নিজস্ব প্রতিবেদক, চুনারুঘাট থেকে ফিরে

২৬ জুন, ২০১৬ ১৬:১৫

‘অত্যাচারে’, ‘অপমানে’ দেশ ছাড়তে চেয়েছিলেন ১৮৭ আদিবাসী

"আমাদের কোন জমি নেই, বনের জায়গায় বাস করি, বনেই কাজ করি। অথচ বনের বাবুরা আমাদের প্রতিনিয়ত মারধর করে, জমি ছেড়ে দিতে বলে। আমরা আর কোথায় যাব? তাই সীমান্ত পার হতে চেয়েছিলাম" 

রোববার (২৬ জুন) সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকমের সাথে আলাপকালে এমনটাই বললেন চুনারুঘাট উপজেলার কালেঙ্গা বনাঞ্চলে বসবাস করা ত্রিপুরা ও খাড়িয়া নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ।

বন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অত্যাচারের অভিযোগ এনে শনিবার (২৫ জুন) বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে চেয়েছিলেন ১৮৭ আদিবাসী। তাদের সকলেই ত্রিপুরা ও খাড়িয়া জাতিগোষ্ঠির। সকলেই হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার রেমা কালেঙ্গা রেঞ্জের সাতছড়া বনে বসবাস করেন। দেশ ছেড়ে ভারতের ত্রিপুরায় চলে যেতে শনিবার সকালে চুনারুঘাটের কালেঙ্গা সীমান্তে জড়ো হয়েছিলেন এই ১৮৭ আদিবাসী। দিনভর তাদের সাথে দফায় দফায় বৈঠকের পর রাতে তাদের ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয় বিজিবি।

জানা যায়, চুনারুঘাটের রেমা কালেঙ্গা রেঞ্জের সাতছড়ি ছনবাড়ি বনবিটের কালেঙ্গা বনের জমিতে প্রায় ৬শ’ আদিবাসী বসবাস করেন। দীর্ঘকাল পূর্ব থেকে বংশানুক্রমে তারা এই এলাকায় বসবাস করে আসছেন। এদরে মধ্যে নারী পুরুষ শিশুসহ ১৮৭ জন শনিবার সকালে ভারতের ত্রিপুরা পাড়ি দেওয়ার উদ্দেশ্যে কালেঙ্গা সীমান্ত জড়ো হন। তারা সীমান্তবর্তী ত্রিপুরা রাজ্যের খোয়াই জেলার চম্পাহোয়ার গ্রাম দিয়ে ভারতে প্রবেশের চেষ্টা করেন। সকালে ভারতীয় সীমান্তে ঢুকে পড়লে বিএসএফ তাদের আটক করে। পরে সন্ধ্যায় বিজিবি তাদের ফিরিয়ে নিয়ে আসে। বনবিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে ঝামেলাকে কেন্দ্র করে এই আধিবাসীরা অভিমানে ভারত চলে যেতে চেয়েছিলেন বলে জানা গেছে।

সংশ্লিস্ট সূত্রে জানা যায়, বংশানুক্রমে বসবাস করলেও জমিতে অধিকার নেই আদিবাসীদের। ফলে নিজেদের বাসস্থান নিয়ে প্রায়ই বনবিভাগের সাথে ঝামেলা লেগে থাকে। অনকে সময় বনবিভাগের কর্মকর্তাদের রোষানলে পড়ে উচ্ছেদও হতে হয়।

কেন ভারতে প্রবেশ করতে চেয়েছিলেন এমন প্রশ্নের জবাবে তপেস ত্রিপুরা বলেন, "বাবুরা কারণে অকারনে পিটায়, জমি ছেড়ে দিতে বলে, আমদের কোথাও যাওয়া জায়গা নেই তাই ওপারে যেতে চেয়েছিলাম"।

জানা যায়, রেমা কালেঙ্গা সংরক্ষিত বনাঞ্চল এলাকায় ত্রিপুরা ও খাড়িয়া  নৃ-গোষ্ঠীর প্রায় ৬০০ মানুষ দীর্ঘদিন বসবাস করে বনরক্ষক হিসেবে কাজ করেন। গত শুক্রবার বন কর্মকর্তারা তাদের উপর হামলা চালিয়ে বাড়িঘর ভাংচুর করে দেয় বলে অভিযোগ উঠে। কেবল তাই নয় উল্টো ৪ আদিবাসীকে পুলিশের হাতে তোলে দেয় বলেও অভিযোগ তাদের। এই ঘটনার পর নিরাপত্তার অভাবে তারা ভারতে ঢুকে যেতে চাইছিলেন।

এ ব্যাপারে সাতছড়ির ত্রিপুরা ও খাড়িয়া  নৃ-গোষ্ঠীর হেডম্যান মনিশ চন্দ্র বর্মণ সিলেটটুডে টোয়েন্টি ফোর ডটকমকে বলেন, "আমরা দীর্ঘদিন থেকে পরিবারসমেত এখানে বাস করছি। সম্প্রতি বন কর্মকর্তারা মারধোর করেছে। গত শুক্রবার আমাদের জমি ছেড়ে দিতে বলে বাড়ি ঘর ভাংচুর করে এবং আমাদের মধ্যে ৪ জনকে পুলিশে তোলে দেয়। এই অবস্থায়  থাকার জায়গা না পেয়ে আমাদের অনেকে অত্যাচারে অপমানে ভারতে চলে যেতে চেয়েছিল"।


তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেন বন বিভাগের ছন বাড়ি বিট কর্মকর্তা আব্দুল ওয়াদুদ। তিনি বলেন, "আদিবাসীদের মধ্যে পুরুষরা বনরক্ষক হিসেবে নিয়োজিত কিন্তু তারা ঠিক মত কাজ করতে চায় না,কাজে ফাঁকি দেয়। গত শুক্রবার এই নিয়ে তাদের  বকুনি দিলে তারা সংঘবদ্ধ হয়ে আমার বাড়ি ঘরে হামলা চালায়। হামলার পর আমি পুলিশকে জানালে পুলিশ তাদের মধ্য থেকে ৪ জনকে আটক করে"।

চুনারুঘাট উপজেলার পাইকপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান শামিম আহমদ সিলেটটুডে টোয়েন্টি ফোর ডটকমকে বলেন,  "বনের কর্মকর্তা আদিবাসিদের বিরক্ত করে, তাদের জমির নেই তাই তারা অন্য কোথায় যেতেও পারে না।"

রোববার  বিষয়টি সমাধানে বিজিবি ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বৈঠক করছেন বলে জানা গেছে।

এ ব্যাপারে চুনারুঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নির্মলেন্দু চৌধুরী বলেন, বনবিট কর্মকর্তার বাড়িঘর ভাংচুরের অভিযোগে ৪ জনকে আটক করা হয়েছিলো।

তবে তারা ভারত চলে যেতে চায় শুনে আমি সাতছড়িতে গিয়ে তাদের সাথে কথা বলে এসেছি। বলেছি, ভারত যাওয়া কোনো সমাধান নয়, আমাদের সমস্যা আমাদেরই সমাধান করতে হবে।

বিজিবির ৫৫ ব্যাটালিয়নের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাজ্জাদ হোসেন বলেন, "এরা সবাই সংরক্ষিত বনাঞ্চল কালেঙ্গা রেঞ্জে বসবাস করেন। শুক্রবার বনবিভাগের কর্মীদের সঙ্গে ঝামেলা হওয়ার পর তারা সীমান্তে গিয়ে বিএসএফের কাছে আশ্রয় চায়। তারা ফরেস্টের জমিতে বসবাস করে আসছে। উল্টা-পাল্টা কাজ করায় বিট অফিসার কয়েকজনকে গালিগালাজ দিলে তারা তার বাংলোয় হামলা করে। এরপর ৪ জনকে আটক করা হয়। সকালে তারা দলবেঁধে সীমান্তে যায়।" তাদের এভাবে বিএসএফের কাছে যাওয়ার পিছনে অন্য কারও ইন্ধন থাকতে পারে বলে সন্দেহ করছেন বিজিবি কর্মকর্তা সাজ্জাদ।

তিনি বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে তারা চেয়ারম্যান, মেম্বার বা পুলিশের কাছে যেতে পারত। তা না করে বিএসএফের কাছে যাওয়ার পিছনে কেউ বা কারো ইন্ধন থাকতে পারে।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত