নিজস্ব প্রতিবেদক

০৮ মার্চ, ২০১৯ ১৭:৩৮

যে জীবন ফুলবানুদের

অভাবের সংসারে জন্ম নিলে যে সংগ্রাম হয় নিত্য দিনের সংঙ্গী। আর অভাবি নারী হলেত কোনো কথাই নেই। পদে পদে সংগ্রাম করেই বাঁচতে হয়। এরকমই দুজন সংগ্রামী নারী মনোয়ারা বেগম (৪৬) ও ফুলবানু (৫০)। দুজনই সিলেট শহরের ক্বীনব্রীজের নিচে চাঁদনি ঘাটে প্রায় ১০ বছর যাবত ভাত বিক্রি করেন। মাত্র ২০ টাকা দিয়ে মাছ তরকারি দিয়ে ভাত পাওয়া যায় তাদের কাছে। দিন মুজুর ও বিভিন্ন ছোটখাটো পেশায় জড়িত শ্রমিকরই তাদের গ্রাহক।

এই প্রতিকূল পরিবেশে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাচ্ছেন এই দুই নারী। নারী দিবস বা এ সর্ম্পকে কোনো ধারনা নেই তাদের। এই নারী দিবসে দুজন সংগ্রামী নারীর জীবন কাহিনী তুলে ধরা হল সিলেট টুডের পাঠকদের জন্য।

সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলায় জন্ম হয় ফুলবানুর। বিয়ের পর স্বামীর সাথে সিলেট আসেন। স্বামী দিনমুজর আর তিন ঘর সামলাতেন। মোটামোটি ভালই চলছিল তার জীবন। তবে জীবনে অন্ধকার নেমে আসে চার সন্তান রেখে স্বামী মারা যাওয়ার পর। চার মেয়েকে ছোট রেখেই মারা যান স্বামী। তাই সন্তানদের দুবেলা দুমোটো খাবারের যোগান দিতে নিজেই বেরিয়ে পড়েন। শুরু করেন ভ্রাম্যমান খাবার দোকান। তার মত অসহায় খেটে খাওয়া মানুষদের ভাত খাইয়ে নিজের সন্তানদের ভাতের যোগান দেন তিনি। ভাত বিক্রি করেই চার মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন ফুলবানু। বর্তমানে ছোট মেয়ে ও তার সন্তানদের নিয়ে রায়নগর কলনীতে থাকেন।

ফুলবানু বলেন, কষ্ট আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গি। স্বামী মারা যাওয়ার পর মেয়েগুলোরে নিয়ে অনেক কষ্টে দিনানিপাত করছি। কোনা রাস্তা না পেয়ে ভাত বিক্রি শুরু করি। আমাদের মত গরিব মহিলাদের আর কিবা করার আছে। নিজের সাধ্যমত রান্না করে নিয়ে আসি। আমার মত গরিব মানষরাই এসে খায়।

ফুলবানু বলেন, ‘ইখানো বইতে পারি না। দিনো ৩/৪ বার উঠাইয়া দেয়। সংগ্রাম কইরা ওই বাইচ্চা আছি। মরার আগে এই সংগ্রাম শেষ হইত না। এই ভাত বিক্রি করতেও প্রতিদিন ইখানো সংগ্রাম করি। কোন সময় কে আইয়া উচ্ছেদ করে এই ডরে থাকি। একদিন মেয়র আয় উচ্ছেদ করতে তো আরেকদিন ডিসি আয় উচ্ছেদ করতে। অভিযান দিলেই ভাত তরকারির পাতিল লইয়া দৌড় দেই। আমরার কথা কেউ চিন্তা করে না। ইভাবে উঠাইয়া দিলে আমার কিভাবে জীবনযাপন করমু ইকথা কেউ চিন্তা করে না।’

মনোয়ারা ও ফুলবানু দুজনই সখি। এই ভাত বিক্রি পেশার সূত্র ধরেই দুজনের সখ্যতার শুরু। পেশা ছাড়াও তাদের দুজনের পরিবারেও অনেক মিল আছে। তাদের দুজনেরই চার জন করে মেয়ে সন্তান আছে। দুজন একই কলনীতে বাস করেন। আনন্দ-বেদনা, ঝগড়া-বিবাদ, সবকিছুই একসাথে উপভোগ ও মোকাবেলা করেন তারা। মনোয়ারা বেগম একটু লাজুক প্রকৃতির। কথা বলতে চান না। ফুলবানু তাকে বললেন, সাংবাদিক আপারে কিছু ক। তাইন লেখলে হয়তো আমরার আর উচ্ছেদ করতো না ইখান থাকি।

মনোয়ারা বেগমের বাড়ি সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলায়। তার স্বামী শাহজাহান সিকদার বেশ কয়েক বছর যাবত অসুস্থ। তাই সংসারের হাল ধরতে ভ্রাম্যমান খাবার দোকান দেন মনোয়ারা। চার মেয়ের মধ্যে দুই জনকে বিয়ে দিয়েছেন। বাকি ২জন ২য় শ্রেণীতে অধ্যায়ণরত আছে। সকালে রান্না করে বাচ্চাদের খাবার দিয়ে ভাত তরকারি নিয়ে চলে আসেন ক্বীনব্রীজের নিচে। রাত ১০টা পর্যন্ত এখানে বসে ভাত বিক্রি করেন তিনি।

মনোয়ারা বেগম বলেন, স্বামী অসুস্থ তারপরও টুকটাক কজ করেন। সংসার চালতে আমি এ কাজ করছি। প্রতিদিন প্রায় ২০ থেকে ৩০ জন এখানে খায়। ২০ টাকায় তো আর হোটেলে ভাত পাওয়া যায় না। তাই আমাদের মত গরীব শ্রমিরা এখানে এসে খায়।

তিনি বলেন, আগে ভাত বিক্রি করে লাভ হইত। এখন জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় বেশি লাভ হয় না। তাছাড়া আরেকটা কারনে ক্ষতি হয়। যেদিন মানুষ বেশি খায় না সেদিন ভাত তরকারি নষ্ট হয়। তার উপর সব সময় ভয়ে থাকি কে কখন এসে উচ্ছেদ করে।

মনোয়ারা বলেন, ‘আমরা কম টাকায় আমাদের মত গরীব মানুষরে খাওয়াই। কারো ক্ষতি করি না। আমরা তো ওয়াল দিয়া দোকানও তুলছি না। তারপরও আমাদের পিছে মানুষ লাগে। আমারারে উচ্ছেদ করার আগে তারা ভাত বেচার একটা যায়গা কইরা দেওক।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত