শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধি

০৯ মার্চ, ২০১৯ ১২:১০

একুশে পদকপ্রাপ্ত হরিশংকর জলদাস শ্রীমঙ্গল আসছেন

ভাষা ও সাহিত্যে একুশে পদকপ্রাপ্ত কথাসাহিত্যিক ড. হরিশংকর জলদাস আজ (শনিবার) মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে আসছেন। বিনেন্দু ভৌমিকের 'মৌমিতাকে লিখা পদ্ম', জহিরুল মিঠুর 'নোঙর তার লুঠ হয়ে গেছে' ও কয়েস সামীর 'লাকি থার্টিন' গ্রন্থের পাঠ পরিক্রমা অনুষ্ঠানে যোগ দিবেন তিনি।

শনিবার (৯ মার্চ) সন্ধ্যা ৬টায় শ্রীমঙ্গলের মহসিন অডিটোরিয়ামে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ও মুখ্য আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখবেন তিনি।

অনুষ্ঠানের আলোচকরা হলেন- কথাসাহিত্যিক আকমল হোসেন নিপু, কমলকলি চৌধুরী, অবিনাশ আচার্য। এতে সভাপতিত্ব করবেন দেবাশীষ চৌধুরী রাজা।

ভাষা ও সাহিত্যে একুশে পদকপ্রাপ্ত কথাসাহিত্যিক জেলে পরিবারের এক অনন্য সংগ্রামী ড. হরিশংকর জলদাস।

মানুষের অসাধ্য এমন কিছু নেই। চেষ্টা থাকলে অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো, অসম্ভবকে সম্ভব করা মানুষের পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়। তার আরেক উদাহরণ হরিশংকর জলদাস। চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ হরিশংকর জলদাস এবার (২০১৯) দেশের সর্বোচ্চ ও জাতীয় বেসামরিক সম্মান একুশে পদক পেয়েছেন।

অন্য দশজনের মতো সুন্দর স্বাভাবিক জীবন পাননি হরিশংকর জলদাস। জেলে পিতা-মাতার ঘরে জন্ম নেওয়া হরিশংকর সমুদ্রের স্রোতের সঙ্গে লড়াই করতে করতে বড় হয়েছেন। অধ্যয়ন অনুশীলন, শুধুমাত্র জেদ আর একাগ্রতা ও আত্মসম্মানকে কাজে লাগিয়ে বাঁচতে শিখেছেন, অর্জন করেছেন সম্মান আর মর্যাদা।

হরিশংকর জলদাসদের বসত চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকায়। তার বাবা ছিলেন জেলে। দাদা কখনো জেলে, কখনো সুইপার। ছিল টানাপোড়নের সংসার। তার ঠাকুরদা চন্দ্রমণি পাতরের মৃত্যু হয়েছে সমুদ্রে। তার বাবা যুধিষ্ঠির জলদাস তখন পণ করেছিলেন, যেভাবেই হোক ছেলেকে লেখাপড়া শেখাবেন। যেই কথা সেই কাজ।

হরিশংকর জলদাস যখন বিসিএস (শিক্ষা) করলেন তখনো তার পরিবারের অভাব কাটেনি। তার ভাষায়, ‘রাতভর মাছ ধরে দিনে কলেজে যেতাম পরিপাটি হয়ে। জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত সমুদ্রে মাছ ধরতে হয়েছে আমাকে। তবে এত লড়াই-সংগ্রামের পরও পিছু ছাড়েনি জাওলার পোলার (জেলের ছেলে) অপবাদ।’

৫৫ বছর বয়সে প্রথম উপন্যাস লিখে হৈচৈ ফেলে দেন হরিশংকর। তার পরের ইতিহাস বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের ইতিহাসে যোগ করে এক নতুন মাত্রা।

হরিশংকর জলদাস বলেন, ‘আমার জন্ম যে পাড়ায়, সেখানে কেউ স্কুলে গেছে- সেটা ছিল অবাক করার মতো। তার উপর স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হওয়া ছিল স্বপ্নাতীত। বাবা বলতেন, তোকে পশ্চিম ছেড়ে পূর্ব দিকে আলোর পথে যেতে হবে। অর্থাৎ আমাদের পাড়ার পশ্চিমে সমুদ্র, পূর্বে স্কুল।’

বাবা সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে হরিশংকর জলদাস বলেন, ‘কঠিন বাস্তবতায় তিনি পঞ্চম শ্রেণির বেশি পড়তে পারেননি। পরিবারের সবার মুখে ভাত তুলে দিতেই হিমশিম খেতেন তিনি। পিতার মৃত্যু এবং সমুদ্রে নিজের নিরন্তর লড়াইয়ের কারণেই হয়তো অমর্যাদার বিরুদ্ধে তার (বাবার) অলিখিত একটা যুদ্ধ ছিল। বাবা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তার জীবন সমুদ্র সংগ্রামে কাটাবেন কিন্তু ছেলেকে তিনি জেলের কাজে পাঠাবেন না। কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য আমাকে বারবার সমুদ্রে যেতে হয়েছে। আমার নিরক্ষর দিদিমা পরাণেশ্বরী দেবীর অনুপ্রেরণা এবং বাবা যুধিষ্ঠিরের সমুদ্রের সঙ্গে যুদ্ধটাই আমাকে পড়া চালিয়ে যাওয়ার শক্তি জুগিয়েছে।’

নিজের জীবনের তিক্ত স্মৃতি আওড়াতে গিয়ে হরিশংকর জলদাস বলেন, ‘কলেজে শিক্ষকতা শুরু করার পর চট্টগ্রাম শহরে বাসা ভাড়া চাইতে গিয়ে আমি বিপাকে পড়ি। অনেকে আমাকে বাসা ভাড়া দিতে চাইতো না। পরে বুঝলাম, আমার পদবী ‘জলদাস’। এজন্য কেউ বাসা ভাড়া দিতে চায় না। তখন অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী আমাকে পরামর্শ দিলেন পদবী পরিবর্তন করার জন্য। কেউ কেউ বললেন, জলদাস এর পরিবর্তে শুধু ‘দাস’ লিখলেও কোন সমস্যা হয়তো হবে না। কিন্তু আমি রাজি হইনি। এটা আমার পূর্বপুরুষের পদবী। আমি কেন আমার শেকড় ছিঁড়ে ফেলব?

হরিশংকর জলদাস অবজ্ঞা, অপমান ও লাঞ্ছনাকে শক্তি হিসেবে নিজের ভেতর কাজে লাগিয়েছেন।

তার ভাষায়, ‘মানুষতো ভালোবাসায় অনুপ্রাণিত হয়ে লেখে। বাংলাদেশে বোধ করি আমিই একমাত্র, যে অপমানিত হয়ে লিখতে বসেছি। চাকরি করতে গিয়ে আমি চরম সাম্প্রদায়িকতার শিকার হলাম। পিএইচডি হোল্ডার হিসেবে আমাদের বিভাগীয় প্রধানের বেশ অহংকার ছিল। একই সঙ্গে তার ভেতর প্রবল সাম্প্রদায়িকতা কাজ করতো। তিনি আমাকে জাত-পাত তুলে অপমান করতেন। বলতেন, জাওলার ছাওয়ালটা কই? তার তো ক্লাস ছিল। জেলে সম্প্রদায়ে জন্মগ্রহণ করেছি বলেই কী গালিটা সারাজীবন বয়ে যেতে হবে? তখনই ভাবলাম, আমার শেকড়ের সন্ধান করা প্রয়োজন। তখন থেকেই আমার ভেতর একটা অভিমান চাপলো। সিদ্ধান্ত নিলাম আমি জানবো জেলেরা আসলেই নিন্দিত কিনা।’

আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে হরিশংকর জলদাস বলেন, ‘এরপর আমি প্রফেসর ড. ময়ুখ চৌধুরীর কাছে আমার পিএইচডি করতে যাই। গবেষণা করতে গিয়ে দেখলাম, আমাদের আদি কবি ব্যাসদেব হলেন জেলেনির সন্তান। মানে ব্যাসদেব আমাদেরই পূর্বপুরুষ। অদ্বৈত মল্লবর্মণ, একুশে পদকপ্রাপ্ত বিনয়বাঁশি জলদাসদের কথা জানলাম। তারপর বসে গেলাম লেখার টেবিলে।’

হরিশংকর জলদাস অল্প সময়ে প্রচুর লিখেছেন। বুকের ভেতর জমিয়ে রাখা দীর্ঘদিনের ঘা গুলো যেমন তার কলমে ধরা দিয়েছে তেমনি তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলো ফুটে উঠেছে পাতায় পাতায়।

তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো, উপন্যাস- দহনকাল, কসবি, জলপুত্র, মহীথর, রামগোলাম, মোহনা, হৃদয়নদী, আমি মৃণালিনী নই, হর কিশোরবাবু, প্রতিদ্বন্দ্বী, এখন তুমি কেমন আছ, কোন এক চন্দ্রাবতী, গল্প- মাকাল লতা, জলদাসীর গল্প, লুচ্চা, প্রবন্ধ- লোকবাদক বিনয়বাঁশি, ধীবর জীবনকথা, কবি অদ্বৈত মল্লবর্মণ এবং ছোটগল্পে নিম্নবর্গ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ, জীবনানন্দ ও তাঁর কাল, বাংলা সাহিত্যের নানা অনুষঙ্গ। তার বিখ্যাত আত্মজৈবনিক গ্রন্থ কৈবর্তকথা, নিজের সঙ্গে দেখা।

বাংলা সাহিত্যের এ জলপুত্র ইতোপূর্বে পেয়েছেন আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, প্রথম আলো বর্ষসেরা বই পুরস্কার, ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরষ্কার ইত্যাদি। ২০১২ সালে তিনি অর্জন করেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। এবার ২০১৯ সালে পেলেন একুশে পদক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত