নিজস্ব প্রতিবেদক

২০ মার্চ, ২০২১ ২২:২৩

দিরাইয়ে হেফাজতের সেই সমাবেশের ‘সহযোগিতায়’ ছিলেন আ. লীগ নেতারা

হেফাজতের সমাবেশ মঞ্চে দিরাই পৌরসভার মেয়র বিশ্বজিৎ রায় (বাম থেকে চতুর্থ)।

সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে হেফাজতে ইসলামের যে সম্মেলনে মামুনুল হকের বক্তব্য নিয়ে এক যুবকের ফেসবুক স্ট্যাটাস এবং তার জেরে শাল্লায় হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা, সেই সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা।

শানে রিসালত সম্মেলন নামের ওই আয়োজনে অতিথি ছিলেন হেফাজতের আমির জুনাইদ বাবুনগরী ও যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক।

সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে ক্ষমতাসীনদের তোপের মুখে পড়েন হেফাজত নেতা মামুনুল। দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় মামুনুলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠন। বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে বাধার মুখেও পড়তে হয় তাকে।

কিন্তু এর মাঝেই ১৫ মার্চের ওই সমাবেশে আওয়ামী লীগ নেতাদের সহযোগিতা ও উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ওই সমাবেশের কিছু ছবিতে দেখা যায় মঞ্চে উপস্থিত আছেন দিরাই পৌরসভার মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি বিশ্বজিৎ রায়। তিনি সমাবেশে বক্তৃতাও দেন।

সমাবেশে স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকায় দেখা গেছে পৌর যুবলীগের সভাপতি জুয়েল মিয়াকে। স্বেছাসেবকদের জন্য তৈরি আলাদা টি-শার্টও তার পরনে ছিল।

অনেকের অভিযোগ, এই দুই নেতা নিজেদের অনুসারী আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ নেতাদের নিয়ে সমাবেশে যোগ দেন।

সমাবেশে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্বে পৌর যুবলীগের সভাপতি জুয়েল মিয়া ও তার কর্মীরা।

এ ছাড়া সমাবেশের হেফাজত নেতার সাথে একটি বৈঠকে দেখা গেছে দিরাই পৌরসভার সাবেক মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আজিজুর রহমান বুলবুলকে।

বুলবুলের বাসায় আয়োজিত ওই বৈঠকের ছবিও ফেসবুকে আছে। হেফাজতের সমাবেশে বুলবুল আর্থিক সহায়তা করেন বলেও অভিযোগ আছে।

দিরাইয়ের সমাবেশে মামুনুলসহ হেফাজতের শীর্ষ নেতারা সরকারের সমালোচনা করেন এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ মোদির আসার বিরোধিতা করে বিভিন্ন বক্তব্য দেন।

ওই সমাবেশে মামুনুলের বক্তব্য নিয়েই স্ট্যাটাস দেন শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামের এক যুবক। এই স্ট্যাটাসের জেরে ১৭ মার্চ সকালে ওই গ্রামে হামলা চালানো হয়। ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয় ৮০টির বেশি হিন্দুবাড়ি।

এ রকম একটি সমাবেশে মঞ্চে উপস্থিত থাকার বিষয়ে পৌর মেয়র বিশ্বজিৎ রায় বলেন, ‘আমি মেয়র হিসেবে সমাবেশে গিয়েছিলাম। আমার বক্তৃতায় শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশটি করার অনুরোধ করেছি।’

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যবিরোধীর সঙ্গে একই মঞ্চে বক্তৃতা করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এলাকার শান্তি ও সম্প্রীতির স্বার্থে ওই সমাবেশে একজন মেয়র হিসেবে আমার উপস্থিতি দোষের কিছু নয়।’

পৌর মেয়র জানান, হেফাজতের শীর্ষ নেতারা অনুষ্ঠানে আসার আগেই তিনি বক্তৃতা দিয়ে চলে যান। তাই তারা কী বলেছেন তা তিনি জানেন না।

সাবেক পৌর মেয়র বুলবুল যুক্তরাজ্যপ্রবাসী। তিনি ১২ মার্চ হেফাজত নেতাদের নিয়ে সভা করেন। এরপর সমাবেশের আগের দিনই যুক্তরাজ্য ফিরে যান।

স্থানীয় নেতাদের অভিযোগ, বুলবুল ভবিষ্যতে এই এলাকা থেকে সংসদ সদস্য প্রার্থী হতে চান। এ কারণে তিনি সব পক্ষকে নিজের পক্ষে রাখতে হেফাজতকেও সহায়তা করছেন। ভোটের রাজনীতির হিসেবেই হিন্দুধর্মাবলম্বী মেয়রও ওই সমাবেশে যান বলে অভিযোগ তাদের।

তবে হেফাজতের সমাবেশের আগের দিনই যুক্তরাজ্য চলে যান আজিজুর রহমান বুলবুল। তাই এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য জানা যায়নি।

তবে তার ব্যক্তিগত সহকারী আবু হানিফ চৌধুরী বলেন, সম্মেলন সফল করতে হেফাজত নেতাদের সঙ্গে আজিজুর রহমান বুলবুলের বৈঠকের যে অভিযোগ ওঠেছে তা সত্য নয়।

আজিজুল হক বুলবুলের সঙ্গে হেফাজত নেতার যে ছবি দিয়ে সমালোচনা করা হচ্ছে সেটি একটি সৌজন্য সাক্ষাতের ছবি। কোনো প্রস্তুতি সভা নয়।

আবু হানিফ বলেন, হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতা আল্লামা নুরুল ইসলাম খান সুনামগঞ্জে সর্বমহলে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। সব ধর্মের মানুষ তাকে সম্মান করেন। গত ১২ মার্চ তিনি দিরাইয়ে একটি ওয়াজ মাহফিলে এসেছিলেন। দিরাইয়ে এসে জানতে পারেন সাবেক মেয়র বুলবুল পরদিন যুক্তরাজ্য চলে যাবেন। তাই তার বাসায় সৌজন্য সাক্ষাত করতে এসেছিলেন নুরুল ইসলাম খান। এ সময় অনেক আওয়ামী লীগ নেতাই উপস্থিত ছিলেন। তবে তখন হেফাজতের সম্মেলন নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।

তিনি বলেন, ‘যে ছবিটি নিয়ে প্রপাগান্ডা চলছে সেই ছবি আমি তুলে ফেসবুকে দেই। এখন আওয়ামী লীগের বুলবুল বিরোধী একটি অংশ এই ছবি ব্যবহার করে মিথ্যাচার করছে।’
নিজ বাসায় স্থানীয় হেফাজত নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আজিজুর রহমান বুলবুল।

দিরাই পৌরসভার সাবেক মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক (পৌরসভা নির্বাচনে বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থী হয়ে দল থেকে বহিষ্কৃত) মোশরাফ মিয়া বলেন, ‘হেফাজতের সমাবেশ সফল করতে আজিজুর রহমান বুলবুলের বাসায় বৈঠক হয়েছে। তিনি হেফাজতের সমাবেশে অর্থ সহায়তা দিয়েছেন। এমনকি হেলিকপ্টার থেকে নেমে হেফাজতের নেতারা বুলবুলের গাড়িতে করেই অনুষ্ঠান মঞ্চে আসেন।’

এ ছাড়া ওই সমাবেশে বক্তৃতা করেন পৌর মেয়র বিশ্বজিৎ আর স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ছিলেন যুবলীগ নেতা জুয়েল।

তিনি বলেন, ‘যারা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বলে, সরকারের বিরুদ্ধে বলে তাদের সমাবেশে কী করে আওয়ামী লীগ নেতারা উপস্থিত থাকেন, সেটা আমাদের কাছে বিস্ময়কর। আমি তাদের দল থেকে বহিষ্কারের দাবি জানাচ্ছি। জেলার নেতাদেরও বিষয়টি অবহিত করেছি।’

তবে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিউর রহমানের দাবি, পৌর মেয়র বিশ্বজিৎ ছাড়া হেফাজতের সমাবেশে আওয়ামী লীগের কোনো নেতা ছিলেন না। কেউ সহায়তাও করেননি।

তিনি বলেন, ‘আমাদের দলেরই কিছু লোক ব্যক্তিগত রেষারেষি থেকে অন্য নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নাম করছে।’

হেফাজতের সমাবেশে পৌরসভার মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি বিশ্বজিৎ রায়ের উপস্থিত থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সে ওইখানে গিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করার অনুরোধ করেছে। মেয়র হিসেবে এটা তার দায়িত্বও।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত