সিলেটটুডে ডেস্ক

২৫ মার্চ, ২০১৬ ০১:৩১

বাঙালিকে নিঃশেষ করে দেওয়ার ভয়াল 'কালরাত' আজ

বাঙালিকে নিঃশেষ করে দেবার ভয়াল কালরাত আজ। সেই ভয়ার্ত রাতের ২৫ মার্চের ৪৫তম বার্ষিকী।

১৯৭১ সালের এই দিনে বাঙালি জাতির জীবনে এক বিভীষিকাময় রাত নেমে আসে। মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের পূর্বপরিকল্পিত অপারেশন সার্চলাইটের নীলনকশা অনুযায়ী আন্দোলনরত বাঙালিদের কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার ঘৃণ্য লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সে রাতে ৭০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেপ্তার হলো আরও ৩০০০ লোক। ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। সমস্ত পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চলল মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করল ঘরবাড়ি, দোকানপাট লুট। আর ধ্বংসসাধন তাদের নেশায় পরিণত হলো যেন। রাস্তায়-রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শিয়ালের খাবারে পরিণত হলো। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠল শকুনতাড়িত শ্মশানভূমি।’

কাপুরুষোচিত এই গণহত্যার স্বীকারোক্তি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সংকট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তানি সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয় : ‘১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।’

আগুনের লেলিহান শিখা, বারুদের ঝাঁঝালো গন্ধ, আর অসহায় নারী-পুরুষ-শিশুর গগনবিদারী আর্তচিৎকারে গুমোট হয়ে ওঠে ঢাকার আকাশ।

এর আগে আলোচনা ভেঙে বাঙালি নিধনের নির্দেশ দিয়ে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। ২৫ মার্চ বিকাল ৫টায় বিশেষ বিমানযোগে তিনি ঢাকা ত্যাগ করে করাচির পথে পাড়ি জমান। যাওয়ার আগে ঢাকায় জড়ো করা ৬ ডিভিশন সৈন্যকে বাঙালিদের চিরতরে শায়েস্তা করার নির্দেশ দিয়ে যান।

করাচি পৌঁছে পশ্চিম পাকিস্তানের সাংবাদিকদের ইয়াহিয়া খান বলেন, ‘আল্লাহ পাকিস্তানকে রক্ষা করেছেন।’ ইয়াহিয়ার ঢাকা ত্যাগের সময় একই বিমানে পাকিস্তানে চলে যান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মোনেম খান ও মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনসহ কয়েকজন তাঁবেদার।

তার পরপরই টিক্কা খানের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৫ মার্চের রাতে ঢাকাসহ পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে শুরু হয় পাকিস্তান সামরিক জান্তার বর্বর হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলা। কালের পরিক্রমায় দিনটি আবার হাজির হয়েছে বাঙালির সামনে। আজ বাঙালির আত্মোপলব্ধির দিন। দিনটি আজ বাঙালিকে স্মরণ করিয়ে দেবে মানব-ইতিহাসের সেই জঘন্যতম গণহত্যার ভয়াল ও শোকাবহ স্মৃতি। বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসে দিনটি ‘কালরাত’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।

বর্বর পাকিস্তানি সেনারা বাঙালি গণহত্যার এ অভিযানের নাম দিয়েছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট।’ এ অপারেশনে অংশ নেওয়া ঘাতকরা সেদিন প্রথমে একযোগে সশস্ত্র হামলা চালিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল হল, জগন্নাথ হল, রোকেয়া হল এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রাবাসে। অল্প সময়ের মধ্যে হত্যা করেছিল ৩ শতাধিক ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষককে। পথের দুপাশে ছিল বস্তিবাসী। হানাদাররা জ্বালিয়ে দিয়েছিল অনেক বস্তি। হত্যা করেছিল অনেক বস্তিবাসীকেও।

একই সময়ে ঘাতকদের অন্য দুটি দল হামলা চালিয়েছিল রাজারবাগ পুলিশ সদর দপ্তর এবং পিলখানা ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল) সদর দপ্তরে। দুটি স্থানেই পুলিশ ও ইপিআর সদস্যরা সামান্য অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করে। ট্যাংক-কামান-মেশিনগানে সজ্জিত পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে পুলিশ-ইপিআরের এ প্রতিরোধ খুব বেশি কার্যকর হয়নি। বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে শহীদ হন অনেকে। নিজের প্রাণ বিলিয়ে দিয়ে তারা রেখে যান আগামীর পথনির্দেশনা।

পাকিস্তানের হায়েনারূপী নরপশুদের এ ভয়ঙ্কর গণহত্যার সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সারা শহরে। আর ২৫ মার্চের কালরাতেই ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরের কিছু সময় পর পাকিস্তানি হায়েনাদের হাতে গ্রেপ্তার হন বাঙালির প্রিয় নেতা ও মুক্তির দূত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু তার আগেই তিনি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি বর্বররা ভেবেছিল ঢাকায় অগণন মানুষ হত্যা করে, শহর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে এবং শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করে বাঙালিকে দমিয়ে ফেলা যাবে। থামিয়ে দেওয়া যাবে আন্দোলন।

কিন্তু তাদের আকস্মিক হামলার বিহ্বলতা এবং হত্যার শোক কাটিয়ে দ্রুত ঘুরে দাঁড়ায় বাঙালি। এ যেন ছিল ধ্বংসস্তূপ থেকে নবসৃষ্টির উন্মাদনায় জেগে ওঠা এক নতুন অলৌকিক শক্তির অভ্যুদয়। শুরু হয় সশস্ত্র সংগ্রাম। ৯ মাসের সংগ্রামে আসে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।

৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর ২ লাখ মা-বোনের পবিত্র সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয় লাল-সবুজের পতাকা, স্বাধীন বাংলাদেশ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত