নিজস্ব প্রতিবেদক

১৪ জানুয়ারি, ২০২১ ২৩:৫৯

দুই দশক ধরে কুলাউড়ায় অধরা নৌকার বিজয়!

২০০১ থেকে ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচন, ২০১৫ সালের পৌর ও সবশেষ ২০১৯ সালের উপজেলা পরিষদের নির্বাচনেও মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর বিজয় অধরাই রয়ে গেছে। এবার ১৬ জানুয়ারির পৌর নির্বাচনে কি নৌকা প্রতীকের প্রার্থী জয় ছিনিয়ে আনতে পারবেন? নাকি এবারও নৌকার বিজয় অধরা থাকবে? এমন নানা প্রশ্ন আর আলোচনা এখন চায়ের দোকান, আড্ডা থেকে শুরু করে সব জায়গায়।

সম্প্রতি কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল ইউনিয়ন পরিষদের উপ-নির্বাচনেও চেয়ারম্যান পদে নৌকার প্রার্থীর ভরাডুবি হয়েছে। এখানে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং বিদ্রোহী প্রার্থীর কারণে নৌকার চেয়ারম্যান প্রার্থীকে পরাজিত হতে হয়েছে। পৌর নির্বাচনেও নৌকার বিজয়ে নিয়ে আশঙ্কা আরও প্রকট হয়েছে। দলীয় নেতাকর্মী ও একাধিক সূত্রের দাবি দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল, বিদ্রোহী ঢেউয়ে পৌরসভা নির্বাচনে নৌকার ডুবতে পারে।

দলীয় নেতাকর্মী ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে সংসদ নির্বাচনে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও বর্তমান জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত সাংসদ সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ নৌকা প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হন। এরপর ২০০১ সালে তিনি নৌকা প্রতীক নিয়েও স্বতন্ত্র প্রার্থী এম এম শাহীনের কাছে পরাজিত হন। ওয়ান ইলেভেনের পট পরবর্তী সময়ে ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী নওয়াব আলী আব্বাসের কাছে নৌকা প্রতীক নিয়ে আসা অ্যাডভোকেট আতাউর রহমান শামীমের ভরাডুবি হয়। ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে এ আসনে নৌকা প্রতীকের কোনো প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরে সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কোনো নেতা নৌকার মনোনয়ন পাননি। এই নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন বঞ্চিত এমএম শাহীন বিকল্পধারায় যোগ দিয়ে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়েও আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাসিত ঐক্যফ্রন্টের ধানের শীষের প্রার্থী সুলতান মো. মনসুর আহমদের কাছে পরাজিত হন।

এদিকে বর্তমান উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান একেএম সফি আহমদ সলমান ২০১৫ সালের ৩০ ডিসেম্বরের পৌর নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের মনোনীত হেভিওয়েট প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হন বর্তমান মেয়র আলহাজ্ব শফি আলম ইউনুছ। ওই নির্বাচনে বিএনপির ধানের শীষের প্রার্থী ২য় অবস্থানে এবং নৌকার প্রার্থী তৃতীয় অবস্থানে ছিলেন। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রকাশ্য কোন্দলে রূপ নেয়। যার আঘাত ২০১৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নৌকার ওপর গিয়ে পড়ে।

২০১৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন যুব বিষয়ক সম্পাদক ও বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আসম কামরুল ইসলাম নৌকা প্রতীক নিয়েও তৎকালীন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং বর্তমান জ্যেষ্ঠ সহ সভাপতি বিদ্রোহী (স্বতন্ত্র) প্রার্থী অধ্যক্ষ একেএম সফি আহমদ সলমানের কাছে বিপুল ভোটে পরাজিত হন।

২০২১ সালের ১৬ জানুয়ারির পৌর নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন চান বর্তমান মেয়র আলহাজ্ব শফি আলম ইউনুছ, জেলা শ্রমিকলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ সিপার উদ্দিন আহমদ ও শফিউল আলম শফি। দলের কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ড পৌর নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হিসেবে অধ্যক্ষ সিপার উদ্দিন আহমদকে মনোনীত করেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলের একাধিক নেতাকর্মীর দাবি, নিজেদের কোন্দল ও দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে গিয়ে অনেকটা কৌশলে বিদ্রোহীর পক্ষে কাজ করায় সাধারণ ভোটাররাও দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। এছাড়া অতীতে অনেকটা আনকোরা ও ভিন্ন দল থেকে আসা প্রার্থীকে এখানে নৌকা কিংবা মহাজোটের প্রার্থী মনোনীত করায় নেতাকর্মীরাও হতাশ হয়ে পড়েন। এসব কারণে স্্েরাতের বিপরীত প্রার্থীর জয় হয় আর সেই স্রোতে নৌকার বিজয় তলিয়ে যায়।

সিপার উদ্দিন আহমদ সমর্থক ও দলীয় নেতাকর্মীদের দাবি, রাজনৈতিক ক্লিন ইমেজ এবং কর্মীবান্ধব নেতা হিসেবে দল সিপার উদ্দিন আহমদকে নৌকা প্রতীকে প্রার্থী মনোনীত করেছে। দলীয় কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি ক্রীড়া ও সামাজিক অঙ্গণে জনপ্রিয় সিপার উদ্দিন আহমদ। পৌর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গত বছর দুয়েক আগ থেকেই সাধারণ জনগণের পাশাপাশি থেকে কাজ করে যাচ্ছেন। করোনার লকডাউনেও অসহায় কর্মহীন মানুষের কাছে ছুটে গেছেন সহযোগিতা নিয়ে। এদিক দিয়ে তিনি অনেকটা এগিয়ে। তার হাত ধরেই হয়তো নৌকার দীর্ঘদিনের অধরা ও কাঙ্খিত বিজয় আসতে পারে।

দলীয় সূত্রে আরও জানা গেছে, প্রথমবারের মতো নৌকা মার্কা নিয়ে নির্বাচনে লড়ছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সিপার উদ্দিন আহমদ। অপরদিকে, তৃতীয় বারের মতো মেয়রপদে নির্বাচন করছেন বর্তমান মেয়র ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী শফি আলম ইউনুছ। তিনি আওয়ামী লীগ উপজেলা কমিটির সদস্য ছিলেন। বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় ইতোমধ্যে শফি আলম ইউনুছের সদস্যপদ বাতিল করেছে উপজেলা আওয়ামী লীগ।

তবে সচেতন ভোটারদের দাবি, দলীয় কোন্দল ও বিদ্রোহী প্রার্থীকে পাশ কাটিয়ে নৌকার বিজয় ছিনিয়ে আনতে অনেকটা বেগ পেতে হবে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে। নিজের রাজনৈতিক অবস্থানের পাশাপাশি ব্যক্তি অবস্থান ও কৌশলকে কাজে লাগাতে হবে। আর তিনি যদি বিজয়ী হতে পারেন এটা কুলাউড়ায় ২০ বছর পর নৌকার বিজয়ে মাইলফলক হয়ে থাকবে।

আওয়ামী লীগের দলীয় নৌকা প্রতীকের প্রার্থী অধ্যক্ষ সিপার উদ্দিন আহমদ এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘যারা মূলধারার আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন, দলের আদর্শ মানেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মানেন তারা নৌকার পক্ষে কাজ করবেন ঐক্যবদ্ধ হয়ে। আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক ও নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকতে পারে। তবে দল ও নৌকার বিষয়ে সবাই ঐক্যবদ্ধ। আমি আমার দলের নেতাকর্মীদের সহযোগিতা সবসময় পেয়েছি এখনো পাচ্ছি। সবার ঐক্যবদ্ধ সহযোগিতায় এবারের পৌর নির্বাচনে নৌকার বিজয় আসবে। উন্নয়নের মহাসড়কে যুক্ত হতে পিছিয়ে পড়া কুলাউড়া পৌরসভার উন্নয়ন করতে নৌকাকে বিজয়ী করবে ঐক্যবদ্ধ পৌরবাসী।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিদ্রোহী যিনি তিনি তো প্রকৃত আওয়ামী লীগার না। উনি একজন ব্যবসায়ী। আওয়ামী লীগের ভোটে উনি কোনো প্রভাব ফেলতে পারবেন না। কুলাউড়ার মানুষ পরিবর্তন চায়। উন্নয়নের মার্কা নৌকার বিজয় সাধারণ মানুষ চায়।’

উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম রেনু জানান, স্বাধীনতার মার্কা, বঙ্গবন্ধুর মার্কা নৌকাকে বিজয়ী করতে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন। আমরা অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নৌকার প্রার্থীকে জয়ী করতে কাজ করছি। গণতন্ত্রের বিপক্ষে কোনো চোরাগুপ্তা নির্বাচন করিনি এবং করবোও না। বিদ্রোহীকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।’

আওয়ামী লীগ নেতারা প্রকাশ্যে নৌকার পক্ষে কথা বললেও গোপনে বিদ্রোহীর পক্ষেই আছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, দলীয় নেতা-কর্মীর এমন কোনো অভ্যাস নাই। দলে বহু লোক থাকে। দলছুট মানুষ থাকে। গোপনে কে কতকিছু করে সেটা আমরা ধরছি না। দলের কোনো নেতাকর্মী দলের বিরুদ্ধে নেই।

সম্প্রতি পৌর আওয়ামী লীগ আয়োজিত নৌকা মার্কার প্রার্থীর সমর্থনে আয়োজিত বিশেষ বর্ধিত সভায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মিসবাহুর রহমান বলেন, ‘যারা দলের ভেতরে থেকে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করছে তাদেরকে প্রতিহত করতে নৌকার বিজয় নিশ্চিতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কৌশলে কাজ করতে হবে।’

বিশেষ বর্ধিত সভায় প্রধান অতিথি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন শফিক বলেন, ‘ দলের মনোনীত প্রার্থী ব্যতীত যিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন তিনি ব্যক্তিগতভাবে এত ক্ষমতাধর নন যে, তিনি একাই নির্বাচনে জয়ী হবেন। আমি যতটুকু জানি দলীয় কোনো পদ নেই ওই প্রার্থীর। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ করে, শেখ হাসিনার দলের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে দলকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, দলের বিরুদ্ধ (বিদ্রোহী) প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবে তাদেরকে প্রমাণসহ চিহ্নিত করে রাখবেন। তাদের বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত