দেবকল্যাণ ধর বাপন

১০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০১

দোরগোড়ায় দুর্গাপূজা, তবু অর্ডার পাচ্ছেন না প্রতিমাশিল্পীরা

দুর্গাপূজার আর মাস দেড়েক বাকী। ২২ অক্টোবর থেকে শুরু হবে হবে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গা পূজা। প্রতিবছর এই সময়ে প্রতিমা নির্মাণে ব্যস্ত থাকেন সিলেটের প্রতিমা শিল্পীরা। এমন সময়ে দম ফেলবার ফুসরত থাকে না তাদের। তবে এবারের চিত্র ভিন্ন।

করোনাসঙ্কটের কারণে এবারের ব্যবসাবাণিজ্যে ধস নেমেছে। মানুষজনও অর্থসঙ্কটে। পূজাও পালন করতে হবে নানা বিধি নিষেধ মেনে। ফলে অনেকেই কাটছাট করেছেন পূজার বাজেটে। প্রতিমা নির্মাণেও পড়েছে তার প্রভাব। এতে বিপাকে পড়েছেন সিলেট অঞ্চলের প্রতিমা শিল্পীরা। পূজা ঘনিয়ে আসলেও এখনো তেমন অর্ডার পাননি তারা। ফলে বড় ধরণের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছেন প্রতিমা শিল্পীরা।

দুর্গাপূজার জন্য সারাবছর অপেক্ষায় থাকেন প্রতিমাশিল্পীরা। এই সময়েই তাদের ব্যবসা জমে ওঠে। বড় বড় মুর্তির অর্ডার আসে। তাই বৈশাখ থেকেই শুরু হয় প্রতিমা নির্মাণের তোড়জোড়। কিন্তু এবার করোনাভাইরাস সব ওলটপালট করে দিয়েছে। করোনার কারণে এবার দোলাচলে পূজার উদ্যোক্তারাও।


হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচংয়ের প্রতিমাশিল্পী অঞ্জন পাল সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোরকে বলেন, অন্যান্য বছরের এই সময়ে আমাদের দম ফেলবার ফুসরত পেতাম না। তবে এবছর এখন পর্যন্ত প্রতিমা তৈরির তেমন বয়না আসেনি। এখন পর্যন্ত মাত্র দুটো প্রতিমা তৈরির অর্ডার পেয়েছি। অন্যান্য বছর এরকম সময়ে ১০ থেকে ১৫টি বড় বড় প্রতিমা তৈরির অর্ডার চলে আসতো। তিনি বলেন, এমন মন্দা চললে সংসার নিয়ে পথে বসতে হবে।

গত চৈত্র মাস (মার্চ) থেকেই এমন মন্দা চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, বাসন্তীপূজা, শিবপূজা, গণেশপূজা ও মনসাপূজাসহ সকল পূজাতেই আমরা প্রতিমা তৈরি করে রেখেছিলাম। কিন্তু এবার জাকজমকভাবে এসব পূজা না হওয়াতে কেউ আমাদের কাছ থেকে প্রতিমা কিনেননি। প্রতিমাগুলো এখানে থেকে থেকে নষ্ট হচ্ছে। ফলে প্রচুর টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। বর্তমানে স্ত্রী-সন্তান ও পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেক কষ্টের মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছি। দূর্গাপূজার এই মৌসুমেও যদি এভাবে চলতে থাকে তাহলে না খেয়ে মরা ছাড়া কোনো পথ দেখছি না।

একই কথা জানালেন সিলেটের প্রতিমাশিল্পী সাগর পালও। তিনি সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোরকে বলেন, যেখানে চৈত্র মাস থেকে আমরা প্রতিমা বানানোর কাজ শুরু করি সেখানে এ বছর এখনও হাত গুটিয়ে বসে রয়েছি। করোনার কারণে কেউই আমাদের সাথে যোগাযোগ করেননি। তাই ভরসাও পাচ্ছি না প্রতিমা তৈরি করার। শেষ হয়ে যাওয়া বাসন্তীপূজা, শিবপূজা, গণেশপূজা ও মনসাপূজায় প্রতিমা কিছু তৈরি করলেও কারিগর খরচ ও অন্যান্য সকল খরচ মিলিয়ে কোনো লাভ করতে পারিনি। পরিবার চালাতে হচ্ছে জমানো টাকা ভেঙে।

বিজ্ঞাপন



তিনি আরও বলেন, এ বছর আমি ব্যক্তিগতভাবে ৮ থেকে ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। এছাড়া প্রথম দিকে কারিগরদের অগ্রিম বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম, যাতে সময়মতো কারিগর পেতে সমস্যা না হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত পূজার প্রতিমার বায়না না পেয়ে কারিগররাও তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।

সিলেট বিভাগে গতবছর প্রায় ২ হাজার ৫৪৫টি সার্বজনীন দুর্গাপূজা হয়। এর বাইরে পারিবারিক পূজাও হয়েছে কয়েকশ’। ‍প্রতিবছর এ সকল পূজার উপরই নির্ভর করে থাকেন শিল্পী, কারিগর ও প্রতিমাশিল্পীরা। তবে বর্তমানে করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়েছে বিভাগের সকল কুমোরটুলিতে। এমন পরিস্থিতিতে সংসার কিভাবে চলবে সে নিয়ে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে সিলেটের প্রতিমা শিল্পীদের কপালে।

এ ব্যাপারে কথা হয় সিলেট নগরীর মাছুদিঘীর পারস্থ ত্রিনয়নী সার্বজনীন পূজা কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব পালের সাথে। তিন বলেন, করোনাভাইরাসের প্রভাবের কারণে এ বছর আমরা পূজা করতে যাচ্ছি সরকারের ২৬টা নির্দেশনা মেনেই। প্রতিবারের মতো এবার আর আমরা প্রতিমা ও প্যান্ডেল এতো বড় করবো না। শুধু নিয়ম রক্ষার্থেই  পূজা করবো।

পূজার অনুষ্ঠানমালা এবার শুধু ধর্মীয় রীতিনীতি অনুসরণ করে পূজা-অর্চনার মাধ্যমে মন্দির প্রাঙ্গণেই সীমাবদ্ধ থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন, এ বছর বাজেটেও কিছু ঘাটতি রয়েছে। কেননা আমাদের পূজার অর্থের অনেকটা যোগান আসতো চাঁদা সংগ্রহ করে। তবে এবার করোনাভাইরাসের কারণে চাঁদা সংগ্রহ থেকে আমাদের সদস্যের বিরত রেখেছি। তাই পূজা-অর্চনার বাইরে আমরা তেমন কিছুই আর করছি না। ফলে এবারের প্রতিমাও আগের মতো জমকালো হবে না।

নির্দিষ্ট সময়ে প্রতিমা তৈরির কাজ না দেওয়ায় কষ্টে রয়েছেন মৌলভীবাজারের বিভিন্ন উপজেলার প্রতিমাশিল্পীরাও। তেমনই একজন শঙ্কর পাল। তিনি বলেন, বৈশাখ মাসের শুরু থেকে বিভিন্ন পূজার প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু হয়। দুর্গা প্রতিমা তৈরির কাজ আসতো তিন-চার মাস আগেই। কিন্তু এ বছর এখনো কোনো কাজ নেই। করোনার কারণে অনেক কারিগরও চলে গেছেন বাড়িতে। এখন নিজেরাই কিছু প্রতিমা তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছি। কারণ যদি শেষ সময়ে প্রতিমার অর্ডার আসে তাহলে গড়ে দিতে অনেক সময় লাগবে।

কিছুটা আশার কথা শোনালেন হাওর বেষ্টিত সুনামগঞ্জ জেলার প্রতিমাশিল্পী কৃষ্ণ আচার্য।  তিনি বলেন, দুর্গাপূজায় এখন পর্যন্ত প্রতিমার কোনো বায়না ও অর্ডার না পেলেও আমি আশাবাদী ভালো অর্ডার পাবো।

২২ অক্টোবর সন্ধ্যায় ষষ্ঠী পূজার মাধ্যমে শুরু হবে দূর্গোৎসব। ২৩ অক্টোবর সপ্তমী, ২৪ অক্টোবর মহাষ্টমী, ২৫ অক্টোবর নবমী ও ২৬ অক্টোবর বিজয়া দশমীতে বিসর্জনে শেষ হবে দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা।

গত ২৬ আগস্ট (বুধবার) সারাদেশে পূজা উদযাপন পরিষদ, মন্দির ও পূজা কমিটির কাছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পূজার আয়োজন সংক্রান্ত ২৬ দফা নির্দেশনা পাঠিয়েছেন পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। সেই নির্দেশ মেনে এই করোনা মহামারির সময়ে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হবে।

বিজ্ঞাপন



এ ব্যাপারে পূজা উদযাপন পরিষদের সিলেট মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক রজত কান্তি গুপ্ত সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোরকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমরা বিভাগের জেলা, উপজেলাগুলো থেকে পূজামণ্ডপের পুরো তালিকা পাইনি। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পূজার আয়োজন সংক্রান্ত ২৬ দফা নির্দেশনা পাঠিয়েছে সকল জেলা পাঠিয়েছি জেলা, উপজেলাগুলোতে। তবে গতবারের থেকে এ বছর কিছু পূজা কমতে পারে বলে আমার ধারনা।’

তিনি আরও বলেন, ‘এ বছর কোনও উৎসব হবে না। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মেলা বন্ধ থাকবে। মণ্ডপে আলোকসজ্জা, সাজসজ্জা, আরতি প্রতিযোগিতা, আতসবাজি ও পটকা ফাটানো থেকে বিরত থাকতে হবে। এছাড়া ভক্তিমূলক সংগীত ছাড়া অন্য কোনও গান না বাজানো, পূজামণ্ডপে দীর্ঘসময় দর্শনার্থী যেন না থাকে এবং সন্ধ্যার বিরতির পর দর্শনার্থীদের প্রবেশে নিরুৎসাহিত করা, ‘সন্দেহভাজন’ দর্শনার্থীর দেহ তল্লাশির ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হয়েছে নির্দেশনায়। এছাড়া বয়স্কদের মন্দির প্রাঙ্গণে না আসতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।’

রজত কান্তি গুপ্ত আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের ২৬ দফা নির্দেশনার মধ্যে প্রতিমা তৈরি থেকে পূজা শেষ হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেক মন্দিরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ভক্ত-পূজারি ও দর্শনার্থীদের জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা রাখা, সকলে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরা, দর্শনার্থীদের মধ্যে নূন্যতম তিন ফুট শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, পূজামণ্ডপে নারী-পুরুষের যাতায়াতের আলাদা ব্যবস্থা করা, পূজামণ্ডপে সিসি ক্যামেরা রাখা, নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক রাখা, প্রতিমা নিরঞ্জনে শোভাযাত্রা পরিহার করার কথা বলা হয়েছে। এসব নির্দেশনা মেনে আমরা পূজার আয়োজন করছি।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত