সিলেটটুডে ডেস্ক

৩১ আগস্ট, ২০১৬ ০১:১৮

সিলেটে এফএম মেথডে ভর্তি হয়ে হিজবুত তাহরীরে সম্পৃক্ত হয় শামীম

প্রকাশক দীপন হত্যায় জড়িত থাকার স্বীকারোক্তি

প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা সাথে জড়িত থাকার ব্যাপারে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত ওরফে নাসির ওরফে ইমরান। জবানবন্দিতে সে হত্যার দায় স্বীকার করে।

 গত ২৩ আগস্ট শামীমকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেফতারের পর তাকে ৬ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (বর্তমানে আনসার আল ইসলাম) এই সদস্য গত রবিবার ঢাকার  মহানগর হাকিম আহসান হাবীবের আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।  

মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত ওরফে নাসির ওরফে ইমরান তার দেওয়া জবানবন্দিতে দীপন হত্যাকাণ্ডের পুরো পরিকল্পনা, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সাংগঠনিক কার্যক্রম, প্রশিক্ষণসহ বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছে। একই সঙ্গে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া সহযোগিদের নাম সহ আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষক ও মূল হোতা সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যূত মেজর জিয়ার নামও বলেছে।

আদালত সূত্র জানায়, মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত ওরফে নাসির ওরফে ইমরান তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছে,  ‘আমার নাম মইনুল হাসান শামীম। আমি নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম -এর সক্রিয় সদস্য। আমার সাংগঠনিক নাম সিফাত ওরফে নাসির ওরফে ইমরান। বিগত ২০১০ সালে আমি ইংরেজি শেখার জন্য সিলেট এফ এম মেথড নামক কোচিং সেন্টারে ভর্তি হই। সেখানে রাফি ওরফে অমি নামে হিজবুত তাহরীরের এক সদস্যের সাথে আমার পরিচয় হয়। তার অনুপ্রেরণায় আমি ২০১০ সালে হিযবুত তাহরীরের সদস্য হই। সেই থেকেই অমি ওরফে রাফির সাথে আমার কথাবার্তা ও যোগাযোগ চলতে থাকে।

২০১৪ সালের সিলেট শহরের মদন মোহন ডিগ্রি কলেজের ২য় বর্ষে পড়ার সময় রাফি ওরফে অমি আমাকে জেহাদের কথা বলে। আমি তার কথামতে জেহাদে যেতে রাজি হই। তখন রাফি ওরফে অমি আমাকে বলে, ‘তোমাকে একজনার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো, যে তোমাকে জেহাদে যাবার ব্যবস্থা করে দেবে’। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সিলেট শহরের চৌহাট্টা মোড় থেকে একটু ভেতরে একটি মেসে রাফি ওরফে অমি আমাকে একজন লোকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। লোকটির নাম আমাকে বলে না। বড় ভাই সম্বোধন করতে বলে।

আনসার আল ইসলাম সংগঠনে যোগদানের পর আমি জানতে পারি যে, ওই বড় ভাইয়ের নাম সাগর। তবে সাগর বড় ভাইয়ের  সাংগঠনিক নাম। বড় ভাই আমার নাম ঠিকানা নেয় এবং ‘প্রটেক্টেড টেক্সট’ এ একটা আইডি বলে দেয়।  ‘প্রটেক্টেড টেক্সট’ যার পাসওয়ার্ড ছিল ফরেস্ট। বড় ভাই আমাকে রাফি ওরফে অমি এর সাথে যোগাযোগ করতে নিষেধ করে  এবং ‘ গ্রিন’ এর মাধ্যমে বড় ভাই এর সাথে যোগাযোগ করতে বলে এবং নিয়মিত মেইল চেক করতে বলে।

২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে বড় ভাই  ‘প্রটেক্টেড টেক্সট’ এ মেসেজের মাধ্যমে আমাকে ঢাকা এয়ারপোর্ট ওভার ব্রিজের নিচে আসতে বলে। বড় ভাইয়ের নির্দেশ মতো আমি ওভার ব্রিজের নিচে আসি। সেখানে সেলিম ওরফে হাদী নামের একজন আমাকে রিসিভ করে। সেলিম ওরফে হাদী নামটি তার সাংগঠনিক নাম। সে আমাকে আশকোনার একটি মেসে নিয়ে যায়। সেই মেসে আমি প্রথমে সিয়াম, তাহরিক, মারুফ ও জামানদের দেখতে পাই। এবং তাদের সাথে পরিচিত হই।

সেখানে সেলিম ওরফে হাদী আমাদের ব্যায়াম করাতো এবং কোরআন ও হাদীসের বই পড়াতো, জিহাদের বই পড়াতো। এই মেসে অনুমান আড়াই মাস অবস্থানের পর সেলিম ওরফে হাদী আমাদের রেইড ও অ্যাম্বুস সম্পর্কে শেখায়। এরপর সাকিব ওরফে শরিফুল (সাংগঠনিক নাম) আমাদের পিস্তল ও চাপাতি চালানো শেখায়। পিস্তল ও চাপাতি দিয়ে কিভাবে মানুষ খুন করতে হয় তা শেখাত। এ মেসে থাকা অবস্থায় ২০১৫ সালের প্রথম দিকে আমরা সাভারে ব্লগার রিয়াদ মোর্শেদ বাবুকে হত্যা করি। এরপর আমি বাড়ি চলে যাই।

আমি অনুমান ৬/৭ মাস বাড়িতে ছিলাম। ৬/৭ মাস পর আমি ঢাকায় ফিরে এসে টঙ্গি মাস্টার পাড়ায় একটি মারকাযে (ভাড়া করা মেস) উঠি। সেখানে পূর্ব হতেই সাজ্জাদ ওরফে সিয়াম ও শরিফুল ওরফে সাকিব (সাংগঠনিক নাম) ছিল। আমরা তিনজন ওই মারাকাযে দেড়মাস ছিলাম। এরপর আমরা টঙ্গি চেড়াগ আলী সুর তরঙ্গ রোডে একটা মারকায ভাড়া করি। সেখানে আমি ও শরিফুল ওরফে সাকিব গিয়ে উঠি। সাজ্জাদ ওরফে সিয়াম চলে যায় সেলিম ভাইয়ের কাছে এবং সেলিম ভাইয়ের কাছ থেকে সুজন ওরফে আব্দুল সামাদ আমাদের কাছে আসে।

আমরা তিনজন ঐ মারকাযে দুই মাস ছিলাম। এরমধ্যে সেলিম ওরফে হাদী ভাই আমাদের বলে শাহবাগে আজিজ সুপার মার্কেটে প্রকাশক দীপন ও লালমাটিয়ার শুদ্ধস্বর প্রকাশক টুটুলকে হত্যা করতে হবে। সেই অনুযায়ী আমরা একই দিনে প্রকাশক দীপন ও প্রকাশক টুটুলকে হত্যা করার প্রস্তুতি নিতে থাকি। তখন ওই দুটি কাজের জন্য মারকায ছিল টঙ্গির বর্ণমালা রোডে। সেখানে ছিল আকাশ, আলম, রাফি, তৈয়ব, রায়হান ওরফে রফিক ও শিহাব। আমাদের কাছ থেকে সুজন ওরফে সামাদ টঙ্গির বর্ণমালা রোডের মারকাযে চলে যায়। ঐ মারকাযে প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিল সুজন ওরফে সামাদ। শরীফুল মাঝে মাঝে ঐ মারকাযে গিয়ে তদারকি করতো।

আমি দুই- তিন দিন ঐ মারকাযে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে জানতে পারি, সেলিম ভাই মারকাযে এসে প্রশিক্ষণ দিতো, তদারকি করতো এবং টার্গেট এর ছবি ও অপরাধ দেখাতো এবং হত্যা করার নির্দেশ দিতো। দীপন ও টুটুলদের হত্যার দিনের ২০ দিন আগে একদিন সেলিম ভাই আমাদের চেরাগ আলী মারকাযে আসে এবং আমাদের বলে দীপন ও টুটুল হত্যার কাজ শিঘ্রই করতে হবে। তিনি বলেন, মহাখালীতে একটা মারকায ভাড়া নেয়া থাকবে, সেখানে মামুররা (এবিটির সামরিক সদস্য) থাকবে।

মারকাযে মামুররা ঠিকমতো কাজ করছে কিনা, ব্যায়াম করছে কিনা এবং ঠিকমত ঘটনাস্থল রেকি করা হচ্ছে কিনা, এসব বিষয়ে নিয়মিত রিপোর্ট দেয়াসহ উক্ত মারকাযটি সার্বিকভাবে পরিচালনার জন্য সেলিম ভাই আমাকে নির্দেশ দেয়। এই নির্দেশের ৪/৫ দিনর পর আমি মহাখালী কাঁচা বাজারের পেছনে ৩ তলা বিল্ডিংয়ের নিচ তলার মারকাযে যাই। সেখানে গিয়ে আমি আকাশ, তৈয়ব ও আলমদের দেখতে পাই। এর ২ দিন পর জনি ও আলম ঐ মারকাযে আসে। সেলিম ভাই ও শরিফুল ওরফে সাকিব মাঝে মাঝে ঐমারকাযে আসতো।

আমরা যে সজল মারকাযে থাকতাম সেখানে বড় ভাই ওরফে সাগরও মাঝে মাঝে আসত। বড় ভাই জিহাদ বিষয়ে বিভিন্ন বয়ান দিত। একদিন কথা প্রসঙ্গে তিনি আমাদের জানান যে, জিহাদের জন্য তিনি সেনাবাহিনীর বড় পদের চাকুরি ছেড়ে দিয়েছেন। সেলিম ভাই আমাদের দীপনের ছবি, তার অপরাধ এবং আজিজ সুপার মার্কেটে ও আশপাশ এলাকার ম্যাপ দেখাত। দীপন কোন দিক দিয়ে আসবে, কোথায় গাড়ি রেখে নামবে এবং কোন পথে অফিসে যাবে, এসব ম্যাপ সেলিম ভাই আমাদের দেখাত এবং পরিকল্পনা আমাদের জানাত। কীভাবে দীপনকে হত্যা করতে হবে, সেই বিষয়ে সেলিম ভাই আমাদের নির্দেশনা দিতো।

দীপনকে হত্যা করার আগের ৭ দিনের মধ্যে আমি নিজে ২ দিন আজিজ সুপার মার্কেটে গিয়ে ঘটনাস্থল ও আশপার্শ্বের এলাকা রেকি করি। একদিন আকাশকে এবং অন্য দিন আসাদকে সাথে নিয়ে আমি ঐ এলাকায় রেকি করছিলাম। সেলিম ভাইয়ের নির্দেশ মোতাবেক আমি নিয়মিত সেলিম ভাইকে মারকাযের রিপোর্ট দিতাম। প্রকাশক দীপনকে হত্যার জন্য ৫টি চাপাতি সেলিম ভাই তৈয়বের মাধ্যমে মহাখালী মারাকাযে আমাদের নিকট পাঠায়। পিস্তল ও গুলি সেলিম ভাই নিজে মারকাযে এসে দিয়ে যায়।

গত ৩১.১০.২০১৫ ইং তারিখ আসাদ, আকাশ, আলম, তৈয়ব ও জনি প্রকাশক দীপনকে হত্যা করার জন্য আজিজ মার্কেটে যায়। যাবার পূর্বে মামুরদের অর্থাৎ এবিটির সামরিক শাখার সদস্য আসাদ, আকাশ, আলম, তৈয়ব ও জনিদের আমি প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও দিক নির্দেশনা দেই। একই দিনে টঙ্গির বর্ণমালা রোডের মারকায হতে শরিফুল ওরফে শাকিব, সুজন ওরফে আব্দুল সামাদ, শিহাব, রাফিসহ কয়েকজন লালমাটিয়ার শুদ্ধস্বর এর প্রকাশক টুটুলকে হত্যা করতে যায়। সেখানে তারা হামলায় ব্যর্থ হয়ে টুটুলসহ আরও দুজনকে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করে।

৩১.১০.২০১৫ ইং তারিখ বিকাল ৪টার সময় দীপনকে হত্যার পর মামুররা (সামরিক শাখার সদস্য) আমাকে প্রটেক্টেড টেক্সট-এ ম্যাসেজ এর মাধ্যমে জানায় যে, অভিযান সফল এবং প্রকাশক দীপনকে হত্যা করা হয়েছে। আমি সাথে সাথে সেলিম ভাইকে রিপোর্ট করি।  

২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে আমি বড় ভাই ওরফে সাগর এর নির্দেশে মোহাম্মদপুরের একটি মারকাযে বোমা তৈয়ারির প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। এরপর উত্তর বাড্ডার সাঁতারকুল এলাকার একটি মারকাযে আমি মামুরদের (এবিটির সামরিক শাখার সদস্য) প্রশিক্ষণ দিতাম। বাংলাদেশের বিভিন্ন যেসকল ব্লগার, লেখক ও প্রকাশক খুন হয়েছে তার প্রতিটি ঘটনার মূল হোতা আমাদের বড় ভাই ওরফে সাগর,যিনি মেজর জিয়া। এই মেজর জিয়া সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন বলে জেনেছি। মেজর জিয়ার অন্যতম সহযোগী হচ্ছে সেলিম ওরফে হাদী।

গত ২৩ আগস্ট সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার সময় টঙ্গির চেরাগ আলী মার্কেটের সামনে থেকে পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত