রেজা ঘটক

৩০ মে, ২০১৬ ২৩:৩৭

এশিয়ান কাপের বাছাইপর্বের প্রথম প্লেঅফ খেলতে তাজিকিস্তানে বাংলাদেশ

এএফসি এশিয়ান কাপ ২০১৯ বাছাইপর্বের ম্যাচ খেলতে রবিবার সকালে তাজিকিস্তানের উদ্দেশ্যে দেশ ছেড়েছে বাংলাদেশ ফুটবল দল। আগামী ২ জুন স্বাগতিক তাজিকিস্তানের বিপক্ষে মাঠে নামবে লাল সবুজের দল। আর ৭ জুন ফিরতি লেগে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হবে দুই দল। ম্যাচটি শুরু হবে বাংলাদেশ সময় রাত নয়টায়।

রবিবার তাজিকিস্তান যাওয়ার আগে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক মামুনুল জানিয়েছেন, যতদিন ঢাকা ও আন্তর্জাতিক ম্যাচে ফুটবল খেলেছি প্রতিটি ম্যাচই আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল। প্রতিনিয়তই আমাদের নতুন করে চ্যালেঞ্জ নিয়ে মাঠে নামতে হয়। তাজিকিস্তানের বিপক্ষে এই ম্যাচটি খুবই চ্যালেঞ্জিং, কারণ আমরা যারা নিষেধাজ্ঞা থেকে দলে এসেছি এই ম্যাচে তাদের ভালো পারফর্ম খুবই জরুরি।

মামুনুল আরও বলেন, তাজিকিস্তানের বিপক্ষে আমরা এখনও ভালো কিছুই করতে পারিনি। শেষ ম্যাচ আমরা ৫-০ গোলে হেরেছি। তবে অ্যাওয়ে এই ম্যাচটিতে আমরা এবার একটি দল হিসেবে ভালো কিছু করার জন্য যাচ্ছি। ভালো পারফর্ম করতে চাই।

মাত্র কয়েকদিন আগে নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে দলে ফিরেছেন মামুনুল। আর দলে ফিরে নিজেকে পুরোপুরি ছন্দে ফেরাতে কোচ লোডভিক ডি ক্রুইফের অধীনে গেল দুই সপ্তাহের অনুশীলনে ঘামও ঝরিয়েছেন। এদিন দেশ ছাড়ার আগে বাংলাদেশ ফুটবল দলের হেড কোচ লোডভিক ডি ক্রুইফ বলেছেন, ছেলেরা কঠোর পরিশ্রম করেছে। আশা করছি তারা ভাল করবে। ম্যাচটিকে সামনে রেখে তারা এখন ভীষণ উজ্জীবিত। এই ম্যাচের পরেই আমাদের হোম ম্যাচ। আর সেখানে ইতিবাচক কিছু করতে হলে তাজিকিস্তানে ভালো ফলাফল আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

গত বছর নভেম্বরে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ৫-০ গোলের হারের রেশ মুছে যাওয়ার আগেই মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে মধ্য এশিয়ার এই দেশটির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আগামী ২ জুন ২০১৬ তারিখে দুশানবেতে অনুষ্ঠিত হবে ম্যাচটি। ফলাফলটা এবার কী হতে পারে? 'গোল না খাওয়াটাই আমাদের লক্ষ্য' বলে জানালেন নিষেধাজ্ঞা থেকে ফিরে জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব ফিরে পাওয়া মামুনুল ইসলাম। এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বের প্লেঅফের অ্যাওয়ে ম্যাচ খেলতে আজই তাজিকিস্তানের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল ।

তাজিকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের ফুটবল পরিসংখ্যান কিন্তু মোটেও সুখকর নয়। তাজিকিস্তানের মাটি যেন বাংলাদেশের জন্য বিশাল গিরিখাদ। ২০০৩ সালে তাজিকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশ প্রথম খেলায় ২-০ গোলে হেরেছিল। ২০০৭ সালে সেই দুঃখটা ছিল আরো বড়, ৫-০ গোলের হার। এরপর ২০১৫ সালে তৃতীয়বার মুখোমুখিতে বাংলাদেশ আবারো হেরেছিল ৫-০ গোলের ব্যবধানে। আর গত বছর নভেম্বরে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে চতুর্থবার মুখোমুখি হয়ে হেরেছিল আবারো ৫-০ গোলের ব্যবধানে। যে কারণে তাজিকিস্তানের মাটিতে স্বাগতিকদের বিপক্ষে বাংলাদেশের খেলার ফলাফলের টাইমলাইন কিন্তু চরম হতাশার।

বাংলাদেশ দলের এই তাজিকিস্তান পর্ব নিয়ে নাটক কিন্তু একদম কম হয়নি! তৃতীয় মেয়াদে ফিরিয়ে আনা হয়েছে নেদারল্যান্ডসের কোচ লোডভিক ডি ক্রুইফকে। এক বছরের নিষেধাজ্ঞার দুই মাস পেরোতেই শাস্তি মওকুফ করা হলো মামুনুল ইসলামের। পাশাপাশি ক্যাপ্টেন হিসাবে আর্মব্যান্ডও বেঁধে দেওয়া হলো এই মিডফিল্ডারের হাতেই। ফলে আবারও তাজিকিস্তানের মাটিতে স্বাগতিকদের বিপক্ষে সেই ক্রুইফ-মামুনুল জুটি। পুনরায় অধিনায়ক হয়ে ফিরতে পেরে মামুনুল অতীত ভুলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার গান শোনালেন।

গতকাল ঘোষিত ২৩ সদস্যের চূড়ান্ত দলে আছেন নিষেধাজ্ঞা থেকে ফেরা উইঙ্গার সোহেল রানাও। এছাড়া এবার দলে একেবারেই নতুন মুখ স্ট্রাইকার সৈয়দ রাশেদ তূর্য। ১১ মে শুরু হওয়া তাজিকিস্তান পর্বের নাটাই ক্রুইফ হাতে নেন ১৭ মে । শিষ্যদের পরখ করে নেওয়ার জন্য শেখ রাসেলের বিপক্ষে একটি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলেছে জাতীয় দল। ফলাফল ছিল গোলশূন্য ড্র। সংক্ষিপ্ত অনুশীলন পর্ব ও অনুশীলন ম্যাচের অপর্যাপ্ততা থাকা সত্ত্বেও দল নিয়ে বরাবরের মতোই আবারো অনেক আশার কথা শোনালেন কোচ ক্রুইফ। তিনি বলেন, 'খুবই ভালো অনুশীলন হয়েছে। দলের প্রতিটি খেলোয়াড়ই দেশের হয়ে কিছু করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। তবে ভুলে গেলে চলবে না, আমরা প্রতিপক্ষের মাঠে খেলব। আশা করি ফেরার সময় সম্মান নিয়েই ফিরতে পারব।'

দুশানবেতে আগামী ২ জুন মাঠে নামার আগে অবশ্য ঢাকার মাঠ থেকেই অনুপ্রেরণা খুঁজছেন বাংলাদেশ কোচ। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে বাংলাদেশের একমাত্র নীলমণি অর্জন এক পয়েন্ট। পঞ্চমবারের মুখোমুখিতে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে তাজিকিস্তানের বিপক্ষে ১-১ গোলে ড্র করেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু ফিরতিম্যাচে ইতালিয়ান কোচ ফ্যাবিও লোপেজের অধীনে বাংলাদেশ হেরেছিল ৫-০ গোলের ব্যবধানে। যেটা ছিল তাজিকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের ষষ্ঠবার মুখোমুখি হওয়ার গল্প। তাই তাজিকিস্তানে অ্যাওয়ে ম্যাচকে ঘিরে এবার পরিসংখ্যানটার দিকেই ফুটবলমোদীদের কৌতূহল।

দুশানবেতে প্রতিপক্ষের মাঠে এবার গোল না খাওয়ার দিকটি স্বাভাবিকভাবেই গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি। টিম ম্যানেজার সত্যজিৎ দাস রুপুও জানালেন, রক্ষণ অটুট রাখার দিকেই এখন আমাদের দৃষ্টি। প্রথম ম্যাচে আমাদের একটাই লক্ষ্য, তাজিকিস্তানের মাঠে গোল না খাওয়া। অনুশীলনে এ দিকটি খেলোয়াড়দের, বিশেষ করে ডিফেন্ডারদের বারবার বোঝানো হচ্ছে। মানসিকভাবে খেলোয়াড়দের সেভাবেই প্রস্তুত করছেন কোচ। দুশানবেতে ক্রুইফের রক্ষণাত্মক ছক বাস্তবায়নের দায়িত্ব যাদের কাঁধে বেশি থাকবে, সেই নাসিরউদ্দিন চৌধুরী ও ওয়ালী ফয়সাল জানালেন আটঘাট বেঁধে প্রস্তুতি নেওয়ার কথা। বিশ্বকাপ বাছাইয়ে নিজেদের মাঠে তাজিকিস্তানের সঙ্গে ড্র ম্যাচ থেকেও অনুপ্রেরণা নিচ্ছেন তারা।

সেট পিস, কর্নার থেকে গোল হজম না করা নিয়ে অনুশীলনে বিশেষভাবে কাজ করছে বাংলাদেশ। শেষ দিকে মনোবল ধরে রাখার প্রতিও বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার কথা জানালেন অভিজ্ঞ ডিফেন্ডার ওয়ালী ফয়সাল। (বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে) তাজিকিস্তানের বিপক্ষে ঘরের মাঠে আমরা এগিয়ে ছিলাম কিন্তু শেষ দিকে গোল খেয়ে ড্র করেছি। এ ম্যাচেও যেন এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে, ডিফেন্ডাররা যেন শেষ সময়ে মানসিক শক্তি না হারায়, মনোযোগের ঘাটতি না হয়, কোচ সেদিকটা নিয়ে এখন কাজ করছেন।

টিম ম্যানেজার সত্যজিৎ দাস রুপু বললেন, আক্রমণভাগ নিয়ে বাংলাদেশের দুর্ভাবনা এখনো কাটেনি। ফরোয়ার্ড নাবীব নেওয়াজ জীবন অভিজ্ঞতায় এগিয়ে। তবে জীবন ছাড়াও জুয়েল রানা, রুবেল হোসেন, মামুনুলের গোল করার সামর্থ্য আছে।

এদিকে দুই ডিফেন্ডার লিঙ্কন ও কেষ্ট কুমার বোস কাঁধের চোট আর গোলরক্ষক মাজহারুল ইসলাম হিমেল জ্বরের কারণে তাজিকিস্তান ম্যাচের প্রাথমিক দল থেকে ছিটকে গেছেন। বর্তমান দলে থাকা ২৭ জনের মধ্যে ২৩ জনকে নিয়ে চূড়ান্ত দল করা হয়েছে।

আগেরবার বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে আর এবার ২০১৯ এশিয়ান কাপের বাছাইপর্বের টিকিট পাওয়ার প্রথম প্লে-অফের পরীক্ষায় বাংলাদেশ। নভেম্বরে তাজিকদের কাছে ৫-০ গোলে হারের লজ্জাটা ছিল বৃষ্টিভেজা দুশানবের মাঠে। তবে আবহাওয়া এবার হয়তো অতটা প্রতিকূল থাকবে না। কিন্তু দুশানবের দ্রুতগতির টার্ফের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এছাড়া তাজিকিস্তানের মাঠে বাংলাদেশ আগে কখনো জেতেনি, এটা বিশাল একটা মনস্তাত্ত্বিক বাধা বটে! যে কারণে এবারের সফরেও সেটি বাংলাদেশের সামনে অদৃশ্য এক দেয়াল হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

এমনিতে অ্যাওয়ে ম্যাচ খেলা সব সময়ই কঠিন। তাই আগের ৫-০ স্কোরলাইন বিবেচনায় নিলে তাজিকদের বিপক্ষে এবার ড্র করতে পারাটাই অনেক আনন্দের ব্যাপার হতে পারে। বাংলাদেশ দলের থিংক ট্যাংক অবশ্য ১-০ গোলের হারকেও ততোটা খারাপ ফল বলতে নারাজ! সে ক্ষেত্রে ঢাকায় ৭ জুন ফিরতি ম্যাচে ২-০ গোলে জেতার চেষ্টা করতে হবে বাংলাদেশকে। তবে এসব সমীকরণ কেবল ‘অফ দ্য রেকর্ড’ আলোচনায় এসেছে।

এমনিতে ডি ক্রুইফ ৪-৩-৩ ছকে দলকে বেশি খেলান। কখনো কখনো ৪-৫-১ ছকে। তবে এই সফরেও চার ডিফেন্ডার নিয়ে খেলবেন বলে আভাস দিলেন। কিন্তু রক্ষণ শক্তিশালী করে খেলার এই মিশনে দেখা যাচ্ছে ক্রুইফের ২৩ সদস্যের দলে ফরোয়ার্ডের ছড়াছড়ি। আর সেখানে একেবারেই নতুন মুখ সৈয়দ রাশেদ তূর্য। রহমতগঞ্জের এই ফরোয়ার্ডের স্কিলে ঘাটতি থাকলেও শক্তি এবং শারীরিক গঠনে অবশ্য নজর কেড়েছেন কোচের। বয়সভিত্তিক দলে তেমন না খেলেও সরাসরি এসেছেন জাতীয় দলে।

২০১৪ সালে বিকেএসপিতে একটা ম্যাচে প্রথম তূর্যকে দেখেন ডি ক্রুইফ। ফেডারেশন কাপে গোল করেছেন মাত্র একটি। বেশিরভাগ সময়ই কাটাতে হয়েছে রহমতগঞ্জের বেঞ্চে। তূর্য সম্পর্কে কোচের মূল্যায়ন, ‘সে ভালো খেলোয়াড়, পাওয়ার আছে। এজন্যই ওকে নিলাম। তবে ওকে উন্নতি করতে হবে।’ সর্বশেষ ক্যাম্পে থাকা ২৬ জন থেকে বাদ পড়েছেন আমিনুর রহমান সজীব, শাকিল আহমেদ, ইয়ামিন মুন্না। আর নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে মামুনুলের সঙ্গে ফিরেছেন সোহেল রানাও।

এই ম্যাচ দিয়ে অবশ্য বাংলাদেশ দলের ডাগ-আউটে ফিরছেন কোচ ডি ক্রুইফ নিজেও। আর যথারীতি তিনি আশাবাদী, ‘ছেলেরা খুবই উজ্জীবিত, দারুণ প্রশিক্ষণ হয়েছে, আমরা একশভাগ তৈরি। ভালো ফল চাই তাজিকিস্তানে।’ তবে কোচের পাশে বসা অধিনায়ক মামুনুলকে যেন একটু বিমর্ষই লেগেছে! হতে পারে নভেম্বরে তাজিকদের বিপক্ষে সেই ৫-০ গোলের দুঃস্মৃতিটা এখনো এই হতাশার ছায়! তবুও বাংলাদেশ দল ভালো করুক এমনটাই প্রত্যাশা ফুটবলপ্রেমীদের।

২৩ সদস্যের বাংলাদেশ দল: সোহেল, আশরাফুল রানা, রাসেল মাহমুদ, তপু বর্মণ, মামুন মিয়া, নাসির উদ্দিন, নাসিরুল, রায়হান, ওয়ালী ফয়সাল, আরিফুল, রেজাউল, জামাল ভূঁইয়া, মামুনুল, ইমন, মোনায়েম রাজু, শাহেদ, জনি, সোহেল রানা, জুয়েল রানা, ফয়সাল মাহমুদ, রুবেল মিয়া, জীবন ও তূর্য।

নতুন মুখ: সৈয়দ রাশেদ তূর্য। নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে দলে ফিরলেন: মামুনুল ও সোহেল রানা।

সর্বশেষ জর্ডান সফর থেকে বাদ পড়লেন: হিমেল, ফজলে রাব্বি, শাহেদ জুনিয়র, সজীব, কেষ্ট, ফাহাদ ও শাকিল।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত