মৌলভীবাজার প্রতিনিধি

২৮ জুন, ২০২০ ০১:৫৪

শিবিরের সাথী থেকে সরকার দলীয় নেতাদের ঘনিষ্টজন, নানা অভিযোগ

মৌলভীবাজারে এক শিবির নেতাকে নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। মৌলভীবাজার সরকারী কলেজের ওই ছাত্রশিবির নেতা বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সাথে ঘণিষ্ট হয়ে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ ওঠেছে। বিভিন্ন ইস্যুতে প্রবাসীদের কাছ থেকে টাকা উত্তোলন করে তা আত্মসাত, তদবির বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অভিযোগ ওঠেছে চৌধুরী মুহাম্মদ মেরাজ নামের এই যুবকের বিরুদ্ধে।

চৌধুরী মুহাম্মদ মেরাজের বাড়ি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার চিতলিয়া গ্রামে। বর্তমানে শহরের কলিমাবাদে ভাড়া বাসায় থাকেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের বরাত দিয়ে জানা যায় মেরাজের পরিবারের প্রায় সকলেই জামায়াতের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত।
মেরাজ চৌধুরীর বড় ভাই জামাত নেতা বর্তমানে যুক্তরাজ্য প্রবাসী। অপর ভাই শিক্ষানবিশ আইনজীবী কমলগঞ্জ উপজেলা ছাত্রশিবিরের সাবেক সহ-সভাপতি ছিলেন। আর মেরাজ মৌলভীবাজার শহর শিবিরের সাথী। মৌলভীবাজার শহর শিবিরের পরিচালিত ফেইসবুক আইডি তে থাকা ছবিতে মেরাজকে শিবিরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থিতি দেখা গেছে। শিবিরের নেতারাও স্বীকার করেছেন মেরাজ তাদের সক্রিয় কর্মী ছিল।

২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি শিবিরের সক্রিয় নেতা থাকলেও এর পর সরকারি দলের সাথে মিশে নিজেকে আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে পরিচয় দিতে থাকেন মেরাজ। তিনি বিভিন্ন সেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথে যুক্ত। সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রীদের পাশে মেরাজের ছবি দেখা গেছে।  এছাড়া নিয়মিত দেখা যায় প্রশাসনের বিভিন্ন সভায়। ঘুরে বেড়ান আওয়ামীলীগের শীর্ষ নেতাদের গাড়িতে করে।  যদিও কয়েকবছর আগেও যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি চেয়ে সক্রিয় ছিলেন মেরাজ।

গত এক সপ্তাহ ধরে মেরাজের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়টি ফেসবুকে আলোচিত হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন



এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জেলার সরকার দলীয় মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা। তারা বিভিন্ন সময় নেতাদের কাছে অভিযোগ দিলেও নেতারা আমলে নেননি বলে জানিয়েছেন মাঠ পর্যায়ের নেতারা।

মেরাজের নিজ ইউনিয়ন আলীনগর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ফাহিম আল আহমেদ জানান, মেরাজের সারা পরিবার জামাতের রাজনীতির সাথে জড়িত। এলকায় সে শিবির করত। আমি ছাত্রলীগের সভাপতি হয়ে নেতাদের পাশে যেতে পারিনা তার ছবি বিভিন্ন নেতাদের সাথে দেখে তো আমরা অবাক। চাল চলন বেশভূষাও বদলে গেছে দ্রুত।

 
এ দিকে মেরাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি সামাজিক সংঠনের নামে বিভিন্ন সময় প্রবাসীদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে তা হাতিয়ে নিয়েছেন। প্রবাসীদের নিয়ে ঘটনা করা বিভিন্ন ওয়াটসাপ গ্রুপের মাধ্যমে মৌলভীবাজারের বিভিন্ন কাজের কথা বলে প্রবাসীদের কাছ থেকে টাকা টাকা সংগ্রহ করে এর একটি অংশ মেরাজ আত্মস্বাত করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
 
এমননি একটি গ্রুপের সদস্য ছিলেন গিয়াস আহমেদ বলেন, আমাদের গ্রুপে সদস্য ছিল সাড়ে ৩শ। মেরাজ মৌলভীবাজারের উন্নয়নের নামে প্রবাসীদের কাছ থেকে চাঁদা এনে সেই টাকায় নিজের বাড়িতে উন্নয়ন করেছেন। এই অভিযোগ যারা টাকা দিয়েছিলেন তারাই আমাকে জানিয়েছেন।

লন্ডন প্রবাসী জাহেদ আমদ জানান, মৌলভীবাজার প্রেসক্লাবের সামনে নির্মিত একটি ওয়াচটাওয়ারের টাইলসে নাম তুলে দেওয়ার কথা বলে আমার কাছে ১ লাখ টাকা চান মেরাজ। আমার জানামতে তিনি অনেকের কাছেই এটা চেয়েছে।

তিনি বলেন, মেরাজ আমাকে জানায় সামান্য জায়গা আছে অনেকেই নাম লেখাচ্ছেন আপনি লেখালে আমাকে ১ লাখ দেন আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

তদবির বানিজ্যেরও অভিযোগ রয়েছে মেরাজের বিরুদ্ধে। মৌলভীবাজারের সদর উপজেলার এবং মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের এক ছাত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গত প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগের সময় তিনি আমাকে একদিন বলেন পরিচিত কেউ যদি প্রাইমারীরতে আবেদন করে থাকে সেটা যেনো তাকে বলি। ৫ লাখ টাকা দিলে চাকরি নিশ্চিত।

জেলার সাবেক এক শিবির নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমি নিজেও শিবির করার কারণে জেলে গেছি। মেরাজ একসময় আমাদের সাথে ছিল, রাজনৈতিক অবস্থার কারণে অনেকেই অনেক ভাবে নিজের অসিস্ত বাঁচিয়ে রাখছেন সেটা আমাদের কাছে দোষের কিছু নয় কিন্তু সে যা করেছে তা তার রাজনৈতিক আদর্শের সাথে বেঈমানি। সরকারি দলের নেতাদের সাথে তার তেলবাজি আমাদের কষ্ট দেয়। সে অন্তত ৫০টি সামাজিক সংস্থার সাথে জড়িত। প্রবাসীরা দেশে আসলে ৫০০ টাকা দিয়ে ক্রেষ্ট দেয় কিন্তু এর জন্য আদায় করে ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা দেখিয়ে প্রবাসীদের কাছ থেকে সে টাকা সংগ্রহ করে।

মেরাজ চৌধূরীর বিরুদ্ধে কখনো সাংবাদিক আবার কখনো ভূক্তা অধিবারের কর্মকর্তা পরিচয়ে মানুষের সাথে প্রতারণারও অভিযোগ ওঠেছে।

মৌলভীবাজার চৌমহনীর একটি রেস্টুরেন্টে ভুক্তা অধিকারের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে অনৈতিক সুবিধা আদায়ের বিষয়ে গত বছর জেলা ভুক্তা অধিকারের সহকারী পরিচালকের কাছে মৌখিক অভিযোগ দেন মৌলভীবাজারের একজন টেলিভিশন সাংবাদিক।


জেলা ভোক্তা অধিকার অফিসের একজস সহকারী পরিচালক জানান, মেরাজ ভোক্তা অধিকারের কিছু হয়। বিভিন্ন সময় সাংবাদিক পরিচয়ে অফিসে গেছে।

বিজ্ঞাপন



মৌলভীবাজার জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো: রাসেল জানান আহমদ জানান,  জামাত-শিবিরের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নামে এবং সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে সরকার দলের নেতদের সাথে ও প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সুকৌশলে সখ্যতা গড়ে তোলেছে মেরাজ। সামাজিক সংগঠনের নামে-বেনামে সে দেশি-বিদেশি অসংখ্য ব্যক্তির কাছ থেকে লক্ষ-লক্ষ টাকা অনুদান সংগ্রহ করেছে।

তিনি বলেন, যেখানে আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে কর্মীরা দাঁড়াতে পারে না সেখানে মেরাজ চৌধুরী পাশে বসে খোশগল্প করে এবং প্রায় সকল সরকারি ও প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এবং দলীয় নানা অনুষ্ঠানে সামনের সাড়িতে বসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়।  

জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আমিরুল ইসলাম আমিন জানান, সে প্রতারণার মাধ্যমে আওয়ামীলীগের সাথে মিশেছে। আমরা জানতামনা সে ছাত্রশিবিরের সাথী। তার পুরাতন অনেক পোষ্ট দেখেছি যেখানে জাতির পিতাকে অপমান করে পোষ্ট দিয়েছে। দেশের আইনে জাতির পিতাকে অপমান এবং প্রতারণার জন্য তার বিচার দাবী করছি। এবং এই বিষয়ে আমরাও পদক্ষেপ নেব।

এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে চৌধুরী মুহাম্মদ মেরাজ বলেন, আমি আগে যা করেছি তখন বয়স কম ছিল বন্ধুবান্ধবের সাথে গিয়েছি তখন অনেক কিছুই বুঝতাম না। আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে অপপ্রচারের পর আওয়ামী লীগের অনেক নেতা আমাকে বলেছেন- 'তুমি চিন্তা কর না, তুমি ভাল কাজ করছ তাই হিংসা করা হচ্ছে।'

টাকা আত্মসাত বা বিভিন্ন ভাবে প্রবাসীদের কাছ থেকে টাকা আনার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অভিযোগ যে কেউ করতে পারে কিন্তু প্রমাণ কেউ দিতে পারবে না। এইসব মিথ্যা। ভুক্তা অধিকারের কর্মকর্তা পরিচয় দেওয়ার বিষয়ে বলেন, আমি ক্যাবের সদস্য। হয়তো সে পরিচয় দিয়েছি। খারাপ কোন উদ্দেশ্যে কোন পরিচয় দেইনি। আমার বিরুদ্ধে যা বলা হচ্ছে সব অভিযোগ মিথ্যা, কেউ এর প্রমাণ দিতে পারবে না।

মুজিববর্ষের অনুষ্ঠান সহ প্রশাসনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মেরাজের উপস্থিতি প্রসঙ্গে মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক নাজিয়া শিরিন বলেন, আমাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান থাকে সেখানে অনেকেই আসে। আমরা কখনো তাকে দাওয়াত দিয়ে আনিনি। তিনি দাওয়াত ছাড়াই নিজে থেকে এসেছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি থাকে চিনিও না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত