উত্তম কাব্য

২৪ মার্চ, ২০১৮ ১৮:১৬

ফের প্রাণচঞ্চল আতিয়া মহল

২০১৭ সালের ২৩ মার্চ রাত। হঠাৎ পুলিশ ঘিরে ফেলে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি এলাকার বহুতল ভবনের একটি ফ্ল্যাট। সেই ফ্ল্যাটে জঙ্গি থাকতে পারে এমন তথ্যে ওই ভবনে যায় পুলিশ। এরপরের ঘটনা পরিক্রমায় আতিয়া মহল নামের সেই ভবন নাম জেনে গেছেন দেশের সবাই। আতঙ্কজাগানিয়া এক নাম হয়ে ওঠে আতিয়া মহল।

ঠিক একবছর আগে, গতবছরের ২৪ মার্চ, ভয়ঙ্কর এক জঙ্গি আস্তানার সন্ধান মেলে ওই ভবনে। পুলিশ, সোয়াটের পর সেনাবাহিনীর কমান্ডো দল টানা ১১১ ঘন্টা অভিযান চালায় আতিয়া মহলে। চরম উত্তেজনার সে অভিযান শেষে উদ্ধার উদ্ধার হয় চার জঙ্গির লাশ। আর আতিয়া মহলের বাইরে জঙ্গিদের বোমা বিস্ফোরণে র্যাব-পুলিশ কর্মকর্তাসহ ৭ জন নিহত হন।

সেই অভিযানে ঝাঝরা হয়ে যায় ৫ তলা বিশিষ্ট আতিয়া মহল। আটকে পড়াদের উদ্ধার আর জঙ্গিদের দমনে ভেঙ্গে ফেলা হয় ভবনের বেশিরভাগ অংশ। গ্রেণেড-বোমায় ভস্মিভূত হয়ে পড়ে অংশ। এছাড়া এ ঘটনার পর এই ভবনকে ঘিরে ওই এলাকায় দেখা দেয় আতঙ্ক।

তবে একবছর পেরোনোর আগেই সেই ক্ষত সারিয়ে ফের জেগেছে আতিয়া মহল। আতঙ্ক কাটিয়ে আবার এই ভবনে উঠেছে ২৮ টি পরিবার। যে ফ্ল্যাটটিতে জঙ্গিরা আস্তানা গেড়েছিলো সেই ফ্ল্যাটেও উঠেছেন নতুন ভাড়াটিয়া।

শনিবার আতিয়া মহলে গিয়ে দেখা দেছে, আলোচিত এই ভবনে ফের ফিরে এসেছে প্রাণচাঞ্চল্য। জানালা দরজা গ্রিল, গুলি লেগে যেসব দেয়াল ছিদ্র হয়েছিল, ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিলো যেগুলো- তা এখন পুরোপুরি ঠিকঠাক। আছে আগের সেই হালকা সবুজ রঙও। কেবল বিস্ফোরণে উড়ে যাওয়া আতিয়া মহলের ফটকটি এখনো লাগানো হয়নি। ভাঙ্গাচুরা আর অগ্নিগদ্ধ এই ভবন সংস্কার করে নতুন ভাড়াটিয়া তোলা হয়েছে। জঙ্গিদের কাছে দীর্ঘসময় জিম্মি থেকে রূদ্ধশ্বাস অভিযানে উদ্ধার হওয়ার আতঙ্ক ভুলে পুরোনো ভাড়াটিয়াদের ৪টি পরিবারও আবার ফিরেছে এ ভবনে।

আতিয়া মহলের নিচ তালায় যে ফ্ল্যাটে জঙ্গিরা আস্তানা গড়েছিলো সে ফ্ল্যাটে গত ডিসেম্বরে ভাড়াটিয়া হয়ে এসেছেন ফাতেমা নাজিরের পরিবার।

ফাতেমা সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আমি গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর এই ফ্ল্যাটে ওঠি। এর আগে আমরা পাশের একটা বিল্ডিংয়ে ছিলাম। মা বোন ও ২ ছেলেমেয়েকে নিয়ে এখানে থাকি।

তিনি বলেন, জঙ্গিরা যখন ছিল তখন ছিল, এখনতো আর নেই। এখানে আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

জংগীদের পাশের ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া দুলাল হোসেনবলেন, ,আমরা এখানে নিরাপদে আছি। তাছাড়া আমাদের বাড়িওয়ালা সব সময় আমাদের খোঁজ খবর রাখেন।

জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পাওয়ার সময় এই ভবনে ২৮ পরিবার ভাড়া ছিলো। এরমধ্যে আগের  ৪টি পরিবার পুণরায় আতিয়া মহলে ফিরে এসেছে।

আবার ফিসে আসা তারেক আহমদ সেদিনের ঘটনার কথা মনে করে সিলেটটুডের টোয়েন্টিফোর ডটমকমকে বলেন, ২৩ মার্চ রাতেই পুরো ভবন পুলিশ ঘিরে ফেলে। তবে আমরা জানতে পারি ২৪ তারিখ দিনে।আমার আম্মু ঘুম থেকে ওঠেই চারদিকে পুলিশ দেখতে পান। এতে আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। পরদিন সেনাবাহিনী আমাদের উদ্ধার করে। তবে এরআগের ২৪ ঘন্টা খুব আতঙ্কে ছিলাম। মনে হচ্ছিলো এটাই জীবনের শেষ দিন।

তিনি বলেন, এখনো মাঝে মাঝে সে আতঙ্ক তাড়া দেয়। তবে এখন আমরা ভালই আছি এখানে।

আতিয়া মহলের অভিযান দেখতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন স্থানীয় পৈত্যপাড়া এলাকার বাসিন্দা শিবুল কর। তিনি বলেন, আমি পায়ের পিছন দিকে গুলি খাই। আজও আমি পুরোপুরি সুস্থ না। প্রায় ৬ দিন আমি হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম।

আতিয়া মহলের সত্ত্বাধিকারী উস্তার মিয়া। ওই ভবনের পাশেই তার বাড়ি। জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পাওয়ার পর আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর জিঙ্গাসাবাদের মুখে পড়তে হয় তাকে।  

নিজের বিশাল ভবন ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়া, ভবন নিয়ে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়া, তার উপর পুলিশী ঝামেলা। তবে দুঃস্বপ্নের সেইসব দিন পেরিয়ে এসেছন তিনি।

উস্তার মিয়া সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ওই দিনটা সত্যিই আমাদের জন্য একটা খারাপ দিন ছিল। এ ঘটনার প্রায় ৩ মাস পর ভবনটি আমাদের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয়। তখন পুরো ভবনটি অনেকটা ধ্বংস্তুপের মতো ছিলো। পরে দ্রুত কাজ চালিয়ে গত ডিসেম্বরে এর সংস্কার সম্পন্ন হয়। এতে প্রায় ৬০ লাখ টাকা খরচ হয়।

তিনি বলেন, আমি আগেও সকল ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে তাদের ভোটার আইডি র্কাডের ফটোকপিসহ সকল প্রকার তথ্য রাখতাম এখন আরো ভালভাবে যাচাই করে তা সংগ্রহ করি। এবং ভাড়াটিয়া তথ্য সংশ্লিস্ট থানায়ও প্রদান করি।

তাছাড়া ঘটনার পর থেকে এখন পর্যন্ত পুলিশ মাঝে মাঝে আতিয়া মহলের চারপাশ টহল দিয়ে যায়।

গত বছর এই সময়ে জঙ্গি আতঙ্কে ছিলো পুরো শিববাড়ি এলাকা।  গুলি-বোমার শব্দে টানা কয়েকদিন থমথমে ছিলো পুরো এলাকা। এখন অবস্থা অনেকটাই বদলেছে। ফিরেছে স্বাভাবিক অবস্থা।

শিববাড়ী এলাকার গৃহিনী অর্পণা দে বলেন, সে সময় অনেকেই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলো। আমরাও আতঙ্কে সিলেট শহরে চলে যাই। এখন আতঙ্ক না থাকলেও সেই দিনগুলোর কথা এখনো মনে পড়ে।

তদন্তে নেই অগ্রগতি: আতিয়া মহলে জঙ্গিবিরোধী অভিযান এবং অভিযান চলাকালে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় দায়েরকৃত দুটি মামলায় এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি নেই।

আতিয়া মহলে জঙ্গিবিরোধী অভিযান এবং অভিযান চলাকালে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। মামলার তদন্তভার প্রথমে পুলিশের হাতে থাকলেও পরে তা স্থানান্তর করা হয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) হাতে। কিন্তু এরপর বেশ কিছুটা সময় পেরিয়ে গেলেও তদন্তে দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি নেই। এখনও পর্যন্ত আতিয়া মহলে নিহত চার জঙ্গির মধ্যে মাত্র একজনের পরিচয় সনাক্ত করা হয়েছে।

সিলেটে পিবিআইয়ের বিশেষ পুলিশ সুপার রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, ‘গত বছরের মে মাসে মামলা দুটি আমরা পাই। এখনও তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত আছে। আতিয়া মহলে নিহত চার জঙ্গির মধ্যে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে মর্জিনার পরিচয় সনাক্ত করা হয়। আতিয়া মহলে প্রাপ্ত বিস্ফোরকের রাসায়নিক পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়া গেছে, এগুলো শক্তিশালী বিস্ফোরক ছিল।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত