সিলেটটুডে ডেস্ক

৩১ জানুয়ারি, ২০১৬ ১৩:৫৪

বাংলা বানান শুদ্ধি অভিযান: শহরের বুকে কাকতাড়ুয়া

শহর থেকে শহরতলি সিলেটের একদল তরুণ প্রাণ রং তুলি হতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ দোকান থেকে ও দোকান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিলবোর্ড-সাইনবোর্ড বাদ পড়ে না কিছুই। যেখানেই ভুল বাংলা বানান, সেখানেই শুদ্ধি অভিযান। দোকান কিংবা প্রতিষ্ঠান মালিককে শত অনুরোধের পর একটি একটি করে পরম মমতায় বাংলা বানানগুলো শুদ্ধ করে দিচ্ছিল সিলেটের সংগঠন- কাকতাড়ুয়া। শনিবার নগরীর বারুতখানা পয়েন্ট থেকে জেলরোড দিয়ে বন্দর বাজার হয়ে জিন্দাবাজার পর্যন্ত তারা শুদ্ধি অভিযান চালিয়েছে।



২০১৪ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরি শেষে কাকতাড়ুয়ার ২০ জন ছেলে মেয়ে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বানান শুদ্ধির যাত্রা শুরু করে। ভাষার জন্য ভালবাসা থেকে কড়া রোদে ধুলো মাখা রাজপথে এ দোকান থেকে ও দোকান - “ভাই আপনার দোকানের সামনে এই বাংলা বানানটি ভুল, আমরা রং তুলি সাথে নিয়ে এসেছি। অনুমতি দিলে ঠিক করতে চাই।” কেউ বা তেড়ে এসেছে। কেউ অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলেন- ঠিক করো। কেউবা টুল এগিয়ে দেয়, কেউ চা বিস্কিট খাওয়ায়। নগরীর মুদিদোকান থেকে শুরু করে বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড, সরকারি, আধা-সরকারি, বেসরকারি অফিস, কারখানা সবখানেই হানা দিয়েছে তারা। নিজ হাতে পরম মমতায় শুদ্ধ করে দিয়েছে ভুল বাংলা বানান গুলো। কাকতাড়ুয়া ভুল বাংলা বানান শুদ্ধ করেই ক্ষান্ত হয়নি, পরবর্তীতে একই ভুল কেউ যাতে না করে সে ব্যাপারেও সচেতনতা তৈরি করে।

প্রায় প্রতিমাসেই কাকতাড়ুয়ারা সিলেট শহরের অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়ায়। এখন পর্যন্ত সিলেট নগরীর যেসকল রাস্তায় বাংলা বানান শুদ্ধি অভিযান চলেছে সেগুলো হলো: টিলাগড় পয়েন্ট থেকে শিবগঞ্জ পয়েন্ট, উপশহরের বিভিন্ন ব্লক ঘুরে সোবহানীঘাট; বালুচর পয়েন্ট থেকে আরামবাগ, টিবি গেইট, শাহী ইদগাহ, সাপ্লাই দিয়ে আম্বরখানা পয়েন্ট; টিবি গেইট, শাহী ইদগাহ, কাজিটুলা, উঁচাসড়ক থেকে চৌহাট্টা অভিমুখে; আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে দরগারোড, চৌহাট্টা দিয়ে সিলেট কেন্দ্রিয় শহিদমিনার।


কাকতাড়ুয়ার দল এখন পর্যন্ত মোট ১৯৭টি প্রতিষ্ঠানে বানান শুদ্ধির জন্য অনুরোধ করেছে। এর মধ্যে ১৩৭টি প্রতিষ্ঠানে বানান শুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। বাকিরা অচিরেই তাদের ভুল বানানগুলো শুদ্ধ করে নেবে বলে আশ্বাস দিয়েছে। তারা বিভিন্ন ছাপাখানা ও আর্টিষ্ট প্রতিষ্ঠানে শুদ্ধ করে বাংলা লেখার জন্য প্রচারনা চালিয়েছে। শুদ্ধি অভিযান শেষে কাকতাড়ুয়ার দল সিলেটের চৌহাট্টায় শহিদমিনারে আসে। রং তুলি শহীদ বেদীতে রেখে তারা শহীদ মিনারে একসাথে সালাম দেয়।


কাকতাড়ুয়ার কথা: ‘ভুল’ শব্দটি লেখার সময়ই অনেকে ভুল করে লেখে ‘ভূল’। ভাষাশহিদদদের প্রতি সম্মান জানাতে যে প্রভাতফেরি হয়, সেখানে হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে রক্তলাল-অক্ষরে লিখে ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’ জানানো হয়। কিন্তু বেশির ভাগ সংগঠন, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির শ্রদ্ধা নিবেদনে সামান্য খাদ থেকে যায়; তারা লেখে ‘শ্রদ্ধাঞ্জলী’!



সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের দোকানপাট, প্রতিষ্ঠান-ভবনের সাইনবোর্ডগুলোর দিকে তাকালেই বাংলা ভাষার করুণ অবস্থা বোঝা যায়। নগরের সাইনবোর্ড, দেয়াললিখনে একটু মনোযোগ দিলেই ভড়কে যেতে হয় হাজারো ভুল বানান দেখে। দেখা মেলে জ্বলজ্বল করছে ‘ষ্টোর্স’ (হবে স্টোর্স), (ঠিক বানানটা ব্র্যাকেটে দেওয়া হলো) ‘ষ্টোর’ (স্টোর), ‘এন্ড’ (অ্যান্ড), ‘ঘন্টা’ (ঘণ্টা), ‘ইনষ্টিটিউট’ (ইনস্টিটিউট), ‘ষ্ট্যান্ড’ (স্ট্যান্ড), ‘ফ্যাক্টরী’ (ফ্যাক্টরি), ‘ফার্ণিচার’ (ফার্নিচার), ‘মডার্ণ’ (মডার্ন), ‘রেষ্টুরেন্ট’ (রেস্টুরেন্ট), ‘কম্পানী’ (কম্পানি) ‘আইনজীবি’ (আইনজীবী), ‘বিরাণী’ (বিরানি), ‘কর্ণেল’ (কর্নেল), ‘ষ্ট্যাম্প’ (স্ট্যাম্প), ‘ফটোষ্ট্যাট’ (ফটোস্ট্যাট), ‘ভ্রাম্যমান’ (ভ্রাম্যমাণ), ‘ডায়াগনষ্টিক’, (ডায়াগনস্টিক) ‘ব্যাটারী’ (ব্যাটারি), ‘মেশিনারী’ (মেশিনারি) ইত্যাদি ইত্যাদি। ‘রেস্তোরাঁ’ শব্দটি প্রায়ই দেখতে পাওয়া যায় ‘রেঁস্তোরা’ বা ‘রেস্তোরা’ বানানে। ‘সরণি’কে ভুল বানানে লেখা হচ্ছে ‘স্মরণী’ বা ‘স্বরণী’। ‘গোল চত্বর’কে ভুল বানানে লেখা হচ্ছে ‘গোল চক্কর’। এতে ‘চত্বর’ আর ‘সরণি’র অর্থই পাল্টে যাচ্ছে। সাইনবোর্ডের অসংখ্য ভুল বানানের মধ্যে আছে ‘গর্ভণর’, ‘মডার্ণ’, ‘রেঁনেসা’, ‘রেজিষ্ট্রি’ ‘পঁচা’ (শুদ্ধ বানানগুলো হচ্ছে : গভর্নর, মডার্ন, রেনেসাঁ, রেজিস্ট্রি, পচা)।

শুধু সাইনবোর্ডের ভুলই নয়, রাজনীতিকদের বানানের ওপর ‘অগাধ জ্ঞান’ দেখে তো রীতিমতো ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। দেয়ালে চোখ পড়লে প্রায়ই দেখা যায় ‘জাতীর পিতা’। শুদ্ধ বানানটি হচ্ছে ‘জাতির পিতা’। অনেক সময় ছাত্রসংগঠনগুলোকে অদ্ভুত ব্যানার নিয়ে বিক্ষোভ করতে দেখা যায়। ব্যানারে কী ভয়াবহ বানান! প্রায়ই লেখা থাকে ‘দূরশ্বাষনের’, ‘বিরোদ্ধে’, ‘কণ্ঠ সুর’, ‘স্বইরাচারী’, ‘বিক্ষুভ’ ইত্যাদি ভুল। (সঠিকগুলো হবে- দুঃশাসন, বিরুদ্ধে, কণ্ঠস্বর, স্বৈরাচারী, বিক্ষোভ)। সরকারি-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর বানানের অবস্থাটা আরো করুণ। ‘সুপ্রীম কোর্ট’, ‘আপীল’. ‘রেজিষ্ট্রার’, ‘সরকারী’, ‘লিঁয়াজো’ ইত্যাদি (প্রমিত বানান হবে : সুপ্রিম কোর্ট, আপিল, রেজিস্ট্রার, সরকারি, লিয়াজোঁ) সরকারি প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনো লেখা রয়েছে বর্জিত ‘সরকারী’ বানানটি। শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে ঢুকতেই ভুল বানানটি শিখে ফেলে। নগরজুড়ে ‘দেয়াললিখে’ আহ্বান জানিয়েছেন ‘দেয়ালে পোষ্টার’ না লাগানোর জন্য। কিন্তু পোষ্টার বানানটি ভুল; সঠিকটি হবে পোস্টার। ফার্নিচার দোকানগুলোর নাম ‘ফার্ণিশার্স’ লেখা! এসব ভুল শব্দ প্রতিদিন দেখতে দেখতে একদিন আমরাও ভুলে যাই সঠিক শব্দটি।

ভুল দেখতে দেখতে একমসয় ভুলটাকেই আমরা শুদ্ধ বলে ধরে নিই। তাই ভুলের বিরুদ্ধে আমাদের এ সংগ্রাম। সিলেট শহরে বিভিন্ন অলিতে গলিতে সারা বছরই আমরা বাংলা বানান শুদ্ধি অভিযানে বের হই। সারা বাংলাদেশের সব শিক্ষিত তরুণদের প্রতি আবেদন-আপনার এলাকায়ও শুরু করুন বাংলা বানান শুদ্ধি অভিযান।

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী গোলাম সরোয়ার শুভর পরিকল্পনা ও অভিজিৎ পালের পরিচালনায় কাকতাড়ুয়ার নেতৃত্বে ছিলেন জনসংযোগ ও প্রকাশনা বিভাগের কর্মকর্তা খলিলুর রহমান ফয়সাল। এবারের কাকতাড়ুয়া দলে ছিলেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, লিডিং ইউনিভার্সিটি এবং এমসি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে প্রায় অর্ধশত শিক্ষার্থী। ছবি তোলার দায়িত্বে ছিলেন নয়ন শুভ, সৌমিক দেব, খালিদুজ্জামান রাব্বী, মোর্শেদ আলম ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত