
২৪ মে, ২০২৪ ১০:৩৪
স্বর্ণ চোরাচালান ও সীমান্তকেন্দ্রীক চোরাচালানের নিয়ন্ত্রণই কাল হয়েছে ভারতের কলকাতায় হত্যার শিকার হওয়া ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের। তাকে খুনের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি শুরু হয় অন্তত তিন মাস আগে থেকে। খুনি চক্র অপেক্ষায় ছিল কবে ভারত যাবেন তিনি।
এ ঘটনার তদন্তে নেমে বাংলাদেশ ও কলকাতার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন তথ্য পেয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে দুই দেশের তদন্তকারীদের মধ্যে তথ্য বিনিময় হচ্ছে বলে জানা গেছে। এর ভিত্তিতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ইতিমধ্যে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে; যারা ঘটনার পর ভারত থেকে দেশে ফিরেছিলেন। ঢাকায় ডিবির সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার তিনজন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করছেন যে তারা সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারকে হত্যায় সরাসরি জড়িত।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, স্বর্ণ চোরাচালানের আন্তর্দেশীয় চক্রের দ্বন্দ্বের জেরে পরিকল্পিতভাবে আনোয়ারুলকে ভারতে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এর মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে মো. আক্তারুজ্জামান ওরফে শাহিন নামের এক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। কলকাতার নিউ টাউনে যে ফ্ল্যাটে সংসদ সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে, সেটি এই আক্তারুজ্জামানের ভাড়া করা। তিনি ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়র মো. সহিদুজ্জামানের ছোট ভাই। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, তিনি গত সোমবার ঢাকা থেকে একটি ফ্লাইটে দিল্লি হয়ে কাঠমান্ডু চলে গেছেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে আভাস মিলেছে, চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছে স্বর্ণ চোরাচালানের ২০০ কোটি টাকা নিয়ে দ্বন্দ্ব। এ ছাড়া সীমান্তকেন্দ্রিক চোরাচালানের রুট নিয়ন্ত্রণও খুনের আরেক কারণ হিসেবে কাজ করেছে। খুনের মাস্টারমাইন্ড নিহত এমপি আনারের ব্যবসায়িক পার্টনার আক্তারুজ্জামান শাহিনকে গ্রেপ্তার করা গেলে এ বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাবে বলে বলছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র ও ঝিনাইদহে সীমান্ত এলাকার খোঁজ রাখেন- এমন সূত্র বলছে, নিহত এমপি আনার ও তাকে খুনে অভিযুক্ত মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহিন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাদের এই বন্ধুত্ব এবং দুজন মিলে সীমান্ত এলাকার কারবার নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি প্রকাশ্যই ছিল। তবে সীমান্ত এলাকার চোরাকারবারের পথঘাট নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কয়েক মাস ধরে এই বন্ধুত্বে ফাটল ধরেছিল বলেও আন্দাজ করতে পেরেছিলেন তাদের এলাকার লোকজন।
কেন বন্ধুত্বে ফাটল ধরেছিল দুজনের, সে প্রশ্নের জবাবে ঢাকা মহানগর পুলিশের তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এখন পর্যন্ত তথ্য রয়েছে, শাহিন দুবাই থেকে স্বর্ণের চালান পাঠাতেন দেশে। সেই চালান সীমান্ত পার করার বিষয়টি দেখভাল করতেন এমপি আনার। এ জন্য তিনি নিতেন মোটা কমিশন। এই কমিশন বাড়ানো নিয়ে বছরখানেক ধরে তাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল।
ডিবি সূত্রের দাবি, কমিশন না বাড়ায় বন্ধু শাহিনের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এমপি আনার। এর জেরে দুবাই থেকে আসা স্বর্ণের একাধিক চালান তিনি গায়েব করেন। যার মূল্য অন্তত ২০০ কোটি টাকা। এর জেরেই দুজনের দূরত্ব বাড়ে। শাহিন অন্য মাধ্যমে স্বর্ণ পাচারের চেষ্টা করলেও তাতে বাধা হন এমপি আনার। এর জের ধরেই তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা হয়। যার নিষ্ঠুর বাস্তবায়ন হয় কলকাতায় ভাড়া করা ফ্ল্যাটে।
এ ছাড়া আনোয়ারুল ভারতে গিয়ে যে বন্ধুর বাসায় উঠেছিলেন, সেই গোপাল বিশ্বাসও স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র থেকে জানা গেছে। আবার, সংসদ সদস্য আনোয়ারুলে আজিম আনারের বিরুদ্ধেও চোরাচালানসহ অন্তত ২১টি মামলা ছিল। যদিও পরে সেসব মামলা থেকে তিনি খালাস বা অব্যাহতি পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে ২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক পুলিশি সংস্থা ইন্টারপোল রেড নোটিসও জারি করেছিল। অবশ্য আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে সেটা তুলে নেওয়া হয়।
গতকাল বৃহস্পতিবার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, আমাদের কাছে এখন গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, সব অপরাধীকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা। কী কারণে হত্যা, সেটা পরে দেখব।
তিনি বলেন, আমরা তদন্তের স্বার্থে অনেক কিছু বলছি না। তবে আমরা যাকে ধরেছি, তিনি পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ছিলেন। শাহিনের কথিত গার্লফ্রেন্ড শিলাস্তি রহমানও আমাদের কাছে রয়েছে। এই নারীকে দিয়ে হানি ট্র্যাপ করা হয়েছে, নাকি টাকার কোনো ঘটনা ছিল বা রাজনৈতিক কিছু ছিল কি না অথবা খুলনার দুর্বৃত্তদের দমন করতে গিয়ে কিছু হয়েছে কি না, সবকিছু নিয়ে আমাদের তদন্ত চলছে।
ডিবি পুলিশ জানায়, দেশেই খুনের চেষ্টা করা হয়েছিল এমপি আনারকে। তবে ধরা পড়ার ভয়ে সেই পরিকল্পনা পরিবর্তন করে খুনের মাস্টারমাইন্ডরা। তাকে খুনের পরিকল্পনা হয় রাজধানীর গুলশান-২-এর ৬৫ নম্বর রোডের ১৭ নম্বর বাড়ির ২বি১ ফ্ল্যাটে। এরপর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এ ব্লকের ৩২ নম্বর সড়কের ১৯২৯ নম্বর বাসায়। দফায় দফায় হত্যা পরিকল্পনায় ব্যবহৃত ওই দুটি বাসার মালিক খুনের মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহিন। এমপিকে ঢাকায় খুন করা হলে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে কলকাতাকে বেছে নেওয়া হয়।
সূত্র বলছে, এমপি আনারকে হত্যার অন্তত তিন মাস আগে থেকেই পরিকল্পনা চলছিল। খুনের স্পট নিয়ে পরিকল্পনায় পরিবর্তন এলে তিনি কবে ভারতে যাবেন, সেই অপেক্ষা করতে থাকে খুনিরা। এজন্য দুই মাস ধরে তার গতিবিধি ও কর্মসূচি নজরদারি করা হয়। আনার মে মাসে কলকাতা যাবেন, তা নিশ্চিত হয়ে মাস্টারমাইন্ড শাহীন ৩০ এপ্রিল মূল কিলার নিয়ে কলকাতা যান। এর আগেই কলকাতার নিউটাউন এলাকায় ফ্ল্যাট ভাড়া করা হয়। সেখানেই ১৩ মে হত্যা করা হয় আনোয়ারুল আজিম আনারকে।
কলকাতার পুলিশের একটি সূত্র জানায়, নিউ টাউনের ওই ফ্ল্যাট (ট্রিপলেক্স) নাজিয়া বানু নামের এক নারীর কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছিলেন মো. আক্তারুজ্জামান শাহিন। নাজিয়ার স্বামী সন্দ্বীপ রায় ওই ফ্ল্যাটের প্রকৃত মালিক। তিনি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের আবগারি দপ্তরের কর্মকর্তা। গত ২৫ এপ্রিল ফ্ল্যাট ভাড়ার চুক্তিপত্র সইয়ের পর ৩০ এপ্রিল আক্তারুজ্জামানকে ফ্ল্যাটটি বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এ তথ্য নাজিয়া কলকাতার নিউ টাউন থানা পুলিশকে দিয়েছে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আমানুল্লাহ নামধারী ব্যক্তি জানিয়েছেন, তাকে এই খুনের জন্য ভাড়া করে আক্তারুজ্জামান। পরে আমানুল্লাহ ভাড়া করেন মোস্তাফিজুর রহমান ফকির ও ভানভীর ভূঁইয়াকে। এই দুজনের বাড়ি খুলনার ফুলতলায়। এই ঘটনায় জিহাদ ও সিয়াম নামের আরও দুজনের নাম এসেছে। যারা সবার আগেই কলকাতার ওই ফ্ল্যাটে ওঠেন। এরপর ৩০ এপ্রিল আমানুল্লাহ ও শিলাস্তি নামের এক নারীকে নিয়ে সেখানে যান আক্তারুজ্জামান। ঘটনার ছক কষে আক্তারুজ্জামান ১০ মে বাংলাদেশে চলে আসেন। অন্যরা ফ্ল্যাটে থেকে যান।
খুনের পর ১৫ মে শিলাস্তি ও আমানুল্লাহ আকাশপথে ঢাকায় চলে আসেন। ১৭ মে ঢাকায় আসেন মোস্তাফিজুর, পরদিন ফেরেন তানভীর। জিহাদ ও সিয়ামের অবস্থান এখনো শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ।
আপনার মন্তব্য