সিলেটটুডে ডেস্ক

২৬ মার্চ, ২০১৬ ০১:৫০

তনু হত্যা: ক্ষোভে-প্রতিবাদে উত্তাল দেশ

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুকে পাশবিক নির্যাতন ও হত্যার প্রতিবাদ এবং জড়িতদের গ্রেপ্তার ও ফাঁসির দাবিতে ফুঁসে উঠছে দেশ। রাজধানীর শাহবাগসহ বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ সামাবেশ করছেন শিক্ষার্থী, নাট্যকর্মী, চলচ্চিত্রকর্মী, কবি-সাহিত্যিক, মানবাধিকারকর্মী, বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। ফেসবুক, টুইটার ও ব্লগের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও উঠেছে প্রতিবাদের ঝড়।

রবিবার রাতে তনু হত্যাকাণ্ডের পর সোমবারই প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে কুমিল্লার মানুষ। এরপর রাজধানীসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে তনু হত্যার প্রতিবাদ। চার দিন ধরে নানা কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতিবাদ চলছে। সড়ক অবরোধ, মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল, স্মারকলিপি ইত্যাদি কর্মসূচির মাধ্যমে নিজেদের ক্ষোভ ও প্রতিবাদের কথা জানানো হচ্ছে।

শুক্রবার ছুটির দিনে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেছে কয়েকটি সংগঠন। সেখানে তনু হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানানো হয়। এছাড়া শাহবাগে বিক্ষোভ করেছে গণজাগরণ মঞ্চ। রোববার কুমিল্লা অভুমূখে পদযাত্রা কর্মসূচীও ঘোষণা করেছে গণজাগরণ মঞ্চ।

বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের দাবিতে জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন কুমিল্লার সাংস্কৃতিক কর্মীরা। নগরের কান্দিরপাড় এলাকায় বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ কয়েক হাজার মানুষ।

রাজধানীতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ৬৮টি মানবাধিকার সংস্থার জোট সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি মানববন্ধন করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ, সিলেট, মৌলভীবাজার, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনার সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মীরা অবিলম্বে তনুর হত্যাকারীদের বিচার দাবি করে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছেন।

এদিকে, ঘটনার পর তনুর বাবা ইয়ার হোসেন কুমিল্লার কোতোয়ালি মডেল থানায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের নামে একটি হত্যা মামলা করেন। ঘটনার চার দিন অতিবাহিত হলেও এখনো এর কারণ বের করতে পারেনি পুলিশ।

আন্দোলন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে। এ বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না হলেও তনুর মতো পরিণতি আরও অনেককে বহন করতে হবে।

আন্দোলনকারীদের একজন দেবযানী বলেন, “একের পর এক নারী ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হচ্ছে, আন্দোলন হচ্ছে অথচ বিচার হচ্ছে না। আমরা যাব কোথায়? এই হত্যার প্রকাশ্য শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন জানান, “কোনো ছল নয়। অবিলম্বে হত্যার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও মিডিয়াকে আরো সোচ্চার হওয়ার বিকল্প নেই।”

বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক আনিসুল হক বলেন, “আজকে যে তরুণেরা প্রতিবাদী হয়ে নেমেছেন রাজপথে, যে তরুণেরা সর্বস্ব পণ করে আন্দোলনের আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে, তাঁদের বলি, এই নৃশংস অপরাধের ন্যায়বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার এই আন্দোলন বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত চালিয়ে যান।”

তনু হত্যার প্রতিবাদে সবাইকে প্রতিবাদী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন টেলিভিশন টকশোর সঞ্চালক ও সাংবাদিক অজয় রায়। তার ব্যক্তিগত ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেন, “তনুর ধর্ষণ ও হত্যার বিষয়ে নীরব থাকছেন যারা, তারা মনে রাখবেন-তাদের কন্যা অথবা বোন ধর্ষণের শিকার হলে সমাজটা এই রকমই নীরব থাকবে। তবে আজ যারা প্রতিবাদ করেছেন- সেদিনও তারা আপনাদের নীরবতার কথা মনে না রেখে আবারো প্রতিবাদী হবে। এটুকু মনে রাখবেন আপনাদের প্রতিবাদহীনতা সমাজের অপরাধীদের সাহসী করে তুলছে- আপনার পরিবার-পরিজনও কিন্তু নিরাপদ নয়।”

তনু হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের পেসার তাসকিন আহমেদও।  নিজের এই দুঃসময়েও বুধবার সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে নিজের অফিসিয়াল ফেসবুক ফ্যান পেজে ‘তনু হত্যার বিচার চাই’লেখা সংবলিত একটি ছবি আপলোড করেন তাসকিন। ছবির ক্যাপশনে তিনি লিখেন, ‘ইট’স ফিল রিয়েলি স্যাড’।

তনুর হত্যার বিচারে দাবিতে বুধবার দুপুরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। ঢাকার শাহবাগেও তনু হত্যার প্রতিবাদে এবং বিচারের দাবিতে প্রতিবাদ সমাবেশ ও মশাল মিছিল করেছে গণজাগরণ মঞ্চ।
এদিকে একই দাবিতে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে।

তনু হত্যাকাণ্ড ও এর প্রতিবাদে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া আন্দোলন সম্পর্কে জানতে চাইলে নারী ও মানবাধিকারকর্মী এবং বেসরকারি সংগঠন ‘নিজেরা করি’র নির্বাহী পরিচালক খুশী কবির বলেন, “কেউই সন্দেহ বা বিতর্কের ঊর্ধ্বে না। তনু হত্যাকাণ্ডটি যেহেতু একটা সংরক্ষিত এলাকার মধ্যে ঘটেছে তাই এই ঘটনার দায় ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড এড়াতে পারে না।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, “সমাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে বারবার আমাদের দেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এ সমাজিক অবক্ষয় দূর করতে সমাজের সব পর্যায়ের‌ মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।”

এ সমাজবিজ্ঞানী আরও বলেন, “এ ঘটনার চার দিন অতিবাহিত হয়ে গেলেও অপরাধীদের এখনো আটক করা সম্ভব হয়নি। বিলম্বিত বিচারব্যবস্থার কারণেও এটা ঘটছে।”

সেনা কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে অধ্যাপক সাদেকা হালিম সেনানিবাসের মতো সংরক্ষিত এলাকায় এ ধরনের ঘটনার জন্য সংশ্লিষ্ট সেনানিবাসের পক্ষ থেকে তদন্ত করার আহ্বান জানান।

এদিকে তনু হত্যার তদন্ত সম্পর্কে জানতে চাইলে কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) সামসুজ্জামান বলেন, মামলার তদন্ত চলছে। তবে গণমাধ্যমকে জানানোর মতো অগ্রগতি এখনো হয়নি।


কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপার মো. শাহ আবিদ হোসেন বলেন, “আমরা সেনানিবাসের ভেতরে হত্যাকাণ্ডের স্থান পরিদর্শন করেছি। আলামত সংগ্রহ করেছি। হত্যা মামলার রহস্য উন্মোচনে পুলিশ তৎপরতা চালাচ্ছে। তদন্তের স্বার্থে এখন অনেক কিছু বলা যাচ্ছে না।”

আপনার মন্তব্য

আলোচিত