নিজস্ব প্রতিবেদক

০৭ জুলাই, ২০২০ ০১:০০

সিলেটে সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সঙ্কট, বেসরকারিতে উচ্চ ব্যয়

বিপাকে করোনা আক্রান্ত রোগীরা

ফাইল ছবি

সোমবার (৬ জুলাই) পর্যন্ত সিলেট বিভাগে করোনা শনাক্ত হয়েছে ৫৩৭২ জনের। আর সিলেট জেলায় এই সংখ্যা ২৮৭৫ জন। এরমধ্যে পুরো বিভাগে হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৮২২ জন। সিলেট জেলায় এ সংখ্যা ৩২৭। শারিরীক অবস্থার অবনতি হলেই হাসপাতালে ভর্তি হন করোনা আক্রান্তরা। এদের অনেকেরই প্রয়োজন হয় নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র (আইসিইউ) সেবার।

তবে সিলেটে করোনা চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট করা একমাত্র শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে আইসিইউ বেড আছে মাত্র ১৪টি। ফলে প্রয়োজনেও অনেকে পাচ্ছেন না আইসিইউ সেবা। সিলেটে দুটি বেসরকারি হাসপাতাল করোনা রোগীদের চিকিৎসা শুরু করেছে। এসব হাসপাতালে রয়েছে আইসিইউ সুবিধা। তবে বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউয়ের খরচ পড়ে প্রচুর। যা সাধারণের নাগালের অনেকটাই বাইরে। ফলে প্রয়োজনেও আইসিইউ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এই বিভাগের বেশিরভাগ রোগী। এতে বাড়ছে মৃত্যু হারও। সোমবার সকাল পর্যন্ত সিলেট বিভাগে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৮৯ জন। করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন আরও অধিক।

৭৫ বছর বয়সী সৈয়দ শফিকুল আলম হৃদরোগ এবং জ্বর নিয়ে গত ১১ জুন ভর্তি হন সিলেটের বেসরকারি নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনাভাইরাস রোগীদের জন্য নির্ধারিত ওয়ার্ডে।

বিজ্ঞাপন



পরদিন তার অবস্থা খারাপ হলে তাকে নেয়া হয় কোভিড-১৯ আক্রান্ত ও সন্দেহভাজনদের জন্য নির্ধারিত নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ)। এখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৪ জুন মৃত্যুবরণ করেন তিনি। পরদিন জানা যায় যে তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন।

তার নাতি ফখরুল আলম জানান একদিন সাধারণ ওয়ার্ড এবং দুদিন আইসিইউতে চিকিৎসা খরচ এবং ওষুধ বাবদ খরচ লাখ টাকা ছাড়িয়েছে।

হবিগঞ্জের নবীগঞ্জের সৈয়দ শফিকুল আলমের পরিবারের এ সামর্থ্য থাকলেও খুব কম মানুষের পক্ষেই এই বিপুল ব্যয় বহন সম্ভব।

গত ৮ জুন সিলেটের বেসরকারি হাসপাতালে কোভিড-১৯ চিকিৎসা সংক্রান্ত এক সংবাদ সম্মেলনে জেলার বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়গনস্টিক সেন্টার মালিক সমিতির সভাপতি ডা. নাসিম আহমেদ সাধারণ রোগীদের জন্য বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয়বহুল জানিয়ে সরকারি হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেন।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, পুরো সিলেট বিভাগে কোভিড রোগীদের জন্য ডেডিকেটেড ৪৬টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ৩২টিই বেসরকারি হাসপাতালে। এর মধ্যে নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০টি এবং মাউন্ট এডোরা হাসপাতালের ১২টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। সরকারি হাসপাতালের মধ্যে মাত্র ১৪টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে।

কোভিড-১৯ ভিন্ন সাধারণ রোগীদের চিকিৎসায় সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৫টি এবং অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতালের প্রায় ৪০টির মতো আইসিইউ শয্যা রয়েছে। এগুলোর সবই সিলেট নগরীতে অবস্থিত। বিভাগের বাকি তিন জেলার কোথাও, এমনকি হবিগঞ্জের শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও নেই আইসিইউ সুবিধা।

সিলেটে করোনা রোগীদের চিকিৎসা প্রদান করছে বেসরকারি নর্থ ইস্ট মেডিকেল খরেজ হাসপাতাল এবং মাউন্ট এডোরা হাসপাতাল।

মাউন্ড এডোরা হাসপাতালের এক কর্মকর্তা জানান, এই হাসপাতালে একজন করোনা রোগী আইসিইউতে একদিন থাকলে প্রায় ২৪ হাজার টাকা বিল আসে। এরমধ্যে শয্যা ভাড়া, অক্সিজেন, ওষুধ, চিকিৎসকের বিল ও সার্ভিস চার্জসহ আনুসাঙ্গিক খরচ যুক্ত রয়েছে। তবে রোগীভেদে এই খরচের পর পরিমাণ বাড়তে পারে। যেসব রোগীর অক্সিজেন ও ওষুধ বেশি লাগবে তাদের খরচও বাড়বে।

একই ধরণের চার্জ আসে নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও।

বিজ্ঞাপন



সম্প্রতি  মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার বাসিন্দা ৭০ বছর বয়সী এক নারী স্ট্রোক করলে স্বজনরা তাকে প্রথমে শ্রীমঙ্গল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং পরে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে যান।

তার আত্মীয় মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘চিকিৎসকরা দ্রুত আইসিইউতে নেওয়ার পরামর্শ দিলে আমরা সিলেট আসি। কিন্তু এখানে সাতটি বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরেও তাকে কোথাও ভর্তি করতে পারিনি। কোথাও বলেছে আইসিইউ নেই, কোথাও করোনাভাইরাস আক্রান্ত সন্দেহে ভর্তি করতে চায়নি। এমনকি একটা অক্সিজেন সিলিন্ডারও দেয়নি কেউ।’

সেই রাতে শেষ পর্যন্ত তাকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।

মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘যদি মৌলভীবাজারে আইসিইউ থাকতো, তাহলে তাকে এতটা সময় নষ্ট করে সিলেট আনতে হতো না, এবং হয়তো তাকে বাঁচানো যেত’,

সিলেট বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক কার্যালয়ের সহকারি পরিচালক ডা. আনিসুর রহমান বলেন, ‘এই মুহূর্তে চাইলেও সিলেট বিভাগের অন্য কোনো জেলায় আইসিইউ শয্যা বাড়ানোর সুযোগ নেই, কারণ দক্ষ অ্যানেস্থেসিয়োলজিস্ট ও অন্যান্য লোকবলের সংকট রয়েছে।’

করোনা আক্রান্ত রোগীদের আইসোলেশন সেন্টার হিসেবে চালু হওয়া খাদিমনগর ৩১ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে নেই আইসিইউ শয্যা।

ওসমানী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. আ ফ ম নাজমুল ইসলাম বলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে অন্তত ৫ ভাগ রোগী গুরুতর অসুস্থ হন এবং মোট রোগীর প্রায় ২ ভাগকে আইসিইউতে নেওয়ার প্রয়োজন হয়।

এদিকে সিলেটের কোভিড-১৯ সেবায় নির্ধারিত বেসরকারি হাসপাতালের ৩২টি আইসিইউয়ের প্রায় সবকয়টিতে প্রতিদিন রোগী ভর্তি থাকছে। শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালের আইসিইউ শয্যাও খালি পাওয়া দুষ্কর।

স্বাস্থ্য বিভাগ ও বেসরকারি হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যমতে, বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ শয্যার সবকয়টিতে ভেন্টিলেটর সুবিধা নেই।

সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলন, সিলেটের সমন্বয়ক আব্দুল করিম কিম বলেন, ‘করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর প্রথম পর্যায়েই সরকারের উচিত ছিলো আইসিইউ শয্যা ও দক্ষ জনবল বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া।’

তিনি বলেন, ‘বিত্তশালীরা তবুও কিছু সংখ্যক হলেও বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ ব্যবহার করতে পারবেন, কিন্তু সাধারণ নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষ কোথায় সেবা পাবে? সরকারের উচিত, এখনই সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ শয্যার সংখ্যা বাড়ানো।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত