০৯ মার্চ, ২০১৯ ১৩:৪০
ছোট বেলা থেকেই দুরন্ত দিলরুবা। খুব ছোট বেলায় বাবা মারা যান তার। বাবার অভাব বুঝতে দেননি তার মা ও ভাইয়েরা। তিনি সব সময় চিন্তা করতেন মেঝো ভাই যা করবে তিনিও তাই করবেন। সেই লক্ষ্যেই তার সাইকেলের নেশা ছোটবেলা থেকে। ছোটদের বাইসাইকেল দিয়ে শুরু তার। বড় হওয়ার সাথে সাথে সাইকেলও বড় হতে থাকে। অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত অবস্থায় দিলরুবার মেঝো ভাই দিলওয়ার মাহমুদের সহযোগিতায় প্রথম মোটরবাইক চালানো শিখেন দিলরুবা। মাত্র একদিনেই মটর সাইকেল চালানো শিখে সেই ভাইকে নিয়ে সারা গ্রাম চষে বেড়িয়েছিলেন তিনি।
বলছিলাম ‘ও ভাই সলিউশনস লিমিটেড’এর রাইড শেয়ারিংয়ের একটি প্লাটফর্ম০ ‘ও বোন’ সিলেটের রাইডার দিলরুবার কথা। সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর থানার জোরাপুর গ্রামে জন্ম দিলরুবা বেগমের (২৩)। মাধ্যমিক (এসএসসি) পাশ করেন গ্রামের একটি হাইস্কুল থেকে। এরপর চলে আসে সিলেটে। বর্তমানে তিনি সিলেট নগরীর ইলেকট্রিক সাপ্লাই এলাকায় তার মা তসলিমা বিবিকে নিয়ে বসবাস করেন এবং নারীদের জন্য রাইড শেয়ারিং সেবা ‘ও বোন’ এ খন্ডকালীন কাজ করেন তিনি।
দিলরুবা পেশায় একজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট। কর্মক্ষেত্রে যাওয়া আসার সময় রিকশা, সিএনজিতে হয়রানির তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে এই রাইড শেয়ারিং সেবা দিতে আগ্রহী হন তিনি। সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোরের সাথে কথোপকথনকালে দিলরুবা জানান তার এ পেশায় আসার কথা।
দিলরুবা বলেন, "২০১০ সালে মৌলভীবাজার থেকে যখন আমরা সপরিবারে সিলেটে আসি তখন থেকে গণপরিবহনে হয়রানির অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছি। আমার বাসা থেকে রিকশায় অফিসে যেতে ভাড়া অনেক বেশি লাগে তাই লোকাল সিএনজি ব্যবহার করে অফিসে যেতাম। এমন কোনো দিন বাদ যায়নি যেদিন আমি পাশের পুরুষ যাত্রীটির সাথে বাকবিতণ্ডা করিনি। একটা সময় এসব ঝগড়া আর ভাল লাগত না। তাই সিএনজিতে বসার সময় দুই হাতে কলম বা হিজাব পিন রাখতাম।"
দিলরুবা বলেন, "যখন আমাকে ‘ও বোন’ এর রাইড দেওয়ার জন্য ভাইয়ারা বললেন আমি রাজি হয়ে গেলাম। আমার কাছে মনে হয়েছে অন্তত এই সেবার মাধ্যমে আমার মত আরো অনেক মেয়ে গণপরিবহনের হয়রানি থেকে রক্ষা পাবে।"
সিলেটে রাইড শেয়ারিং অ্যাপ ‘ও ভাই’ যাত্রা শুরু করে ২০১৮ সালের ১ জুলাই। চলতি বছর ফেব্রুয়ারির ১২ তারিখে ‘ও ভাই সলিউশনস লিমিটেড’র রাইড শেয়ারিংয়ের আরেকটি সেবামূলক প্রোগ্রাম ‘ও বোন’ যাত্রা শুরু করে।
সিটি ব্যাংকের কর্মকর্তা কাকলি দাসকে দিয়ে প্রথম ‘ও বোন’ এর রাইড শুরু হয় সিলেটে। এরপর ফেব্রুয়ারির ২৪ তারিখ এই রাইড সেবায় যুক্ত হন সিলেট ডায়াবেটিক হসপিটালের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (শিক্ষানবিস) দিলরুবা। মার্চের ২ তারিখে এই সেবায় যুক্ত হন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের সেবিকা শুভ্রতি সিনহা। এই তিনজন বর্তমানে ‘ও বোন’ এ খন্ডকালীন কাজ করছেন।
সিলেটে নারীদের জন্য এই সেবা খুব প্রয়োজনীয় উল্লেখ করে দিলরুবা বলেন, "‘রাইড শেয়ারিং ‘ও বোন’ সেবা সিলেটে বড় আকারে করা দরকার। কারণ আমরা সিলেটের মেয়েরা অনেক চাপা স্বভাবের। রাস্তা ঘাটে বা গণপরিবহনে কেউ কটু কথা বা অস্বাভাবিক আচরণ করলেও সহ্য করে নেন। বাড়ি গিয়ে কান্না করেন। তারপরও প্রতিদিনই স্কুল, কলেজ, অফিস আদালতে যান। যেহেতু এই রাইডগুলো শুধু নারীরা দিচ্ছেন সেজন্য স্কুল, কলেজ, অফিসে আসা যাওয়া অনেক নিরাপদ হবে মেয়েদের জন্য। তাই এই রাইড দাতা ও গ্রহীতা দুটোই সিলেটে বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।"
এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০টি রাইড দেয়া দিলরুবা বলেন, "এই রাইড দিয়ে আমি নিজেও উপকৃত হচ্ছি পাশাপাশি আরেকজন নারীর ও উপকার করছি। এই রাইডে রিকশা ভাড়ার চেয়ে অনেক কম ভাড়া। তাছাড়া নিরাপত্তাও আছেই। সব চেয়ে বড় কথা হচ্ছে এই সেবা দিতে আপনি আপনার রেগুলার কর্মক্ষেত্রের রাস্তা ব্যবহার করতে পারবেন। আপনি নিজের কাজে যাওয়ার পাশাপাশি আরেকজনকে সাহায্য করে অতিরিক্ত আয় করতে পারবেন।"
‘ও ভাই সলিউশনস লিমিটেড’ সিলেটের এরিয়া অফিসার পূজা ধর বলেন, "যে তিনজন নারী বর্তমানে ‘ও বোন’ এ রাইড সেবা দিচ্ছেন তারা সবাই আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী। চলার পথে নারীদের নিরাপত্তা দিতে নিজ তাগিদেই এই সেবা দিচ্ছেন এই তিন নারী। যারা রাইড দিচ্ছেন তাদের জন্য বিশেষ বোনাসেরও ব্যবস্থা আছে।"
তিনি বলেন, "নারীদেরকেই নারীদের সেবা, নিরাপত্তা দিতে এগিয়ে আসতে হবে। সিলেট অনেক নারী বাইকার আছেন। তারা যদি এই সেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ করেন তাহলে সিলেটের রাস্তা প্রতিটি মেয়ের জন্য নিরাপদ হবে।"
আপনার মন্তব্য