নিজস্ব প্রতিবেদক

২৩ জুন, ২০২৩ ১৩:০৪

সিলেটের অপরাজেয় কাউন্সিলররা

সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যেন হারতে ভুলে গেছেন কিছু প্রার্থী। ২০০৩ সালে প্রথম মেয়াদ থেকে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়ে বারবার জয়ের মুখ দেখেছেন তারা। টানা পাঁচ মেয়াদে জয়লাভ করে এমনই এক বিরল কীর্তির অধিকারী হয়েছেন সিলেট মহানগরীর ৬টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর।

বুধবার (২১ জুন) সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সিলেট সিটি কর্পোরেশনের পঞ্চম মেয়াদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

টানা পাঁচবারের মতো নির্বাচিত কাউন্সিলররা হলেন- ৬ নম্বর ওয়ার্ডে মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ফরহাদ চৌধুরী শামীম। ৯ নম্বর ওয়ার্ডে টানা পঞ্চমবারের মতো বিজয়ী হয়েছেন মহানগর আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক মো. মখলিছুর রহমান কামরান। ১২ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর সিকন্দর আলী, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে টানা ষষ্ঠবারের মতো নির্বাচিত হয়েছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য শান্তনু দত্ত শন্তু। ২০ নম্বর ওয়ার্ডে টানা পঞ্চমবারের মতো জয় পেয়েছেন বর্তমান কাউন্সিলর ও মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আজাদুর রহমান আজাদ এবং নারী কাউন্সিলর পদে ৬নং ওয়ার্ডে শাহানারা বেগম পঞ্চমবারের মতো জয় পেয়েছেন

টানা পঞ্চমবারের মতো নির্বাচিত কাউন্সিলরদের মধ্যে যেন আরও একধাপ এগিয়ে আছেন ১৩ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শান্তনু দত্ত শন্তু। সিলেট সিটি করপোরেশনে (সিসিক) পঞ্চমবারের মতো এবং তৎকালীন সিলেট পৌরসভায় একবার কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

১৯৯৫ সালে পৌরসভা থাকাকালীন সময়ে প্রথম কমিশনার নির্বাচনে প্রার্থী হন সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য শান্তনু দত্ত শন্তু। এরপর পৌরসভা থেকে সিলেট সিটি করপোরেশনে রূপান্তর হলে তিনি ২০০৩, ২০০৮, ২০১৩, ২০১৮ ও ২০২৩ সালে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।

২০১৮ সালের নির্বাচনে শান্তনু ২ হাজার ৭১২ ভোট পেয়ে বিজয় লাভ করেন। আর এবার তিনি ২ হাজার ৩০৪ ভোট পেয়ে এই ওয়ার্ডে অপরাজিত থাকার রেকর্ড অক্ষুণ্ণ রাখেন।

গত দুই নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন পেতে অনেক আগে থেকেই তৎপর ছিলেন আজাদুর রহমান। এর অংশ হিসেবে তারা পোস্টার, ব্যানার ও বিলবোর্ড সাঁটিয়ে প্রকাশ্যে তৎপরতা শুরু করেন। কিন্তু দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে দুইবারই আওয়ামী লীগ থেকে মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে মেয়র পদে না দাঁড়িয়ে নিজের কাউন্সিলর পদ থেকেই নির্বাচন করেন।

২০ নম্বর ওয়ার্ড থেকে পরপর পাঁচবার কাউন্সিলর পদে নির্বাচনের রেকর্ড তার দখলে। গত ২০১৮ সালের নির্বাচনে আজাদের কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। এবার আজাদুর রহমান লাটিম প্রতীক নিয়ে ৩ হাজার ১৩৯ ভোট পেয়ে পুনরায় নির্বাচিত হন।

সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক মখলিছুর রহমান কামরানও ৯নং ওয়ার্ডের বারবার নির্বাচিত কাউন্সিলর। ২০০৩ সাল থেকে শুরু করে সদ্য সমাপ্ত ২০২৩ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ৫টি নির্বাচনে তিনিও টানা জয়লাভ করে চলছেন।

এবার ঘুড়ি প্রতীক নিয়ে ৯ নম্বর ওয়ার্ডে মখলিছুর রহমান কামরান ৪ হাজার ৯৫০ ভোট পেয়ে স্বপদে ফের নির্বাচিত হয়েছেন।

সিলেট মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ও বর্তমান কাউন্সিলর ফরহাদ চৌধুরী শামীম। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করায় বিএনপি থেকে বহিষ্কার হয়েছেন তিনি।

৬ নম্বর ওয়ার্ডে ফরহাদ হোসেন শামীমও লাটিম প্রতীক নিয়ে ৪ হাজার ১১৮ ভোট পেয়ে টানা পাঁচবার কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার কীর্তিতে শামিল হন।

টানা ৫ মেয়াদে নির্বাচিত চার কাউন্সিলরদের একমাত্রই তিনি বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত। বাকী সবাই মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা।

১২ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর সিকন্দর আলী ও নারী কাউন্সিলর পদে ৬নং ওয়ার্ডে শাহানারা বেগম পঞ্চমবারের মতো জয় পেয়েছেন।

এর আগে বুধবার (২১ জুন) লক্ষাধিক ভোট পেয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে সিলেটের নতুন নগরপিতা নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।

নৌকা প্রতীকের আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী ভোট পেয়েছেন ১ লাখ ১৯ হাজার ৯৯১। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির লাঙল প্রতীকের নজরুল ইসলাম বাবুল পেয়েছেন ৫০ হাজার ৮৬২ ভোট। যদিও নির্বাচনে বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে নিজের এজেন্ট বের করে দেওয়ার অভিযোগ তুলে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছেন নজরুল ইসলাম বাবুল।

সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন ৮ জন। বিধি অনুযায়ী ভোট না পাওয়ায় জামানত হারাচ্ছেন ৫ জন প্রার্থী। নির্বাচনের নিয়ম অনুযায়ী ফলাফলে বৈধ ভোটের আট ভাগের এক ভাগ ভোট না পাওয়ায় এরা জামানত হারাচ্ছেন।

সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজিত হলেও সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. শাহ জাহান মিয়া ওরফে শাহ জাহান মাস্টার বাস প্রতীক নিয়ে ২৯ হাজার ৬৮৮ ভোট পেয়েছেন। জামানত হারাচ্ছেন না তিনিও।

জামানত হারানো প্রার্থীদের মধ্যে ইসলামী আন্দোলনের মাহমুদুল হাসান (হাতপাখা) ১২ হাজার ৭৯৪ ভোট, স্বতন্ত্র আব্দুল হানিফ কুটু (ঘোড়া) ৪ হাজার ২৯৬ ভোট, মোহাম্মদ ছালাউদ্দিন রিমন (ক্রিকেট ব্যাট) ২ হাজার ৬৪৮ ভোট, স্বতন্ত্র জহিরুল আলম (গোলাপ ফুল) ৩ হাজার ৪০৫ ভোট ও স্বতন্ত্র মোশতাক আহমেদ রউফ মোস্তফা (হরিণ) ২ হাজার ৯৫৯ ভোট পেয়েছেন।

যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী এবারই প্রথম নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন। আর পেশায় ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম বাবুল মহানগর জাতীয় পার্টির আহ্বায়কের দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি এর আগে কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করলেও মেয়র পদে এই প্রথম নির্বাচন তার।

এই নির্বাচন বর্জন করেছে বিএনপিসহ তাদের সমমনা ও বামদলগুলো। ফলে নির্বাচনে অংশ নেননি বিএনপি নেতা ও বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। আর করোনায় প্রয়াত হয়েছেন সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান।

প্রসঙ্গত, বুধবার (২১ জুন) সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ৭৯ দশমিক ৫০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ৪২ ওয়ার্ডে এই সিটিতে এবার পঞ্চমবারের মতো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

এবার মোট ভোটার সংখ্যা চার লাখ ৮৭ হাজার ৭৫৩ জন। তাদের মধ্যে পুরুষ দুই লাখ ৫৪ হাজার ৩৬০, নারী দুই লাখ ৩৩ হাজার ৩৮৭ জন এবং ছয়জন তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন।

এদিকে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) নির্বাচনে ৪৬ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। বুধবার বিকেলে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের সামনে সিইসি এই তথ্য জানান।

সিইসি বলেছেন, ‘সিলেট সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। বুধবার সকাল থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশে সুষ্ঠু ভোট হয়েছে। আপনারা নিশ্চয় জানেন, বিভিন্ন ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় কিন্তু এবার বিশৃঙ্খলা ছাড়াই আনন্দমুখর পরিবেশে ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে।’

সিলেট সিটিতে মেয়র পদে ৮ জন, ৪২টি সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে ২৭৩ জন এবং ১২টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে ৮৬ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ভোটে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে শঙ্কা ছিল। ভোটার উপস্থিতি নিয়ে আওয়ামী লীগের যেমন চ্যালেঞ্জ ছিল, তেমনি নির্বাচন কমিশনেরও ছিল। বৈরী আবহাওয়া এবং বিএনপি-জামায়াত ভোট বর্জন করায় এ শঙ্কা প্রকট হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চিত্র অনেকটা ভিন্ন লক্ষ্য করা গেছে। প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রেই ভোটারদের দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। বিশেষ করে নতুন ১৫টি ওয়ার্ডের ভোট কেন্দ্রে উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়।

সব কেন্দ্রে নারী ভোটারদের উপস্থিতিও বেশি দেখা গেছে। অনুকূল আবহাওয়ার কারণেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে দেখা গেছে ভোটারদের উপস্থিতি। এসব ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করতে নেপথ্যে কাজ করেছেন স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলররা। মূলত তারাই ভোট টানতে নানা কৌশলে ভোটারদের আগ্রহী করে তুলেছেন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত