এস আলম সুমন, কুলাউড়া

২৬ মার্চ, ২০১৮ ১৮:৫৭

শুদ্ধ জাতীয় সংগীতের ফেরিওয়ালা

৫৫ ছুঁই ছুঁই চা শ্রমিকের সন্তান সুদর্শন রবিদাস ইতিমধ্যে সারা দেশে ৬৫২টি প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে শুদ্ধভাবে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত গাওয়ার নিয়মাবলী শিখিয়েছেন। কোন পারিশ্রমিক ছাড়াই রবিদাস এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্তে পায়ে হেঁটে বিগত পাঁচ বছর থেকে শুদ্ধ জাতীয় সংগীত শিখানোর মিশনে কাজ করছেন।

তাঁর মতে বিদ্যালয়ে অ্যাসেম্বলিতে জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় সুর, তাল ও লয়ে ভুল থাকে। এ ভুলগুলো মানতে নারাজ সুদর্শন রবিদাস। তাই উচ্চারণ সঠিক করে জাতীয় সংগীত শেখানোর কাজে ২০১৩ সালের ১৭ মার্চ থেকে যাত্রা শুরু করেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানেরা এ কাজে তাঁকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। কখনো সাতসকালে, কখনো দুপুর বেলা তিনি ছুটে চলেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। শেখান দেশাত্মবোধক ও ছড়াগান। দেশমাতৃকার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে অবিরাম ছুটে চলা এই মানুষটি হলেন সুদর্শন রবিদাস।

কোন পারিশ্রমিক ব্যতীত নিজের দায়বদ্ধতা থেকে জাতীয় সংগীত তালিম দিয়ে চলেছেন বলে তিনি জানান। কুলাউড়ার উপজেলার রাঙ্গিছড়া চা-বাগানের দেবমণ্ডপ লাইনে স্ত্রী ও চার ছেলে নিয়ে তার অভাবের সংসার। এক ছেলে তার সহকারী হিসেবে কাজ করে বাকী ৩ ছেলে প্রতিদিন ৮৫ টাকা মজুরীতে চা বাগানে কাজ করে। অভাব অনটনের মাঝে বেড়ে ওঠা এ মানুষটির শৈশব থেকে সংগীতের প্রতি অপরিসীম টান।

রবিদাস সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, আট বছর বয়সে সংগীত জগতে পা রাখেন তিনি। কাকা রাম নারায়ণ রবিদাসের হাত ধরে সংগীত শুরু করেন। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন শিক্ষকদের কাছ থেকে সংগীত শিক্ষা লাভ করতে শুরু করেন। ১৯৯২ সালে লংলা চা বাগানে সপ্তসুর সংগীত বিদ্যালয় ভর্তি হন। দীর্ঘ আট কিলোমিটার পথ হেটে সে বিদ্যালয়ে গানের ক্লাসে অংশ নিতেন তিনি। বিদ্যালয়ে সুদর্শন রবিদাসের সংগীতে দৃঢ় দখল ও সুরে মুগ্ধ হয়ে সপ্তসুর সংগীত বিদ্যালয়ের পরিচালক সুরকার নুরুল ইসলাম সরকারের সহযোগিতায় ১৯৯৩ সালে সিলেট বেতারে শতদল নামে সংগীত পরিবেশন করেন। হঠাৎ সপ্তসুর সংগীত বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়াতে ১৯৯৪ সালে কুলাউড়ায় ডা. রজত কান্তির প্রতিষ্ঠিত রুদ্রবীণা সংগীত বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে একাধারে পাঁচটি বছর নজরুল পঞ্চম কোর্স সমাপন করে দ্বিতীয় অধ্যায় সমাপ্ত করেন। ওই বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় বাংলাদেশ মহাবিদ্যালয় ধ্রুপদী সংগীত বিদ্যালয়ে ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ সাল তিন বছর মেয়াদী কোর্স সংগীত ‘মুকুল’ সমাপ্তি করেন।

এরই পাশাপাশি সংগীত ‘উপাধি’ কোর্স সমাপন করেন। ২০০১ সাল থেকে কুলাউড়া পৌর এলাকার মাগুরা নামক স্থানে প্রতিষ্ঠিত রবিদ্রবীণা সংগীত বিদ্যালয়ে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। সংগীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের গান শেখানোর পাশাপাশি একেক দিন একেক বিদ্যালয়ে যেয়ে চলে শুদ্ধ করে জাতীয় সংগীত শেখানো।

এরপর তিনি লক্ষ্য করেন বিভিন্ন স্কুলের অ্যাসেম্বলিতে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা ভুল সুর, তাল, লয়ে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করে থাকে। এ বিষয়টি তাঁর মনে নাড়া দেয়। ভাবতে থাকেন কেমন করে শিক্ষার্থীদের জাতীয় সংগীত শুদ্বরূপে শেখানো যায়? ভাবনার সাথে সাথে বাস্তবায়নের পথে পা বাড়ান। বিভিন্ন স্কুলের প্রধান শিক্ষকবৃন্দের সাথে যোগাযোগ করে কার্যক্রমে হাত দেন। ২০১৩ সাল থেকে ব্যাপক পরিসরে শুরু হয় তার শুদ্ধ সুর, লয়, তালে জাতীয় সংগীত শেখানোর পালা। জেলার মক্তদীর বালিকা বিদ্যালয়, দক্ষিণ জাঙ্গিরাই মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আমির সলফু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় ৬৫২টি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শুদ্ধভাবে বিনা পারিশ্রমিকে জাতীয় সংগীত শিখিয়েছেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণায় দিনদিন তার কার্যক্রম এগিয়ে চলেছে।

সাংসারিক অভাব অনটনকে পেছনে ফেলে সপ্তাহের ২/৩ দিন জাতীয় সংগীতের মহাত্ম বুকে ধারণ করে ছুটে যান একেক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সান্নিধ্যে। তালিম দেন জাতীয় সংগীত। তাঁর ছেলে রাধেশ্যাম তাঁকে তবলা বাজিয়ে সহযোগিতা করে। সুদর্শন জীবন জীবিকার তাগিদে রবিদ্রবীণাও বিভিন্ন বাসায় যেয়ে ছোট্টমণিদের সংগীতের প্রশিক্ষণ দেন। জাতীয় সংগীতের সাথে তাদের আরও শেখান ছড়াগান ও দেশাত্মবোধক গান। তাঁর জাতীয় সংগীতের তালিম পেয়ে খুশী শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকবৃন্দের অনেকে।

সুদর্শন রবিদাস জানান, শহীদের রক্তস্রোতে অর্জিত স্বাধীনতার জাতীয় পতাকা ও সংগীত দেশ মাতৃকার মানুষের গর্বের ধন। এর ভুল কন্ঠশৈলী যে তাকে ব্যথিত করে। দেশ মাতৃকার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে জাতীয় সংগীত শুদ্ধভাবে শিখিয়ে দিচ্ছেন। এতে দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে বলে তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন।

তিনি আরও জানান, বিদ্যালয়ে অ্যাসেম্বলির সময় জাতীয় সংগীত দায়সারাভাবে গাওয়া হয়। এসব দেখে খুব কষ্ট লাগত। সেই কষ্টবোধ থেকেই ২০১৩ সালের মার্চে এই যাত্রা শুরু করি। কিন্ডারগার্টেন, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিক্ষার্থীদের জাতীয় সংগীত শেখাচ্ছি। তবে কোনো পারিশ্রমিক নেই না।

রবিদাসের ইচ্ছা সারা বাংলাদেশে জাতীয় সংগীত শেখাবেন কিন্তু যাতায়াতের খরচ মিটাতে পারবেন না বলে তিনি তা পারছেন না। এই বয়সে সুযোগ সুবিধা পেলেও কিভাবে সারা দেশে শেখাবেন? রবি দাসের উত্তর, আমার সে আত্মবিশ্বাস আছে আমি পারব, সহযোগিতা পেলে সারা দেশে চষে বেড়াব সাথে আমার সহকারী রাখব।

জেলার কুলাউড়ার রুদ্রবীণা সংগীত বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ রজত কান্তি ভট্টাচার্য বলেন, ‘সুদর্শন শুদ্ধ জাতীয় সংগীত শেখান। তাঁর তাল, লয় ও সুর ঠিক আছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করার আবেদন জানালেন মৌলভীবাজারের জাতীয় সংগীতের ফেরিওয়ালা নামে খ্যাত সুদর্শন রবিদাস। বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ভালো নেই রবিদাস। তাঁর বিশ্বাস প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসলে অবশ্যই তার আবেদন গ্রহণ করে দেখা করার সুযোগ দেবেন এবং সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দেবেন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত