সিলেটটুডে ডেস্ক

১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ ২১:৫১

বর্বরতার পর হিংস্রতা, যেভাবে টালমাটাল টাঙ্গাইল

এক নারীর দ্বিতীয় বিয়েকে কেন্দ্র করে তার সাবেক স্বামীর জবরদস্তি, নতুন স্বামীকে মা-সহ ধরে নিয়ে বিবস্ত্র করা, ছেলের সামনে মা-কে ধর্ষণ, এরপর মামলা ঘুরিয়ে দিতে পুলিশের চেষ্টা, সব জেনে জনতার বিক্ষোভ এবং সেই বিক্ষোভে অভিযুক্তরাসহ পুলিশের হামলায় রক্তাক্ত হয়েছে কালিহাতী।

এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে চরম অসভ্যতা ও বর্বরতা এবং পুলিশের পক্ষপাতিত্বসহ বিস্তারিত উঠে এসেছে।

টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলায় ছেলেকে বিবস্ত্র করে লাঞ্চিত করার ঘটনায় দোষীদের শাস্তির দাবিতে শুক্রবার বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহতের সংখ্যা তিনে দাঁড়িয়েছে। এখনও বিভিন্ন হাসপাতালে ছয়জন গুলিবিদ্ধসহ চিকিৎসাধীন রয়েছে ২৪ জন।

ঘটনাস্থলে গিয়ে গুলির ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি এস এম মাহফুজুল হক। অতিরিক্ত ডিআইজির নেতৃত্বে পুলিশ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

নিহতদের পরিবারপ্রতি ৫০ হাজার টাকা অনুদানের ঘোষণার পাশাপাশি জেলা প্রশাসনের পক্ষে আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানিয়েছেন টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক মো.মাহবুব হোসেন। তিনি বলেন, কালিহাতী উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে ঘটনার মূল কারণ জানার চেষ্টা করা হচ্ছে।

ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে
স্থানীয়রা জানান, টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার আঠার দানা গ্রামের শ্রমিক আল আমিন এবং কালিহাতী পৌর এলাকার সাতুটিয়া গ্রামের মোজাফ্ফর চেয়ারম্যানের ছেলে রফিকুল ইসলাম রমার স্ত্রী হোসনে আরা তিন মাস আগে পালিয়ে বিয়ে করেন।

জানতে পেরে রমা ১৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে আল আমিনের বাড়িতে গিয়ে মীমাংসার আশ্বাস দেয়। রাজি না হলে রমা ও তার সহযোগীরা মা-সহ আল আমিনকে রমার ভগ্নিপতি কালিহাতী উপজেলা বাস-মিনিবাস শ্রমিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমানের বাড়িতে তুলে নিয়ে যায়।

সেখানে তাদেরকে আটকে রেখে বিবস্ত্র করে বেধড়ক মারধর করা হয় বলে এলাকাবাসী জানতে পারে।

তারা জানায়, আটকে রাখার সময় আল আমিনকে দিয়ে তার মাকে ধর্ষণ করানোর চেষ্টাও করানো হয়। পরে মা ও ছেলের বিবস্ত্র ছবি তুলে আল আমিনের মাকে বিকৃত রুচির রোমা ধর্ষণ করে বলে এলাকাবাসী জানায়।

খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে ধর্ষিতা ও তার ছেলেকে উদ্ধার করে টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায় কালিহাতী থানা পুলিশ।

এ ঘটনায় আল আমিনের মা বাদী হয়ে রফিকুল ইসলাম রমা, রমার ভগ্নিপতি হাফিজুর রহমান এবং কাজী নামের তিন ব্যক্তিসহ অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামী করে ধর্ষণ মামলা করতে চাইলে পুলিশ তা না করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা গ্রহণ করে।

তবে ওইদিনই রফিকুল ইসলাম রমাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আর দুইদিন পর গ্রেপ্তার করা হয় হাফিজুর রহমানকে।

জনতার বিক্ষোভের কারণ
ঘটনার মূল হোতা রফিকুল ইসলাম রমার বড় ভাই পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মঞ্জুর বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকতেন কালিহাতী থানা অফিসার ইনচার্জ মো.শহিদুল ইসলাম। আর এ কারণেই ওসির উপর প্রভাব খাটিয়ে শফিকুল ইসলাম মঞ্জু ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ।

পুলিশের এরকম ভূমিকার বিষয়টি টের পেয়ে আল আমিন ও তার পরিবার পুলিশের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। এলাকার মানুষ জানায়, মা-ছেলেকে বিবস্ত্র করা, ছেলেকে দিয়ে মা-কে ধর্ষণের চেষ্টা, পরে মা-কে ধর্ষণ-- এতোকিছুর পরও পুলিশ ধর্ষণ মামলা না নেওয়ায় তারা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে।

পুলিশের সঠিক তদন্ত ও দোষীদের ফাঁসির দাবিতে বৃহস্পতিবার বিকেলে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করে এলাকাবাসী।

পুলিশ লাঠিচার্জ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। সেসময় রমা ও হাফিজুরের লোকজন পুলিশের সঙ্গে যোগ দেয় বলে জানায় এলাকার মানুষ। এতে এলাকাবাসী বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে।

পরদিন শুক্রবার বিকেলে কালিহাতী ও ঘাটাইল উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামের লোকজন প্রথমে হামিদপুর বাজারে আসলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। বাধা উপেক্ষা করে জনতা কালিহাতী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় জড়ো হয়ে রমার বাড়ি ও থানা ঘেরাওয়ের চেষ্টা চালায়।

সেসময় প্রথমে লাঠিচার্জ করে পুলিশ। পরে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে এবং গুলিও চালায়।

পুলিশের গুলিতে শামীম ও ফারুক নামের দুইজন মারা যান। রাতে ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যায় শ্যামল চন্দ্র দাস নামে ১৫ বছরের আহত কিশোর। গুলিবিদ্ধ রুবেল নামে আরো একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

নিহতদের বাড়িতে শোকের মাতম
পুলিশের গুলিতে নিহত শামীম, ফারুক ও শ্যামলের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম।

কালিহাতীর কুষ্টিয়া এলাকার রাইস মিলের শ্রমিক ফারুক ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। রেখে গেছেন আট বছরের আসিফ ও ফাতেমা নামের তিন বছরের এক মেয়ে।

স্বামীকে হারিয়ে পাগলপ্রায় ফারুকের স্ত্রী। সান্তনা জানাতে আসা মানুষদের কাছে তার একট‍াই প্রশ্ন: আমার সন্তানদের এখন কি হবে?

পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য ক’দিন পরই বিদেশে পাড়ি দেবার কথা ছিলো ঘাটাইল উপজেলার সলংক্কা এলাকার শামীমের। পুলিশের গুলিতে তিনিও না ফেরার দেশে। শামীমও রেখে গেছেনে পাঁচ বছরের বাঁধন ও তিন সিন নামের দুটি ছেলে সন্তান।

শারীরিক অসুস্থতায় অক্ষম পৌর এলাকার রবিচন্দ্র দাসের ছেলে শ্যমল (১৫) তার ছোট্ট কাঁধেই তুলে নিয়েছিলো সংসারের জোয়াল। কাজ করতো বাসস্ট্যান্ড এলাকার একটি সেলুনে। ঘটনার সময় ভয় পেয়ে বাড়ি চলে আসতে চেয়েছিল শ্যামল। রাস্তা দৌড়ে পার হওয়ার সময় মাথায় গুলি লাগে তার। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাত‍ালে নেয়ার সময় তার মৃত্যু হয়।

স্বজন হারানোদের মতোই এখন নির্বাক কালিহাতী ও ঘাটাইল উপজেলার মানুষ।
সূত্র : চ্যানেল আই অনলাইন

আপনার মন্তব্য

আলোচিত