তপন কুমার দাস, বড়লেখা

০৩ মে, ২০১৬ ১৯:১৩

বড়লেখা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে নানা অনিয়মের অভিযোগ

মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। বদলি, টাইম স্কেল, এরিয়ার বিল, উৎসব ভাতা, মাতৃত্বকালীন ছুটিসহ নানাক্ষেত্রে ঘুষ দিতে হয় বলে অভিযোগ করেছেন বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ভুক্তভোগী শিক্ষক ও অভিভাবক।

অভিযোগ থেকে জানা গেছে, নিয়ম না মেনে সম্প্রতি অবসরকালীণ ছুটিতে (পিআরএল) গমনের প্রায় ২ মাস থাকলেও বড়লেখা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা গীতা রানী দেবীকে কাঁঠালতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি করা হয়েছে। ছোটলেখা দক্ষিণভাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকাকে মৌখিকভাবে ডেপুটেশনে উত্তর ভাগিরপার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি করা হয়েছে।

এই বদলিতে নীতিমালা মানা হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। উপজেলার মোহাম্মদনগর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্-প্রাথমিক (শিশু শ্রেণি) শিক্ষক মন্টু দাসকে নিয়ম না মেনে পাবিজুরীপার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি করা হয়েছে। এই অভিযোগ করেছেন বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি নাহিদ আহমদ বাবলু। এতে এ বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক না থাকায় প্রায় এক মাস থেকে কোমলমতি শিশুদের লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটছে।

সাম্প্রতিক সময়ে বড়লেখায় বিভিন্ন বিদ্যালয়ে কর্মরত প্রায় ৬৫জন শিক্ষক সুবিধাজনক স্থানে বদলির আবেদন করেন। এরমধ্যে প্রায় ৪০ জনের বদলি হয়েছে। এতেও রয়েছে বদলি বাণিজ্যের অভিযোগ।

এদিকে অভিযোগ করা হয়েছে, সম্প্রতি জাতীয় বেতন স্কেল পে-ফিক্সেশন পেতে শিক্ষক প্রতি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা করে আদায় করা হয়েছে। আলাপকালে বেশকিছু শিক্ষক চাকরিতে ক্ষতির আশংকায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে এর সত্যতা স্বীকার করেন। এক্ষেত্রে শিক্ষক নেতাদের টাকা আদায়ের কাজে লাগানো হয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, পে-ফিক্সেশনের টাকা শিক্ষকদের কাছ হতে আদায়ের জন্য শিক্ষা কর্মকর্তার অফিসে বৈঠক বসে। এতে কয়েকজন শিক্ষক আপত্তিও জানান। তাদের আপত্তি উপেক্ষা করে টাকা আদায়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠকে উপস্থিত কয়েকজন শিক্ষক এর সত্যত নিশ্চিত করেছেন।

ফিক্সেশনের টাকা জমা নেওয়ার দায়িত্বে থাকা অজমির সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবের আহমদ টাকা আদায়ের সত্যতা স্বীকার করে আজ মঙ্গলবার (৩ মে) বলেন, ‘ফিক্সেশন নিয়ে যারা কাজ করেছেন তাদের চা-নাস্তা, কাগজ, কালি ও ইন্টারনেট এমবি’র জন্য এই টাকা তোলা হয়েছে। টাকা উঠানোর দায়িত্ব অন্যদের। আমার কাছে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা জমা হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, টাইম স্কেল, এরিয়ার বিল, উৎসব ভাতা, মাতৃত্বকালীন ছুটি, ভবিষ্যৎ তহবিল, উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণ, বকেয়া বিল উত্তোলন ও চিকিৎসাসহ নানা ধরনের ছুটি, বদলি, সরকারিভাবে বরাদ্দকৃত উন্নয়ন কাজের অর্থ পেতে, প্রাক্-প্রাথমিকের মালামাল ক্রয়, শিক্ষকদের বেতন-বিলসহ সকল ক্ষেত্রেই ঘুষ দেওয়ার অলিখিত নিয়ম চালু করেছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। টাকা না দিলে টাইম স্কেল ঝুলিয়ে রেখে হয়রানি করা, নানা অজুহাতে ফাইল আটকে সময়ক্ষেপন করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের টাইম স্কেলের জন্য ১৫শ থেকে ২ হাজার টাকা, এরিয়ার বিলের জন্য ১শ টাকা, উৎসব ভাতার জন্য ৩শ থেকে ৫শ টাকা, মাতৃত্বকালীন ছুটির জন্য ১ হাজার টাকা, ভবিষ্যৎ তহবিলের জন্য ৫শ থেকে ১ হাজার টাকা, উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণের জন্য ১ হাজার টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা, বদলির জন্য ২০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা, বরাদ্দকৃত উন্নয়ন কাজের অর্থ পেতে ১৫শ টাকা, প্রাক্-প্রাথমিক শ্রেণির মালামাল ক্রয় করতে ৫শ টাকা ঘুষ দিতে হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। কিন্তু সাধারণ শিক্ষকরা হয়রানির ভয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে পারছেন না।

শিক্ষা অফিস দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারেন এমন আশংকায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে শতাধিক সহকারী ও প্রধান শিক্ষক ক্ষুব্ধ কণ্ঠে অভিযোগ করে বলেন, ‘শিক্ষা অফিসে ঘুষ ছাড়া কিছুই হয় না। সার্ভিস বুক খোলার দিন থেকে ঘুষ নেয়া শুরু হয় এবং চাকরি থেকে অবসর নেয়ার দিন পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। এসব অনিয়মের জন্য উপজেলা ভারপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা অরবিন্দ কর্মকার ও উচ্চমান সহকারী সমরেশ চন্দ্র দেবনাথের বিরুদ্ধেই অভিযোগের আঙুল তুলেছেন শিক্ষকরা।

তবে অভিযোগের বিষয়ে উচ্চমান সহকারী সমরেশ চন্দ্র দেবনাথ বলেন, ‘বদলির বিষয়ে আমার কোনো হাত নেই। এতে টাকা নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। এটা আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্র।’

বড়লেখা উপজেলা ভারপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা অরবিন্দ কর্মকার বলেন, ‘বদলি কমিটির সিদ্ধান্ত মতে বদলি করা হয়েছে। এখানে কোনো বাণিজ্য হয়নি। কিছু সংখ্যক শিক্ষক আমাকে অপছন্দ করার কারণে তারাই এমন অপপ্রচারের জন্ম দিচ্ছেন। তবে ফিক্সেসনের টাকা আদায়ের বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। কারা টাকা আদায় করেছে তাও আমি জানি না।’

এ ব্যাপারে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় উপ-পরিচালক তাহমিনা খাতুন বলেন, ‘অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে বিধিমোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

 

আপনার মন্তব্য

আলোচিত