নিজস্ব প্রতিবেদক

১১ জুলাই, ২০১৬ ১২:৪৩

কেনো ভারত চলে যেতে চান কালেঙ্গা বনের আদিবাসীরা?

দেশের নাগরিক হলেও শিক্ষা কিংবা চিকিৎসা, এই দুই মৌলিক অধিকারের কোনটাই পায় না হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের রেমা কালেঙ্গা বনে বসবাসরত আদিবাসীরা। এছাড়া বন পাহারা দেওয়ার বিনিময়ে যে সামান্য জমি চাষাবাদের জন্য পেয়ে থাকেন তারা, তা থেকে উৎপাদিত খাবার দিয়েও সংসার চলে না এখানকার বাসিন্দাদের।

ফলে অনেকটা মানবেতর জীবনাযাপনই করতে হয় এ বনের ভেতরে বসবাসরত শতাধিক পরিবারের বাসিন্দাদের। এ ছাড়া বনবিট কর্মকর্তারাও তাদের নানা সময় নির্যাতন করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

নিজেদের আত্মীয়-স্বজন সব ভারতের ত্রিপুরায়। বাংলাদেশের চেয়ে তাই ত্রিপুরার সাথেই তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির মিল বেশি।

এমন নানা করণেই সদলবলে ভারতে পাড়ি জমাতে চেয়েছিলেন কালেঙ্গা বনের আদিবাসীরা। বন বিট কর্মকর্তার সাথে অপ্রীতিকর ঘটনার সূত্র ধরে গত ২৫ জুন কালেঙ্গা সীমান্ত দিয়ে ভারতের ত্রিপুরায় চলে যেতে চেয়েছিলেন এখানকার ১৮৭ বাসিন্দা। সীমান্তে বিএসএফ তাদের আটক করলে রাতে বিজিবি তাদের ফিরিয়ে নিয়ে আসে।

জানা যায়, ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত ১৭৯৫ হেক্টরের কালেঙ্গা সংরক্ষিত বনের দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলো প্রায় দুই শতাধিক পরিবার। এঁদের সবাই টিপরা জনগোষ্ঠির। এই জনগোষ্ঠির নেতাদের দাবি, শুরুতে বনে বৃক্ষরোপন আর পরিচর্যার কাজ করতেন প্রায় ২০০ পরিবার। নানা কারনে এখন তা নেমে এসেছে একশতে। শুরুতে বাঙালি মুসলিম পরিবার ছিল ৩৫টি, যা এখন দাঁড়িয়েছে ৯৭ এ। ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠির যারা এখনো টিকে আছেন, তারাও নানান সমস্যায় জর্জরিত।

কালেঙ্গা বনের ভেতরের দেবড়াবাড়ি গ্রামের টিপড়া হেডম্যান মনি দেব বর্মা বলেন, এখানে দুইশ টিপরা পরিবার ছিলো। কিন্তু নোয়াখালিসহ বিভিন্ন স্থান থেকে বাঙালি সেটেলারদের এনে বনের ভেতরে বসানো হয়েছে। তাদের কাছে কোনঠাসা হয়ে অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

তিনি বলেন, বন পাহারা দিয়ে প্রতিটি সদস্য পান প্রায় আড়াই একর জমি, যাতে চাষাবাদ করে এখন আর তাদের দিন চলে না। তাই মহাজনের কাছ থেকে নিতে হয় চড়া সুদে ঋন।

আরো পড়ুন : ‘অত্যাচারে’, ‘অপমানে’ দেশ ছাড়তে চেয়েছিলেন ১৮৭ আদিবাসী

মনি দেব বর্মা বলেন, কালেঙ্গা সংরক্ষিত বনাঞ্চলের পুরো ১৭৯৫ হেক্টরের মধ্যে কোথাও কোন চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। ফলে এই বনের ভেতরের দেবড়াবাড়ী গ্রামের কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসার জন্য যানবাহন পেতেই হাঁটতে হয় ৬ কিলোমিটার। তারপর চুনারুঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পৌঁছাতে অতিক্রম করতে হয় আরো ১২ কিলোমিটার।

এছাড়া বনে শিশুদের শিক্ষারও কোনো ব্যবস্থা নেই। স্কুলে আসতে হলে এই গ্রামের শিশুদের পাড়ি দিতে হয় বনের অমসৃন কয়েক কিলোমিটার পথ। যে কারনে স্কুলেই যায় না বেশির ভাগ টিপরা শিশু।

বন বিভাগ বলছে, বনের ভেতরে স্কুল কিংবা হাসপাতাল হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বন। তবে রেঞ্জ অফিসের বাইরের স্কুলটিকে আবাসিক আর সপ্তাহে বনের ভেতরে স্বাস্থ্যক্যাম্প চালু করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন বন কর্মকর্তা।

সিলেটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আর এস এম মনিরুল ইসলাম বলেন, বনের ভেতরে তো স্কুল বা হাসপাতাল স্থাপন করা যাবে না।

তিনি বলেন, এসব বিষয় চিন্তা করেই ফরেষ্ট ভিলেইজারসদের বন থেকে বাইরে এনে পূণর্বাসনের জন্য প্রকল্প তৈরী করছে বন বিভাগ। এতে নিজস্ব বাড়ি ছাড়াও প্রতিটি পরিবার পাবে ৪ লাখ টাকা মূলধন।

তিনি আরো বলেন, বনে পরিবারগুলোর সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় বনের স্বার্থেই তাদের বাইরে পুণর্বাসনের জন্য নানা সুবিধা দিয়ে প্রকল্প তৈরী করছে বন বিভাগ।

বনবিভাগ বনের বান্দিাদের জন্য নতুন প্রকল্পের কথা জানালেও বনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেই বিস্তর অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের।

দেবড়াপাড়া গ্রামের পঞ্চাশোর্ধ রমেশ দেব বর্মন বলেন, ফরেষ্টের বাবুরা যখন তখন আমাদের মারধর করেন, এলাকা ছাড়া করে সেটেলারদের বসাবেন বলে হুমকি দেন।

তবে ছনবাড়ি বনবিটের হেডম্যান দিঘেন্দ্র দেব বর্মার দাবি, কোনো অভিযোগ থেকে নয়, নিজেদের ভবিষ্যত চিন্তা করেই ভারতে চলে যেতে চান কালেঙ্গা বনের টিপরা অধিবাসীরা। তিনি বলেন, টিপরা লোকজন বাংলাদেশে থাকলেও তারা মনে করেন তাদের সব কিছুই ভারতের ত্রিপুরায়। ভাষা-সংস্কৃতির সাথেও ত্রিপুরার মিল বেশি। এছাড়া আত্মীস্বজন সেখানে। একারণেই অনেকে ভারতে চলে যেতে চায়।

একই মত চুনারুঘাটের রানীগাও ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য খলিলুর রহমানের। তিনি বলেন, তাদের সকলেই ত্রিপুরায় থাকে। তাই তারা সেখানে চলে যেতে চায়। তবে বনের কর্মকর্তারাও তাদের অনেক সময় নির্যাতন করে।

ছবি : খোকন সিংহ

আপনার মন্তব্য

আলোচিত