সরকারকেই জবাব দিতে হবে।

বিজ্ঞাপন



‘একটা সরকারের সময় জলজ্যান্ত একজন ইলিয়াস, তরতাজা একজন ইলিয়াস সত্যভাষী একজন ইলিয়াস গুম হয়ে গেল। সরকার জানে না বুঝলাম। তাহলে কে করল গুম তাকে, আমি এ কথা বলতে চেয়েছিলাম।’

তিনি বলেন, ‘আমি বলতে চাচ্ছি যে আপনারা এত জিনিস নিয়ে এত উত্তেজিত, যদি আমার কথা বুঝতে না পেরে থাকেন… আমি স্ট্যান্ডিং কমিটির লোক হয়ে বলব সরকার করে নাই? তাহলে কে করল? আমি করেছি? না আপনারা করেছেন?

‘আপনারা কি বের করতে পেরেছেন? আপনারা কি পেরেছেন, সাগর রুনি হত্যাকাণ্ডের কূলকিনারা করতে পেরেছেন? পারেননি। তাহলে করল কে? কারা করেছে?’

আব্বাস বলেন, ‘ইলিয়াস আলী গুম না শুধু, ইলিয়াস গুম হয়েছে সালাউদ্দিনকে পাচার করা হয়েছে, চৌধুরী আলমকে গুম করা হয়েছে, এ রকম হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে গুম করা হয়েছে। কে করল? হাওয়া হয়ে গেল?’

আপনি কটাক্ষ করে বলেছেন সেই কথা? এটা তাহলে আজ স্পষ্ট হলাম- বলেন এক সংবাদকর্মী।

আব্বাস বলেন, ‘এটা বোঝা উচিত ছিল। এটা ইমপ্লাইড।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত