সিলেটটুডে ডেস্ক:

১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ২৩:১৩

‘চিটার সর্দার’ ছাত্রলীগ সভাপতি রানার বিরুদ্ধে মামলা

জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল থেকে এসে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে বসার অভিযোগ যখন আলোচনায়, তখনই রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সাকিবুল ইসলাম রানার বিরুদ্ধে চাকরি পাইয়ে দেয়ার নামে অর্থ আত্মসাতের মামলা হয়েছে। রাজশাহীর দুর্গাপুর আমলি আদালতে বৃহস্পতিবার সকালে মামলাটি করেন দুর্গাপুর উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান।

মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, আসামি রানা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পাইয়ে দেয়ার নাম করে আতিকের কাছ থেকে ৩১ মার্চ নগদ ৯০ হাজার টাকা এবং ডাক বিভাগের অনলাইন (নগদ) মাধ্যমে ১০ হাজার টাকা নেন। ২০২২ সালের মে মাসে তিনি বাদীকে চাকরি পাইয়ে দেয়ার আশ্বাস দেন। কিন্তু আজ অবধি চাকরি না হওয়ায় রানার কাছে টাকা ফেরত চান আতিক। রানা দুই মাসের মধ্যে টাকা ফেরতের আশ্বাস দিলেও কোনো টাকা পাননি আতিক।

আতিকুর রহমানের পক্ষে মামলাটি করেন আইনজীবী ইমরান কলিম খান। তিনি জানান, দুর্গাপুর আমলি আদালতে এই মামলাটি দায়ের করা হয়েছে। ৪০৬ ও ৪২০ ধারার প্রতারণা মামলায় টাকা গ্রহণের কাগজপত্রও আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। বিচারক মো. লিটন হোসেন ১২ ডিসেম্বর আসামিকে স্বশরীরে আদালতে হাজির হতে সমন জারি করেছেন।

এদিকে সম্প্রতি জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রানাকে নিয়ে দলের বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা হচ্ছে। এক সময়ের ছাত্রদল নেতা কিভাবে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হলেন তা নিয়ে চলছে গুঞ্জন।

কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ২৪ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের ৩০ সদস্যবিশিষ্ট নতুন কমিটি অনুমোদন দেন। সেখানে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পান সাকিবুল ইসলাম রানা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাকিবুল ইসলাম রানা ছাত্রলীগে যোগদানের আগে ছাত্রদলের রাজশাহী কলেজ মুসলিম ছাত্রাবাস শাখা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। সে সময়ে ছাত্রদলের ‌ওই কমিটিতে আহ্বায়ক ছিলেন শরিফুল ইসলাম নয়ন। রানা ছিলেন ওই কমিটির ৬ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক। ২০১৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সেই কমিটির অনুমোদন দেন তৎকালীন রাজশাহী কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি মূর্ত্তজা ফামিন ও খন্দকার মুখসুদুর রহমান সৌরভ।

রাজশাহী কলেজ ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও রাজশাহী মহানগর ছাত্রদলের সিনিয়ন সহ-সভাপতি মূর্ত্তজা ফামিন বলেন, ‘সাকিবুল ইসলাম রানা বর্তমানে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছে। কিন্তু সে রাজশাহী কলেজে পড়ার সময় ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল। সে হোস্টেল কমিটিতেও ছিল। সে সক্রিয়ভাবে আমাদের সঙ্গে মিটিং-মিছিল করত।

‘২০১৩ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আমরা দায়িত্বে ছিলাম। সে সময় রাজশাহী কলেজের ছাত্রদলের সঙ্গে যুক্ত ছিল রানা। আমার যতটুকু মনে আছে, রাজশাহী কলেজ হোস্টেলে ৫/৬টি কমিটি ছিল। এর একটিতে সে ছিল।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের এক সদস্য বলেন, ‘সাকিবুল ইসলাম রানা ছাত্রলীগের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে সংগঠনে একের পর এক অঘটন ঘটে চলেছে। জেলা ছাত্রলীগের মধ্যে ছাত্রদলের অনুপ্রবেশ বেশ কষ্টদায়ক। আমরা অনেক কষ্ট করেই রাজপথে লড়াই করে আসছি।

‘এখন দলের মধ্যে যদি সাবেক ছাত্রদল কর্মী ডুকে যায় তবে এটি আগামীতে আমাদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। বিএনপি-জামায়াত আমাদের সব তথ্য গোপনে তার মাধ্যমেই পেয়ে যাবে। এটি আমাদের রাজনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এজন্য বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উচিত এখনই বিষয়টি ভেবে দেখা এবং তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া।’

তবে সাকিবুল ইসলাম রানা বলেন, ‘আমি কোনোদিন ছাত্রদল করিনি। রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবশত কে বা কারা আমার নাম বসাতে পারে। আমি কোনোদিনই ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। আমি ২০১৪ সাল থেকে ছাত্রলীগের সদস্য। আমার কখনও কোনো সময়ে আমার ছাত্রদল করার প্রশ্নই আসে না।’

রাজশাহী মহানগর ছাত্রদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি মূর্ত্তজা ফামিনের বক্তব্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবশত এমনটা বলেছেন। আমি যে তাদের সঙ্গে ছাত্রদলের রাজনীতিতে জড়িত ছিলাম সে সম্পর্কিত একটি ছবি তাদেরকে দেখাতে বলুন। না হয় তারা এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও ফুটেজ দেখান। ২০১৬ সাল খুব আগে কথা নয়। সে সময়ও সবার হাতে স্মার্ট মোবাইল ফোন ছিল। এরকম মনগড়া স্টেটমেন্ট দিলে তো হবে না।’

‘বহুত চিটারি-বাটপারি কইরি ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট হইসি, আমি চিটারের সর্দার’

এ দিকে সংগঠনের এক নারী কর্মীর সঙ্গে রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সাকিবুল ইসলাম রানার কথোপকথনের একটি অডিও ফাঁস হয়েছে। বুধবার রাতে ৪ মিনিট ১০ সেকেন্ডের একটি অডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে রাজশাহীতে তোলপাড় শুরু হয়।

ওই অডিওতে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়া সাকিবুল ইসলাম রানা বলেন, ‘বহুত চিটারি-বাটপারি কইরি ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট হইসি, আমি সব চিটারের সর্দার।’

অডিওর কথোপকথন তুলে ধরা হলো:

কর্মী: হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম।

রানা: তুমি আমার সাথে নাটক করিচ্চো, তাই না?

কর্মী: কিসের নাটক ভাইয়া?

রানা: তোমার তো কথা-কাজের একটাও মিল পাচ্ছি না।

কর্মী: কিন্তু আমার কথা ও কাজের মিলতো সব সময় থাকে।

রানা: কই আজ কার সাথে ঘুরতে গেলা, বললা ভাইয়া...

কর্মী: বুঝি নাই।

রানা: তুমি কার সাথে গেলা, বললা এডা আমার ভাইয়া। তোমার তো ভাইয়াই নাই। এইডা হইলো?

কর্মী: কে বলল?

রানা: শোনো, আমার চোখ চারদিকেই থাকে...। এসব চিটারি করতে পারবা না। বহুত বড় চিটারি-বাটপারি কইরি আমি প্রেসিডেন্ট হইছি...। সব চিটারের দলের সর্দার আমি।

কর্মী: জ্বী ভাইয়া।

রানা: তুমি না আসলে, না আসলে; তুমি কাউকে পাঠাইতে চাইলে সে কই?

কর্মী: এখন আমি তো ব্যস্ত ছিলাম। এর জন্যই তো হয় নাই।

রানা: এখন কই?

কর্মী: আমি বাসায় ভাইয়া।

রানা: তুমি যে বাসায় চইলা গেলা, নিজে শান্তি পাইলে সব শান্তি! আর আমরা এভাবেই থাকি, নাকি? তোমাকে কত বিশ্বাস করি তুমি বলো তো?

কর্মী: আমি তো বিশ্বাসের মর্যাদা সব সময় রাখার চেষ্টা করি।

রানা: তুমি যার সাথে ঘোরো, তার চেয়ে যদি বড় নেত্রী হও, সেটা মানুষ মাইনা নিতে পারে না। এটা বোঝো না?

কর্মী: জ্বী ভাইয়া। এখন তৃষা আপু কি আমার সত্যিই খারাপ চাচ্ছে?

রানা: মসজিদে উঠে বললে বিশ্বাস করবে?

কর্মী: ছি ছি ভাইয়া। আমি তো আপনাকে বিশ্বাস করি। এটার জন্য এতদূর তো করতে হবে না।

রানা: তাহলে কেউ চায়, তার চেয়ে তুমি বড় হও? সে সাংগঠনিক, তুমি পার্টির যদি ভাইস প্রেসিডেন্ট হও, তার চাইতে দুই গুণ রাস্তা উপরে তোমার। যুগ্মদের চাইতেও সিনিয়র তুমি...।

কর্মী: আমি তো আপনার কথামতো তৃষা আপুকে ছেড়ে দিলাম ভাইয়া। কিন্তু আপনাকে মেইনটেন যে করব, মানে একটা ব্যবহার আমার খুব খারাপ লেগেছে।

রানা: আমাকে তুমি মেইনটেন করবে, আমি তো সরাসরি বলেছি। তোমার ফিনান্সিয়াল সাপোর্ট লাগবে আমি দেব। আমার কোন ন্যাচার খারাপ লাগল বলো?

কর্মী: আছে তো, অনেক কারণই আছে।

রানা: শান্ত?

কর্মী: অবশ্যই শান্ত ভাইয়ার ব্যবহার। সেই দিনের ওইটা আমার খারাপ লেগেছে।

রানা: ওই যে তুমি বলছিলা, তোমার আরও লাগবে। তাই ভাবলাম তুমি একটু সুখে থাকো, খুশি থাকো।

কর্মী: এগুলো তো ভাইয়া অবান্তর কথা। আর আমার ফাইনান্সিয়াল সাপোর্টের কোনো প্রয়োজন নেই। সংগঠনটাকে ভালবেসেই আমি আসছিলাম।

রানা: তাহলে শোন, শান্ত-মান্ত কেউ থাকবে না। আমি একা...

কর্মী: তো ভাইয়া আপনি মেয়ের কথা কালকে বলছিলেন, যেটা ছবি পাঠাইছিলাম। এখন আপনি বললে তাহলে...

রানা: দেখো তো, দেখো তো পাঠাতে পার নাকি।

কর্মী: এখন ভাইয়া উনিও তো ফ্যামিলির সাথে থাকে।

রানা: কেবল তো ৮টা বাজে রে। রাত হয়নি। একটু ফোন দাও দ্রুত। দিয়ে দেখো তো...। কেউ যেন না জানে।

কর্মী: না না, কে জানবে! আপনি আমাকে ভরসা করতে পারেন।

রানা: কী রকম ভরসা করি দেখো না?

কর্মী: জ্বী ভাইয়া।

এই অডিও রেকর্ডটির বিষয়ে কথা বলতে সাকিবুল ইসলাম রানাকে ফোন করা হলে তিনি ধরেননি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কথোপকথনে থাকা নারী জেলা ছাত্রলীগের একজন কর্মী।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত