নিজস্ব প্রতিবেদক, নবীগঞ্জ থেকে ফিরে

১৪ জানুয়ারি, ২০২১ ০২:১৬

ভোট ছাপিয়ে উন্নয়ন না হওয়ার ক্ষোভ নাগরিকদের কন্ঠে

নবীগঞ্জ পৌরসভা

আউশকান্দি-হবিগঞ্জ সড়ক দিয়ে নবীগঞ্জ শহরে প্রবেশ করতেই টের পাওয়া গেল, পৌরসভায় নির্বাচন কড়া নাড়ছে। চোখে পড়ল বাসাবাড়ি, দোকান, সীমানাপ্রাচীর, গাছপালায় সাঁটানো পোস্টার। নবীগঞ্জ বাজার থেকে শুরু করে শহরের স্থানীয় বাজারগুলোতে আকাশ আড়াল করে ঝুলছিল নির্বাচনী পোস্টার। পৌরসভার গ্রাম ও পাড়ার একই চেহারা। একটা ভিন্ন আমেজ তৈরি করেছে। দুপুর দুটা বাজতেই মাইকে প্রার্থী ও প্রতীকের গুনগানে বাতাস ঝনঝন করে বাজতে থাকে।

তবে ভোটের আলোচনায় প্রার্থী ও প্রতীকের বিষয়টি ছাপিয়ে অনেক জায়গায় ভাঙা ও সরু সড়ক, জলাবদ্ধতার সংকট নিরসন, মশার উপদ্রব, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পর্যাপ্ত সড়ক বাতি না থাকার ক্ষোভই বড় হয়ে উঠেছে।

শহরের হাসপাতাল সড়কের পাশের একটি দোকানে পুরোনো ঢাকঢোল মেরামত করছিলেন কয়েকজন। শীত মৌসেমে বিভিন্ন এলাকায় সনাতন (হিন্দু) সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠান বেশি তাকে। করোনা মহামারীর এই সময়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আড়ম্বরতায় কিছু বিধিনিষেধ থাকায় দুশ্চিন্তায় আছেন এই কারিগররা। কিছু জায়গা থেকে অর্ডার আসায় কাজ করছিলেন তারা।

দোকানে ঢাক-ঢোলের জন্য খোল তৈরি, রং করা, চামড়া লাগানো এবং পুরোনো ঢোল মেরামতের কাজ করছিলেন কানাই ঋষি। তিনি জানান, আগে দিন-রাত কাজ করেও অনেক বাদ্যযন্ত্র জমে যেত। বছরের অন্য সময়ে এত ব্যস্ততা না থাকলেও শীতের মৌসুমে ও দূর্গাপূজার সময় কাজ বেড়ে যেত। কিন্তু এ বছর করোনার কারণে তেমন কাজ নেই।

কানাই ঋষির সঙ্গে পৌরসভার ভোটের প্রসঙ্গে কথা বলতেই তিনি বলেন, ‘আমি ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। সামনের যে রাস্তা দেখছইন। মেইন রোড। ড্রেন নাই। বৃষ্টির সময় রাস্তা ডুবে যায়। পানি জমে কষ্ট হয়। পৌরসভাটা প্রথম শ্রেণির হয়েছে কত বছর হয়েছে। কিন্তু আমরা নাগরিকরা প্রথম শ্রেণীর হইনি। মেয়র আসে, মেয়র যায়। আমরার লাভ নাই।’

এই দোকোনে কথা হয় বাদ্যযন্ত্র তৈরির আরেক কারিগর রাম কৃষ্ণের সাথে। পৌরসভায় থাকার সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে কথা উঠতেই রাম বলেন, ‘আমারা ভোটই দেই। ভাগ্য পরিবর্তন হয় না। ট্রেড লাইসেন্স বাড়াইছে। ব্যবসা নাই ঠিক মতো। এরমধ্যে ট্যাক্সের বোঝা।’

গয়াহরি গ্রামের সড়কের পাশে দোকানে বসে আছেন শেলী দাস। স্বামীর বাজারে গেলে তিনি দোকানে বসেন। ভোটের প্রসঙ্গ তুলতেই বলেন, ‘আমরা মহিলা মানুষ। রাজনীতি করি না। ভোট নিয়া চিন্তাও নাই। আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। স্বামী যেনো ভোট দিবার কইবা তানোরে ভোট দিমু।’

গয়াহরি থেকে চরগাঁও এলাকার দিকে যাবার সময় রিকশায় কথা হচ্ছিল চালক আল-আমিনের সাথে। আল-আমিন বলেন, ‘বর্তমান মেয়র কিছু উন্নয়ন করছইন। কিন্তু তানোর তো দল ক্ষেমতায় (ক্ষমতায়) নায়। তবে আরও উন্নয়ন করা দরকার ছিল।’

আল-আমিন জানালেন, চরগাঁও এলাকা সংলগ্ন খালসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় এখনো সাঁকো দিয়ে মানুষকে খাল পাড়ি দিতে হয়। চাইলে দেখা পারব। এটা বলেই তিনি রিকশা ঘুরিয়ে চরগাঁও খাল পারের দিকে নিয়ে গেলেন। সেখানে গিয়ে তার কথার সাথে মিল পাওয়া গেল।

এখান থেকে চরগাঁও ঘুরে দেখা গেল শাখা বরাকের খালসহ বেশ কয়েকটি স্থানে যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলা হয়। সরু রাস্তা। শহরের বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় সড়ক, ডাকবাংলো সড়কের ব্রিজের গোড়া, হাসপাতাল এলাকার অদূরের শাখা বরাকের খাল ও রুদ্রগ্রাম সড়কের শিবপাশা ব্রিজের গোড়া ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাখতে দেখা গেল। এসব এসব আবর্জনার পচা দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। পথচারীরা চলাচল করছেন নাকে কাপড় ঢেকে। একই চিত্র দেখা গেছে হবিগঞ্জ-নবীগঞ্জ সড়কের শান্তিপাড়া, নবীগঞ্জ-শেরপুর সড়কের ১ নম্বর ব্রিজ এলাকায়ও। এছাড়া উপজেলা পরিষদের ডরমেটরীর পাশেও ময়লা আবর্জনা দেখা গেছে।

শিবপাশা এলাকায় কথা হয় আব্দুল হামিদের সাথে। তিনি বলেন, ‘আমরার বড় সমস্যা ময়লা-আবর্জনা। মশার উপদ্রব। কয়েক বছর ধরে এই দুর্ভোগ পোহাইরাম। কিন্তু দেখার কেউ নেই। কিন্তু ট্যাক্স নেওয়ার সময় তো মাফ নেই। ইবার বুঝিয়া ভোট দিমু।’

এই এলাকার সড়ক দিয়ে প্রতিদিন রিকশা চালান মোহাম্মদ আলী। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন রাস্তা দিয়া পেসেঞ্জার নিয়া যাই। রাস্তার কান্দাত ময়লা থাকায় খারাপ গন্ধ বাইরয় (গন্ধ ছড়ায়)। ওই এলাকা দিয়ে যাওয়া কষ্টকর।’

শহরের ওসমানী রোড হয়ে গন্ধা এলাকার একটি চা-স্টলে বসেছিলেন কয়েকজন। ভোটের প্রসঙ্গ উঠতেই আব্দুস সহিদ নামের একজনের কন্ঠে ক্ষোভ ঝরল। তিনি বলেন, ‘রাত অইজাউক (রাত হোক) তখন বুঝবা কি এলাকাত আছি। সারাটা এলাকা আন্দাইর অই-যা (অন্ধকার হয়)।’

আমরার অবস্থা অইল এমন ‘‘কাইয়া দইয়া লইছি ঘর, আতরা থাকি করি নমস্কার’’।

বিষয়টি পরিস্কার হওয়ার জন্য আবার প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘সড়কে লাইট (বাতি) নাই। রাস্তা আন্দাইর (অন্ধকার) থাকে রাতে। ভয় লাগে। পৌরসভা তে অন্ধকার কেনো।’

তার কথা কেড়ে নিয়ে আবুল হোসেন বলেন, ‘পৌরসভায় থাকলে কী অইবো। ইউনিয়ন থাকি উন্নত হওয়ার কথা। কিন্তু পাঁচ বছরে কোনো উন্নয়ন অইছে না। রাস্তা ভাঙা। আমরার এলাকায় কোনো ড্রেন নাই। ভোট আইছে। অনেকেই এখন আইরা। ভোট গেলে আর খবর পাওয়া যাইত না।

মায়ানগর এলাকায় কথা হয় নূরুল আমির সাথে। বাজারে যাচ্ছিলেন। নূরুল আমিন বলেন, ‘২০ বছরেও তো কোনো উন্নয়ন নাই। ৫ বছর তো একজন আছলা, দেখলাম। কাম (কাজ) কিতা করলা। আমরারে তো কেউ বাড়িত আনিয়া ভাত খাওয়ায় না। উন্নয়ন চাই। কিন্তু উন্নয়ন নাই। ই-বার ভোট দিলে বুঝিয়া দিমু।’

তবে ২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আব্দুল কুদ্দুস জানালেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, ‘অন্যান্য মেয়রদের থেকে বর্তমান মেয়রের সময় কিছুটা উন্নয়ন করেছেন।’

পৌরসভা ও স্থানীয় সূত্রে জানা, ১৯৯৭ সালে গঠিত হয় নবীগঞ্জ পৌরসভা। ২০০৫ সালে তৃতীয় থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত হয়। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে দ্বিতীয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত হয়। প্রথম শ্রেণীর এ পৌরসভার আয়তন ৯ দশমিক ৭ কিলোমিটার। পৌর এলাকায় রয়েছে ৩টি হাটবাজার, ১টি কসাইখানা, ৪২ কিলোমিটার পাকা রাস্তা, ইট সলিং রাস্তা ৮.১ কিলোমিটার, কাঁচারাস্তা ৩.৯ কিলোমিটার। এছাড়াও পাঁকা ড্রেন রয়েছে ৬ কিলোমিটার, কাঁচা ড্রেন ৪.১ কিলোমিটার, সড়কবাতি আছে ৫০০টি। বর্তমানে মোট ভোটার সংখ্যা ১৮ হাজার ৭৭৭। কিন্তু প্রথম শ্রেণীর এ পৌরসভায় গত প্রায় ৮ বছর থেকে শহরের ময়লা-আবর্জনা ফেলার জন্য কোনো নির্দিষ্ট স্থান করা হয়নি। এর কারণে প্রতিদিন পৌরসভার গাড়িতে ভরে ময়লা এনে হবিগঞ্জ-নবীগঞ্জ সড়কের শান্তিপাড়া, নবীগঞ্জ-শেরপুর সড়কের ১ নম্বর ব্রিজের গোড়া ও খালে ফেলছেন পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। পাশাপাশি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় সড়ক, ডাকবাংলো সড়কের ব্রিজের গোড়া, হাসপাতাল এলাকার অদূরের শাখা বরাকের খাল ও রুদ্রগ্রাম সড়কের শিবপাশা ব্রিজের গোড়া ময়লা-আবর্জনা ফেলা হয়।

প্রসঙ্গত, দ্বিতীয় ধাপে আগামী ১৬ জানুয়ারি এই পৌরসভায় ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এখানে আওয়ামী লীগের গোলাম রসুল চৌধুরী রাহেল, বিএনপির ছাবির আহমদ চৌধুরী ও স্বতন্ত্র মাহবুবুল আলম সুমন মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন। সাধারণ কাউন্সিলর পদে ৪১ জন ও নারী কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন ৯জন। ৯টি ওয়ার্ডের ১০টি কেন্দ্রের ৪৮টি বুথে ভোট নেওয়া হবে। মোট ভোটার ১৮ হাজার ৭৭৭।

ঘুরতে ঘুরতে রাত ৮টা হয়েছে গেছে। প্রার্থীদের প্রচারের মাইকও বন্ধ করার সময় হয়েছে। প্রচার মাইকের গাড়িগুলোর গন্তব্য প্রার্থীদের নির্বাচনী কার্যালয়।

 

আপনার মন্তব্য

আলোচিত