রিপন দে, মৌলভীবাজার

২২ মে, ২০১৮ ১৫:৩৬

ধ্বংস হচ্ছে লাউয়াছড়ার বন ও প্রাণিকুল

নানা জাতের উদ্ভিদ আর জীববৈচিত্র্যে ভরপুর ১২৫০ হেক্টর সংরক্ষিত বন নিয়ে ১৯৯৬ সালে মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়াকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয়। দেশের অন্যতম সংরক্ষিত বনাঞ্চল এই লাউয়াছড়া উদ্যান। কিন্তু এই বন থেকে পাচার হচ্ছে কোটি কোটি টাকার মূল্যবান গাছ। উজাড় হচ্ছে বন। ধ্বংস হচ্ছে প্রকৃতি ও পরিবেশ হুমকির মুখে পড়ছে বন্যপ্রাণি। লোকবল আর প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবে অসহায় কর্তৃপক্ষ।

খাসিয়া সম্প্রদায়সহ স্থানীয়দের মতে, ১৯৯৬ সালে জাতীয় উদ্যান ঘোষণার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বনের প্রায় ত্রিশ শতাংশ গাছ পাচার হয়েছে। ফলে কমেছে বনের ঘনত্ব। এখন গাছ পাচারকারীদের জন্য উদ্যানটি রীতিমতো হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। গত সপ্তাহে গভীর রাতে লাউয়াছড়া বন থেকে মূল্যবান আগর গাছ কেটে নিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে পাহাড়ে বসবাসরত খাসিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনের ধাওয়ায় টুকরো করে রাখা মূল্যবান আগর গাছগুলো ফেলে রেখে পালিয়ে যায় চোরচক্র। পরে খাসিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনের সহায়তায় মূল্যবান এসব গাছ উদ্ধার করে বন বিভাগ।

রাতের আঁধারে সিন্ডিকেট গাছ চোরচক্র বিভিন্ন সময়ে উদ্যান ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে গাছ কেটে পাচার করে আসছিল বছরের পর বছর কিন্তু বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় সহকারী বন কর্মকর্তা মো. তবিবুর রহমান এবং বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মিহির কুমার দো নিয়োগ পাওয়ার পর বদলে যায় লাউয়াছড়ার দৃশ্য। বন বিভাগের কর্মকর্তাদের ব্যাপক তৎপরতার কারণে গাছ চুরি হ্রাস পায়। কিন্তু অদৃশ্য শক্তির কারণে ভাল কাজ করেও পরিবেশবাদীদের চাওয়ার বিপরীতে গিয়ে বদলি করা হয় তবিবুর রহমান ও মিহির কুমার দোকে । তাদের বদলির পর আবারো বাড়তে থাকে গাছ চুরি। সংঘবদ্ধ গাছ চোরচক্র প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় আবারো সক্রিয় হয়ে উঠে।

অভিযোগ আছে স্থানীয় এক প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতার পরিবারের ছত্রছায়ায় চোরচক্র সক্রিয় রয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের শুধু গাড়িভাঙ্গা এলাকা থেকে তিনটি বৃহদাকার সেগুন গাছ কেটে পাচার করেছে দুর্বৃত্তরা। ওই স্থানে কালের সাক্ষী হয়ে আছে গাছের গুড়ি।

দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে গাছ পাচারের ফলে লাউয়াছড়া উদ্যান অনেকটাই ফাঁকা হয়ে গেছে। ফলে বিরল প্রজাতির বন্যপ্রাণিসহ উদ্যানে অবস্থানরত প্রাণির বাসস্থান সংকট প্রকট হচ্ছে। খাবার ও আবাসস্থল সংকটে হুমকির মুখে পড়েছে প্রাণি।

বিভাগীয় বন কার্যালায় সূত্রে জানা যায়, মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া, বাঘমারা আর জানকিছাড়ার ১২৫০ হেক্টর সংরক্ষিত বন নিয়ে ১৯৯৬ সালে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয়। দেশের ১৬টি উদ্যানের মধ্যে অন্যতম এই লাউয়াছড়া উদ্যান। এ যাবতকালের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এই বনে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ সনাক্ত করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য উদ্ভিদের মধ্যে চাপালিশ, সেগুন, গর্জন, লোহাকাঠ, রক্তন, চন্দন, আমলকি, হরিতকি, বহেরা, অর্জুন, ডুমুর, বট আউয়াল, জারুল ইত্যাদি। তাছাড়া এই বনে আছে লতাগুল্ম, বিভিন্ন প্রজাতির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র উদ্ভিদ প্রজাতিসহ অর্কিড, ছত্রাক, মস, ফার্ন ও সাইকাস। এই বনে প্রায় ৭(সাত) প্রজাতির বাঁশ পাওয়া যায়। তন্মধ্যে মূলী, উড়া, ডলু, টেংরা, বাইজা উল্লেখযোগ্য। এই বনে বেত খুবই সমৃদ্ধ। গোল্লা, ছাঁচি, জালি ইত্যাদি প্রজাতির বেত আছে।

সমৃদ্ধ প্রাণী বৈচিত্র্যের আঁধার এই বন। বিভিন্ন বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসাবে এই বন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশেষভাবে পরিচিতি লাভ করেছে। লাউয়াছড়া বনে ৩৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৫৯ প্রজাতির সরীসৃপ (৩৯ প্রজাতির সাপ, ১৮ প্রজাতির লিজার্ড, ২ প্রজাতির কচ্ছপ, ২২ প্রজাতির উভচর, ও ২৪৬ প্রজাতির পাখি, ১৬৭ প্রজাতির প্রজাপতি ও অসংখ্য কীটপতঙ্গ পাওয়া যায়। তার মধ্যে উল্লুক, মুখপোড়া হনুমান , চশমাপড়া হনুমান উল্লেখযোগ্য। অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে খাটোলেজি বানর, মুখপোড়া হনুমান, লজ্জাবতী বানর, রেসাস বানর, মায়া হরিণ, বন্যশুকুর, শেয়াল, অজগর, পিট ভাইপার, গুইসাপ, হলুদ পাহাড়ি কচ্ছপ, টিকটিকি, গিরগিটি, তক্ষক ইত্যাদি। বিপন্ন প্রজাতির উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বন মোরগ, মথুরা, সবুজ ঘুঘু, ময়না, ধনেশ, টিয়া, হরিকল ইত্যাদি।

প্রতিনিয়তই দ্রুতগামী গাড়ির ধাক্কায় কিংবা চাকায় পিষ্ট হয়ে কোনো না কোনো বনপ্রাণির মৃত্যু হচ্ছে। ফলে লাউয়াছড়ার অভ্যন্তরে অবস্থিত সড়ক ও রেলপথসমূহ বন্যপ্রাণীকুলের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও ছুটির সময়ে মাত্রাতিরিক্ত পর্যটকদের কারণে বনের বন্যপ্রাণির বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যানবাহনের হুড়োহুড়ি, শুষ্ক মৌসুমে প্রাকৃতিক পানি, খাবার ও নিরাপদ বাসস্থান সংকট, এসব মিলিয়ে উদ্যানের জীব-বৈচিত্র্য ও প্রকৃতি সুরক্ষা নিয়ে উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। খাদ্য সংকটের কারণে প্রায়ই বন্যপ্রাণি লোকালয়ে চলে আসছে। ধরা পড়ছে মানুষের হাতে।

গত বছর লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান পরিদর্শনে আসেন পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব। তখন তিনি বলেছিলেন, বন্যপ্রাণির অভয়ারণ্য হিসেবে লাউয়াছড়ার ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে এখানে পর্যটকদের জন্য নীতিমালা নির্ধারণ করা হবে। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় লাউয়াছড়ার মধ্য থেকে রেল ও সড়ক পথের বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে যথাযথ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।

সেই ঘোষণার পর বছর ঘুরে এলেও আসেনি কোন নীতিমালা।

উদ্যানের গাঁ ঘেষে বনজঙ্গল ও মাটি কেটে স্থাপিত হচ্ছে বিভিন্ন কটেজ। ফলে বনের ভেতরে দল বেঁধে মানুষের অবাধ বিচরণ বন্যপাণীর জন্য খাবার সংগ্রহ ও চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। এসব বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ফলে বন্যপ্রাণির খাবার ও আবাসস্থল বিনষ্ট হচ্ছে। যে কারণে খাবারের সন্ধানে জঙ্গলের দুর্লভ প্রাণিগুলো জনপদে ছুটে এসে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষের হাতে ধরা পড়ে অথবা গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা যাচ্ছে।

বাইরে থেকে এই ঘন বনের সৌন্দর্য মন কাড়ে দর্শনার্থীদের। কিন্তু বনের ভিতরে গেলে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। দাঁড়ানো মূল্যবান গাছের ফাঁকে ফাঁকে মোথা পড়ে আছে। প্রতিদিন দিনে দুপুরে জ্বালানি হিসেবে গাছ কেটে কাঠ নিয়ে যাচ্ছেন অনেকে। রাতের আঁধারে আস্ত গাছ উদার হচ্ছে বন থেকে। ধংস হচ্ছে প্রাকৃতিক এই ঘন বন। গাছ চুরি বন্ধে পরিবেশবাদী সংগঠনসহ সচেতন মহল সোচ্চার থাকলেও টনক নড়ছে না কর্তৃপক্ষের। আর লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের সহ ব্যবস্থাপনা কমিটির দায়িত্বে যারা আছে তারাও উদাসীন এই বনের প্রতি।

ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ জানান, গহীন এই বন রক্ষায় স্থানীয় মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধিসহ বনের উপর নির্ভরশীলদের কর্মসংস্থান প্রয়োজন। তবে মানুষ আগের চেয়ে অনেক সচেতন হয়েছে। জনবল সংকটের কারণে বন বিভাগ ঠিক মত কাজ করতে পারছে না। পর্যাপ্ত যানবাহন, আগ্নেয়াস্ত্র আর প্রয়োজনীয় লোকবল না থাকায় এই বিশাল বন সঠিকভাবে পাহারা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে স্বীকার করেন বিট কর্মকর্তা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান রক্ষায় গাছ চুরি বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি সচেতন মহলের।

বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বন কর্মকর্তা আবু মুছা শামসুল মোহিত চৌধুরী বলেন, ‘লোকবল কম থাকায় অনেক সময় আমরা সামাল দিতে পারি না। তবে এখন থেকে নির্দিষ্ট স্থানের বাইরে পর্যটকদের যেতে দেয়া হবে না এবং ভবিষ্যতে নিয়ন্ত্রিত ট্যুরিজমের ব্যবস্থা করা হবে বলে জানান তিনি। এর জন্য সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত