তাহিরপুর প্রতিনিধি

০৯ মার্চ, ২০২৪ ১৩:৫৩

কয়লা চোরাকারবারি ও চাঁদাবাজদের অভয়ারণ্য আনোয়ারপুর বাজার

কয়লা চোরাকারবারি ও চাঁদাবাজদের অভয়ারণ্যে পরিণত হচ্ছে আনোয়ারপুর বাজার। দীর্ঘদিন ধরে এ বাজারের উত্তর দিকের অংশ (নদীর পাড় ঘেঁষে যাদুকাটা ও রক্তি নদী পার-ফতেহপুর সড়কে) চলছে অবৈধ কার্যক্রম। বছরজুড়েই চলছে এই।

দিনে যেমন তেমন, রাতে পাল্টে যায় এখানকার দৃশ্য। যেন শিল্পনগরীর মত কয়লা চোরাই পণ্যবাহী গাড়ি দাপিয়ে বেড়ায় সড়কে। তেমনি নদীপথেও বসে চোরাই কয়লার নৌকার মেলা। আর নদীর পাড়েই সেই কয়লার ডিপো করে রেখেছে সংঘবদ্ধরা। এই বিষয়টি বর্তমানে ‘ওপেন সিক্রেট’ হলেও কেউ যেন এর দায় নিচ্ছে না।

উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মিটিংয়ে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজাদ হোসাইন এই বিষয়টি তুলে ধরলে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে অদৃশ্য কারণে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় বন্ধ হচ্ছে না এসব চোরাচালান ও চাঁদাবাজি এবং তাদের নৈকট্যে থাকা রাঘববোয়ালরাও থাকছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, সরকারের রাজস্ব বঞ্চিত করে সীমান্তের দায়িত্বশীলদের চোখ ফাঁকি দিয়ে অবৈধ ভাবে সীমান্তের বিভিন্ন চোরাই পথ দিয়ে সীমান্তের চিহ্নিত চোরাচালানীরা ভারতীয় কয়লা বাংলাদেশে আনছে। পরে নৌপথে এনে ট্রাকে করে সড়ক পথে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

আনোয়ারপুর বাজার থেকে প্রতিদিন ১০-১২টি কোনদিন আরও বেশি কয়লার নৌকা ঘাটে আসে, তবে বেশির ভাগ চোরাই পথে আনা কয়লা। পরে নৌকা থেকে এই এলাকার আশপাশে ডিপোর মত করে মজুদ করে রাখা হয়। প্রতিদিন ১০-১৫টি ট্রাক লোড হয় এই এলাকা থেকে। প্রতিটি ট্রাকে ২০-২২ টন কয়লা লোড করা হয় যার মূল্য ৪-৫ লাখ টাকা, সে হিসেবে দৈনিক প্রায় অর্ধকোটি টাকার বেশি প্রতিদিন কয়লা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠানো হয়।

এরসাথে ভারতীয় বিভিন্ন ব্যান্ডের মাদকদ্রব্য ও পাচার করা হয় বলে জানা যায়। আরও জানা যায় সেই ট্রাকগুলো থেকে স্থানীয় ৭-৮ জনের একটি চাঁদাবাজ চক্র মোটা অংকের চাঁদা উত্তোলন করছে। এছাড়াও এই অংশে কয়লা ডিপো করে মজুদ করে রেখেছে চক্রটি। আর প্রতিদিন সেখান থেকে পাচার করছে কয়লা। কিন্তু কেউই এর প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছে না, কারণ এই চাঁদাবাজ ও কয়লার সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত স্থানীয় প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীর।

খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, উপজেলায় তিনটি শুল্ক ষ্টেশন রয়েছে। এলসির মাধ্যমে কয়লা, চুনাপাথর আমদানি করে ৮ শতাধিক ব্যবসায়ী। দীর্ঘদিন ধরেই এই এলাকা দিয়ে সীমান্তের চিহ্নিত চোরাকারবারিরা অবৈধভাবে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে কয়লা পাচার করছে ও স্থানীয় চাঁদাবাজ চক্রকে ম্যানেজ করে। ফলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, অন্যদিকে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

কয়লা লোড-আনলোডের কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা জানান, ভাই আমরা শ্রমিক। টাকার বিনিময়ে এই কয়লা লোড-আনলোড করি। তবে কয়লাগুলো বৈধ না অবৈধ, চোরাই পথে আনা কিনা তা জানি না। তবে শুনি এসব নাকি চোরাইপথে আনা। দিনে কম হলেও ১০ থেকে ১২ ট্রাক লোড করি কোনো দিন আরও বেশি।

স্থানীয় সচেতন মহল উদ্বেগ প্রকাশ করে জানান, চোরাকারবার বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বিগ্ন সচেতন নাগরিক ও সুশীল সমাজের ব্যক্তিবর্গ। অবৈধ ব্যবসা দেশের অর্থনীতি ও আইন শৃঙ্খলায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে জানান তারা। সীমান্তে চোরাচালন বন্ধে সরকারের তৎপরতা কামনা করছেন তারা।

সুনামগঞ্জ পৌর মেয়র নাদের বখত সম্প্রতি একটি সভায় উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, ইদানীং চোরাকারবারিদের জোনে পরিণত হয়েছে সুনামগঞ্জ। আগে এমনটা ছিল না। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো এই ব্যবসার সাথে আমাদের তরুণ ছেলেরা যুক্ত হয়ে পড়ছে। এটি বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। আমি এ নিয়ে জেলা মাসিক আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় কথা বলেছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সকল শ্রেণির লোকদের সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন।

২৮ বিজিবির পরিচালক লে. কর্নেল মাহবুবুর রহমান বলেন, আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকার পরও সীমান্তে চোরাচালান রোধে বিজিবি অনেক তৎপর। প্রায়ই অভিযান পরিচালনা করে ভারতীয় পণ্য জব্দ করা হচ্ছে। চোরাচালান বন্ধে জনপ্রতিনিধির পাশাপাশি সচেতন নাগরিকদের সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

সুনামগঞ্জ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ এহসান শাহ্‌ জানান, চোরাচালান বন্ধে আমরা নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। বিশেষ করে আঞ্চলিক সড়কে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। জেলায় আমরা বড় বড় চালান জব্দ করেছি। এসব কাজে সীমান্তের গুটিকয়েক লোক জড়িত রয়েছে। চোরাচালানের সাথে কোন পুলিশ সদস্য জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত