নিজস্ব প্রতিবেদক

০৫ জুন, ২০১৭ ০০:৪৮

সিলেটে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ছাড়াই চলছে শতাধিক হাসপাতাল

হুমকিতে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য

ফাইল ছবি

সিলেট নগরীতে সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা শতাধিক। কিন্তু এগুলোর অধিকাংশেরই নিজস্ব কোনো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই। ক্লিনিক্যাল বর্জ্য বিশেষভাবে পরিশোধন করার বিধান থাকলেও এসব প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে তা করা হচ্ছে না। ফলে এসব ক্লিনিক্যাল বর্জ্য সাধারণ বর্জ্যের সঙ্গেই ডাম্পিং ইয়ার্ডে ফেলছে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। এতে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

সিলেট পরিবেশ অধিদপ্তর জানায়, পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৯৭-এর ১ নম্বর তফসিলে বলা আছে, পরিবেশের ছাড়পত্র ছাড়া কোনোভাবেই হাসপাতাল ও প্যাথলজিক্যাল সেন্টার গড়ে তোলা যাবে না। আর এসব প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্রের অন্যতম শর্তই হলো নিজস্ব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। পরিবেশ আইনে আরো বলা আছে, ক্লিনিক বা হাসপাতাল স্থাপনের আগে সুই, সিরিঞ্জ, প্লাস্টিকসহ ক্লিনিক্যাল বর্জ্য নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় অপসারণ করতে হবে। বিশেষ করে প্যাথলজিক্যাল তরল বর্জ্য পরিশোধনপূর্বক জীবাণুমুক্ত করে অপসারণ এবং তুলা, গজ, ব্যান্ডেজ ইত্যাদি পরিবেশসম্মতভাবে ইনসিনারেটরে পুড়িয়ে ফেলার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

কিন্তু সিলেটের হাসপাতালগুলো এসব নিয়ম মানছে না। খোদ সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেরও পরিবেশ অধিপ্তরের ছাড়পত্র নেই। সব মিলে সিলেট নগরীতে মাত্র ছয়টি বেসরকারি হাসপাতালের এ ছাড়পত্র রয়েছে।

পরিবেশ অধিপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নিজস্ব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা থাকা বাধ্যতামূলক। এক্ষেত্রে রোগীর বর্জ্য, ব্যবহৃত কাপড়, সিরিঞ্জ ইত্যাদি ধ্বংস বা অপসারণ করার ব্যবস্থা রাখতে হয়। ক্লিনিক্যাল বর্জ্য ধ্বংস করার জন্য থাকতে হয় ইনসিনারেটর ও অটোক্লেভ মেশিন। কিন্তু সিলেটের হাসপাতালগুলোয় এসব ব্যবস্থা নেই। বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনার সঙ্গেই উন্মুক্তভাবে এসব বর্জ্য ফেলা হয়।

সিলেট বিভাগের পরিচালকের (স্বাস্থ্য) কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্যমতে, সিলেট নগরীতে অনুমোদিত বেসরকারি হাসপাতাল আছে ৫৪টি। তবে অনুমোদন ছাড়া রয়েছে আরো অর্ধশতাধিক। এর মধ্যে ছয়টি ছাড়া বাকিগুলো এখনো পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেয়নি। ছাড়পত্র গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে— ইবনে সিনা হাসপাতাল, সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, নুরজাহান পলিক্লিনিক, অ্যালাইড ক্রিটিক্যাল কেয়ার হসপিটাল অ্যান্ড রিচার্স সেন্টার, পার্কভিউ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সিলেট আই হসপিটাল।

তবে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেটের সমন্বয়কারী শাহ শাহেদা আক্তার জানিয়েছেন, যেসব হাসপাতালকে পরিবেশ অধিদপ্তর অনুমোদন দিয়েছে, সেগুলোরও নিজস্ব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই।

শাহ শাহেদা আক্তার আরো বলেন, সিটি করপোরেশন ক্লিনিক্যাল বর্জ্য সংগ্রহ করে সাধারণ বর্জ্যের সঙ্গে নিজেদের ডাম্পিং গ্রাউন্ডে ফেলে দেয়। ফলে এসব ক্ষতিকর বর্জ্য দক্ষিণ সুরমার ডাম্পিং ইয়ার্ড থেকে আশপাশের হাওরগুলোয় ছড়িয়ে পড়ছে। এতে হুকমির মুখে রয়েছে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ।

তবে হাসপাতাল মালিকরা জানিয়েছেন, নিজস্ব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা অনেক ব্যয়বহুল। তাই সিটি করপোরেশনের সঙ্গে তারা চুক্তি করেছেন। সিটি করপোরেশন নগরীর সব হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল বর্জ্য সংগ্রহের পর অপসারণ করে।

কয়েকজন হাসপাতাল মালিক জানান, একটি ইনসিনারেটর মেশিন বসাতে ৪-৫ কোটি টাকা লাগে। চট্টগ্রামে সরকারিভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সুবিধা রয়েছে। সিলেটেও সরকারিভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাগার স্থাপন করার দাবি তাদের।

একই কথা জানিয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেটের পরিচালক মো. ছালাহ উদ্দিন বলেন, ‘সিটি করপোরেশন ক্লিনিক্যাল বর্জ্যগুলো ধ্বংস না করে সরাসরি ডাম্পিং করে, যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।’

তিনি জানান, সব হাসপাতালকেই নিজস্ব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করার জন্য চাপ দেয়া হয়। কিন্তু লোকবল সংকটের কারণে বিষয়টি সবসময় পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয় না।

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও পুরকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান জহির বিন আলম বলেন, ‘আমি সিলেটের অনেকগুলো ক্লিনিক ঘুরে দেখেছি। সব ক্লিনিকই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা। এগুলোয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সুযোগ রাখা হয়নি। এখন তারা চাইলেও আর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বা ইনসিনারেটর বসাতে পারবে না। হাতেগোনা কয়েকটিতে অটোক্লেভ মেশিন থাকলেও তা নষ্ট।’ তিনি আরো জানান, ফেলে দেয়া বর্জ্য থেকে শিশুরা ব্যবহৃত সিরিঞ্জ কুড়িয়ে নেয়, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাছাড়া প্যাথলজিক্যাল জীবাণু সহজে নষ্ট হয় না। তাই এভাবে যেখানে সেখানে এসব বর্জ্য ফেলায় আমাদের শরীরে নানা রোগ-জীবাণু প্রবেশ করছে।

আর সিসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এনামুল হাবীব বলেন, ‘আমরা নগরীর হাসপাতালগুলোর বর্জ্য বিশেষ পলিথিনে সংগ্রহ করে দক্ষিণ সুরমার ডাম্পিং স্টেশনে আলাদা করে ফেলি। সাধারণ বর্জ্যের সঙ্গে তা মিশতে দিই না। তাছাড়া ডাম্পিং স্টেশনের চারপাশে সীমানা দেয়াল থাকায় পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ক্ষতির শঙ্কা নেই। তবে অর্থের অভাবে আমরা ইনসিনারেটর মেশিন বসাতে পারছি না। বিষয়টি আমাদের পরিকল্পনার মধ্যে আছে।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত