সিলেটটুডে ডেস্ক

২৯ জুলাই, ২০২২ ১৩:১৪

নুরকে নিয়ে গণঅধিকার পরিষদে বিভক্তি

রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠার এক বছরও পূর্ণ হয়নি গণঅধিকার পরিষদের। এরই মধ্যে দলে দ্বন্দ্ব-কোন্দল মাথাচাড়া দিয়েছে। সংগঠনটির সদস্য সচিব ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের সঙ্গে অন্য কয়েক নেতার বিরোধ প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে।

বিরোধের প্রধান কারণ প্রবাসী অধিকার পরিষদের কমিটি একক সিদ্ধান্তে করেছেন নুর। দলের কয়েকজন নেতার অভিযোগ, এটা নুরের একনায়কতান্ত্রিক চিন্তা-ভাবনার প্রকাশ। তবে দলের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়া বলছেন, দলে গণ্ডগোল বাধাতে কাজ করছে সরকার ও আওয়ামী লীগ।

গণঅধিকার পরিষদে নুরের বিরোধী নেতারা বলছেন, নুর এর আগেও ‘একনায়কতান্ত্রিক কায়দায়’ সংগঠন চালিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে আর্থিক অস্বচ্ছতার অভিযোগও তাদের। তারা বলছেন, দল গঠনের বছর না পেরুতেই কার্যত একা হয়ে পড়েছেন নুর।

সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ছেলে রেজা কিবরিয়াকে আহ্বায়ক ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হককে সদস্য সচিব করে গত বছরের ২৬ অক্টোবর যাত্রা করে গণঅধিকার পরিষদ। সে সময় ১০১ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়। রেজা কিবরিয়া এর আগে ড. কামাল হোসেনের গড়া দল গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

প্রবাসী অধিকার পরিষদের পাল্টাপাল্টি কমিটি

দলের কয়েকজন নেতা জানান, প্রবাসী অধিকার পরিষদ গঠনের সময় থেকেই নুরের কয়েকটি কাজের বিরোধিতা করে আসছে সংগঠনের একটি অংশ। প্রবাসী অধিকার পরিষদ দলের আয়ের অন্যতম উৎস হওয়ায় এই সংগঠনকে বিরোধের কেন্দ্রে টেনে আনা হয়েছে।

প্রবাসী অধিকার পরিষদের কর্তৃত্ব নিজের হাতে রাখতে চাইছেন নুর। কিন্তু তার এই চাওয়াটাকে দলের একটি অংশ ভালোভাবে নিচ্ছে না। মূলত সে কারণেই বিরোধটা প্রকাশ্যে এসেছে। সম্প্রতি প্রবাসী অধিকার পরিষদের পাল্টাপাল্টি কমিটি করা নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছে গণঅধিকার পরিষদ। প্রবাসীদের কমিটি করা নিয়ে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ও গত কয়েক দিন উত্তপ্ত ছিল।

গণঅধিকার পরিষদের নুর-বিরোধী এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘১৮ জুলাই প্রবাসী অধিকার পরিষদের পাল্টাপাল্টি কমিটি গঠন ঘিরে দলে কোন্দল চরম আকার নেয়। নুর একাই প্রবাসী অধিকার পরিষদের কমিটি গঠন করেন। সেই কমিটিতে কবির হোসেনকে আহ্বায়ক করা হয়। নুরের যে পাল্টা কমিটি তাতে দলের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়াকে উপদেষ্টা রাখা হয়েছে। সেই কমিটি ফেসবুকে শেয়ার দেয়ায় দলটির সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব মো. আতাউল্লাহকে দল থেকে অব্যাহতি দেন নুর। অব্যাহতি দেয়া হয় আজাদ পাটোয়ারী এবং কাজী মোখলেসকেও। এসব সিদ্ধান্ত নুর এককভাবেই নিয়েছেন।’

মো. আতাউল্লাহ এ বিষয়ে বলেন, ‘আমাকে দল থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। অথচ সে বিষয়টি আমাকে জানানো হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘নুর প্রবাসী অধিকার পরিষদের যে কমিটি করেছেন সেটিও কারও সঙ্গে আলাপ করে করা হয়নি। দলের আহ্বায়ক তখন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। অথচ কমিটির তালিকায় আহ্বায়কের সই ব্যবহার করা হয়েছে। এ নিয়ে দলে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। দলের অন্যরা এই কমিটি মেনে নেননি।

‘নুরের করা প্রবাসীদের কমিটি নিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। এ জন্য আমাকে দল থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু অভিযোগটি কী তা বলা হচ্ছে না। আমি দলের সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব। আমার সঙ্গে তো উনি আলোচনা করতে পারতেন। কিন্তু তা করা হয়নি। এভাবে একক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে নুর দলকে জিম্মি করার চেষ্টায় আছেন।’

সরকারকে দুষলেন রেজা কিবরিয়া

প্রবাসী অধিকার পরিষদের দুটি কমিটিতেই নিজের সই নেই বলে জানিয়েছেন গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়া। যার একটি শুধু নুরের স্বাক্ষরে হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘প্রথম কমিটিটি নুরের পাঠানো। আমি বিদেশে ছিলাম বলে তাতে আমার স্বাক্ষর নেই। সেটাই কিছুটা পরিবর্তন করে পুনরায় কমিটি করা হবে। আর দ্বিতীয় কমিটি ফালতু। যারা এটা করছে তারা দলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।’

নুর একক সিদ্ধান্তে এমন কমিটি করতে পারেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি জানতাম যে জিনিসটা হবে। তবে কেন আগে করেছে আমি সেটা জানি না। কমিটি আমি দেশে আসার পর করার কথা ছিল।’

দলে বিভাজন ইস্যুতে তিনি বলেন, ‘যারা দলে গণ্ডগোল বাধানোর জন্য কাজ করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইতোমধ্যে তিনজনকে দল থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে এবং কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। এখনও আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেইনি।’

আপনার দলেরই কয়েকজন বলছেন যে, গণফোরামে আপনার কারণে বিভক্তি হয়েছিল। এখন গণঅধিকার পরিষদেও তাই হচ্ছে। এ বিষয়ে কী বলবেন- এমন প্রশ্নের জবাবে রেজা কিবরিয়া বলেন, ‘গণফোরামে আমার কারণে গোলমাল হয়নি। যারা বলছেন তারা না জেনেই এমন মন্তব্য করছেন। আমার দলেও অনেকে আমার বিরুদ্ধে আছেন। কারণ আওয়ামী লীগ তো লোক লাগাবেই দলে গণ্ডগোল বাধানোর জন্য।’

কী কারণে প্রবাসী অধিকার পরিষদে পাল্টাপাল্টি কমিটি- এমন প্রশ্নে মুখ খুলতে চাননি গণঅধিকার পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক হাসান। তিনি বলেন, ‘আমাদের অভ্যন্তরীণ একটু মতভেদ হয়েছিল। সেটার সমাধান হয়ে গেছে। ওটা নিয়ে আর ঝামেলা নেই। টুকটাক যে সমস্যা হয়েছিল তা আমরা মিটিং করে সমাধান করে ফেলছি।’

দলে বিভাজন নিয়ে সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব রাশেদ খান বলেন, ‘একটু বিভ্রান্তি হয়েছিল। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিংয়ে সেটার সমাধান করা হয়েছে।’

একাধিক নেতাকে দল থেকে বহিষ্কারের বিষয়টি আগে থেকেই জানতেন কী না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সব বিষয়ে আমার মন্তব্য করা অনুচিত।’

এ বিষয়ে গণঅধিকার পরিষদের সদস্য সচিব ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, ‘আমরা প্রবাসী অধিকার পরিষদের একটি কমিটি দিয়েছি। তা দলের কয়েকজনের পছন্দ হয়নি। এজন্য তারা আপত্তি জানিয়েছে।’

প্রবাসী অধিকার পরিষদের পাল্টা কমিটি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দলের দুই-চারজন এমন একটা ফাজলামো করছে।’

একক সিদ্ধান্তে কমিটি করার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে দলের নেতারা জানতেন। যারা এমন অভিযোগ করছেন তাদের সংখ্যা হাতেগোনা কয়েকজন। যারা এমন অভিযোগ করে তারা প্রকাশ্যে বলুক। আমি আগে থেকেই প্রবাসী অধিকার পরিষদের প্রধান উপদেষ্টা ছিলাম। আমরা এর আগেও সবার মতামত নিয়ে আলোচনা করেই কমিটি দিয়েছি। প্রবাসী অধিকার আমাদের রাজনৈতিক সংগঠনও নয়। এটা নিয়ে দলের সবার সঙ্গে আলোচনারও বিষয় নেই। অনেক ক্ষেত্রে সবার সঙ্গে আলোচনাও করিনি।’

নুরের একক সিদ্ধান্ত নতুন নয়

দলীয় সূত্র বলছে, সংগঠনে এককভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া নুরুল হক নুরের ক্ষেত্রে নতুন নয়। গণঅধিকার পরিষদ গঠনের আগে তিনি তৎকালীন ছাত্র অধিকার পরিষদের সিনিয়র যুগ্ম-আহ্বায়ক রাশেদ খান ও যুগ্ম আহ্বায়ক সোহরাব হোসেনকে একক সিদ্ধান্তে বহিষ্কার করেছিলেন।

অভিযোগ রয়েছে, ওই ঘটনার নেপথ্যে অন্যতম কারণ ছিল নুরের গাড়ি কেনা নিয়ে রাশেদের বিরোধিতা। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে তৎকালীন ছাত্রঅধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুনকে পদত্যাগ করানো নিয়েও নূর ও রাশেদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল। পরে অবশ্য একসঙ্গে বসে বিভেদের মীমাংসা হয়ে যায়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পরিষদের এক নেতা বলেন, ‘রাশেদ খানকে বিতর্কিত করার পর নুর ভেবেছিলেন তার আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। হাসান আল মামুনও ইতোমধ্যে পদত্যাগ করেছেন। তবে যুব অধিকার পরিষদের সাবেক প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক ও কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রথম সারির নেতা আতাউল্লাহ সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হওয়ায় তিনি নুরের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করতে থাকেন। বিশেষ করে আর্থিক বিষয়ে স্বচ্ছতার দাবি তোলায় ও নুরের ভাই আমিনুলসহ কয়েকজনের দলে পদায়ন নিয়ে বিরোধিতা করেন আতাউল্লাহ। এসব কারণেই তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়।’

আর্থিক অস্বচ্ছতার অভিযোগ

গণঅধিকার পরিষদের কয়েক নেতার অভিযোগ, নুরের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্বের মূল কারণ আর্থিক অস্বচ্ছতা। দলটির আয়ের প্রধান উৎস প্রবাসী অধিকার পরিষদ। সংগঠনটির যাত্রালগ্নে নুরকে প্রধান উপদেষ্টা করা হয়। কিন্তু নুর ও গণঅধিকার পরিষদের যুগ্ম-সদস্য সচিব তারেক রহমান আয়-ব্যয়ের হিসাব দিতে ব্যর্থ হন। বিশেষ করে সিলেটে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রবাসীদের দেয়া প্রায় ৩০ লাখ টাকার হিসাব চাইলে তারেক ও নুর গড়িমসি শুরু করেন। তখন নূরের বিরোধীরা প্রবাসী অধিকারকে সরাসরি গণঅধিকারের অধীনে পরিচালনার দাবি তোলেন।

দলের এক সিনিয়র নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘প্রবাসীদের কয়েকজন নূরের বিরুদ্ধে আর্থিক অস্বচ্ছতার অভিযোগ করতেছে। আমাদের অনেকের কাছে এমন অভিযোগ করেছে। তবে আমরা সেটার তদন্ত এখনও করিনি। একজন প্রবাসী নুরের বিরুদ্ধে আর্থিক অস্বচ্ছতার অভিযোগের পাশাপাশি প্রমাণও দিয়েছেন।’

অভিযোগ প্রসঙ্গে নুরের বক্তব্য

আর্থিক অস্বচ্ছতার অভিযোগ নিয়ে নুর বলেন, ‘দলের দুই-একজন লোক আমার ইমেজ ক্ষুণ্ন করার জন্য এমন অভিযোগ করতে পারে। তারা দলে ভাঙন ধরানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এগুলো আমরা আমলে নিচ্ছি না।’

একক সিদ্ধান্তে দল পরিচালনার অভিযোগ প্রসঙ্গে এই সাবেক ছাত্রনেতা বলেন, ‘দলের যারা এমন কথা সাংবাদিকদের বলেন তারা তা দলীয় মিটিংয়ে উপস্থাপন করুন। কেউ যদি দল করেন তার তো সর্বোচ্চ নেতৃত্বের প্রতি কমিটমেন্ট থাকতে হবে। দলীয় ফোরামে তো তারা এসব অভিযোগ নিয়ে কিছু বলেন না। তার বদলে সাংবাদিকদের বলে, ফেসবুকে লিখে সমস্যার সমাধান হবে না।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত