রিপন দে

২৬ আগস্ট, ২০১৮ ১৪:৩১

অস্তিত্ব সংকটে চশমাপরা হনুমান

প্রাণিবৈচিত্র্যে ভরপুর আমাদের এই বাংলাদেশ। দেশীয় বানর আর হনুমান আমাদের প্রাণিবৈচিত্র্যে যোগ করেছে অনন্য মাত্রা। কিন্তু প্রকৃতির ভারসাম্যহীনতায় ভেঙে পড়েছে তাদের খাদ্যশৃঙ্খল। ফলে সংকটাপন্ন হচ্ছে এই খাদ্যশৃঙ্খলের অধিভুক্ত প্রাণীরা।

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে প্রায় ৩ দশকে বাংলাদেশে প্রায় ৮০ শতাংশ কমে গেছে চশমাপরা হনুমানের সংখ্যা। এ প্রজাতির হনুমানের মাত্র তিন প্রজন্ম পার করতেই (প্রতি প্রজন্ম = ১০-১২ বছর) এ পরিমাণ কমে যাওয়ায় গবেষকদের আশংকা এইভাবে চলতে থাকলে আরো ২/৩ প্রজন্ম পরেই এরা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তাই এখনি ব্যবস্থা নিয়ে বিপন্ন প্রজাতির এ প্রাণীকে রক্ষা করতে হবে।

চশমাপরা হনুমান বিপন্ন হলে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বনায়নের জন্য মারাত্মক হুমকি হবে কারণ এদের খাদ্যের ১৪ শতাংশ ফল ও বীজ। খাদ্য গ্রহণ শেষে ফলের বীজ বনের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই হনুমান, যা মূলত বনকে নতুন জীবন দান করে।

এদের চোখের চারপাশে গোলাকার বৃত্তের মতো সাদা রং থাকে বলে এদের চশমা পরা হনুমান বলে তবে শরীরের বেশিরভাগ অংশই কালো রঙের। এরা মহা বিপন্ন তালিকাভুক্ত প্রাণী। এদের ইংরেজি নাম Phayre’s Leaf Monkey বা Phayre’s Langur বৈজ্ঞানিক নাম Trachypithecus phayrei।

ঘন চিরসবুজ বনের বাসিন্দা নিরামিষভোজী চশমাপরা হনুমান পাতা, ফুল ও ফল পোকামাকড় এগুলোও খায়। এরা দল নিয়ে চলাফেরা করে সে দলে অনেক গুলো মেয়ে থাকে এবং দলের নেতৃত্বে থাকে একটা শক্তিশালী পুরুষ এই পুরুষটিই প্রজনন বৃদ্ধিতে ভূমিকা পালন করে।এই প্রাণী সাধারণত শব্দ করে কম। তবে বিপদের সন্মুখিন হলে ভয়ংকর শব্দ করে থাকে, যেটাকে অ্যালার্ম কল বলা হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে ৩ প্রজাতির হনুমানের অন্যতম সুন্দর  হনুমান হচ্ছে চশমাপরা হনুমান ।এদের সিলেট ও চিটাগাং বিভাগের বেশ কিছু বনে পাওয়া যায় তাছাড়াও ভারত, মায়ানমার, চীন, থাইল্যান্ড, লাউস ও ভিয়েতনামে পাওয়া যায়। ২০১৫ সালের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইইউসিএন এই প্রাণীকে পৃথিবীব্যাপী বিপন্ন এবং বাংলাদেশে মহা বিপন্ন হিসেবে উল্লেখ করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলজিক্যাল এন্থ্রোপোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. ক্রেইগ স্ট্যানফোর্ড বাংলাদেশের হনুমান নিয়ে ১৯৯০ সালে পিএইচডি করেন,  তিনিই ১৯৮৮ সালে প্রথম বাংলাদেশের এই চশমাপরা হনুমানের ইকোলজি নিয়ে প্রাইমেট কনজারভেসন জার্নালে গবেষণাপত্র লিখেছিলেন। তখন চশমাপরা হনুমানের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৩০০। তবে গত প্রায় চার দশকে এই প্রাণীর সংখ্যা ৮০ শতাংশ কমে এসেছে।

চলতি বছরে জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া একটি গবেষণায় এখন পর্যন্ত মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া ও হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে ১৩ টা গ্রুপে মোট ১৪৫ টার মত হনুমান পাওয়া গেছে।

তবে এ গবেষণা চলবে এ বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত।  জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. হাবিবুন নাহারের তত্ত্বাবধানে শুরু হওয়া এ গবেষণায় কাজ করছেন  Wildlife and Biodiversity Conservation নিয়ে সদ্য মাস্টার্স শেষ করা তানভীর আহমেদ, একই বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মোঃ সাবিত হাসান ও তৃতীয় বর্ষের শিমুল নাথ এছাড়াও ২য় বর্ষের কয়েকজন শিক্ষার্থী বিভিন্ন সময় সহকারী হিসাবে কাজ করেছেন।

বাংলাদেশ বনবিভাগের সযোগিতায় যুক্তরাজ্যের The Rufford Foundation -এর সামান্য আর্থিক অনুদানে  বাংলাদেশের মহা বিপন্ন এই হনুমান নিয়ে শুরু হওয়া "Status and Conservation Initiative of Phayre’s Langur in Northeast Bangladesh" নামে এই প্রকল্পে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন সংযুক্ত আরব আমিরাত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব বায়োলজিক্যাল সাইন্সের সহযোগী অধ্যাপক ড. সাবির বিন মুজাফফর।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. হাবিবুন নাহার জানান, চশমাপরা হনুমানের মাথা ও শরীরের দৈর্ঘ্য সাধারণত ৫৩ সেমি. এবং লেজের দৈর্ঘ্য ৭৬ সেমি.।  চশমাপরা হনুমান কমে যাওয়ার প্রধান কারণ বনভূমি উজার হওয়া, যার ফলে প্রাণিদের বাসস্থান এবং খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। বনের ভেতর রাস্তা তৈরি করে এবং গাছ কেটে বনকে বিভিন্ন ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন,  আরেকটা বড় সমস্যা হচ্ছে বনের ভিতর দিয়ে বিদ্যুৎ লাইন নেওয়া। বনের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ লাইন নেওয়া ফলে সব ধরনের প্রাণির ক্ষতি হচ্ছে। ২০১৬ সালে লাউয়াছড়া ও সাতছড়িতে ৪টা চশমাপরা অনুমান মারা গেছে বিদ্যুৎ পৃষ্ট হয়ে। এখনই এদের রক্ষায় গুরুত্ব না দিলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে সময়ের সাথে সাথে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত