নিজস্ব প্রতিবেদক

১০ মার্চ, ২০১৯ ০১:১২

সিলেটে হাসপাতাল নির্মাণে ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে ঐতিহাসিক স্থাপনা

ঐতিহ্যবাহী ‘আবু সিনা ছাত্রাবাস’ সুরক্ষার দাবি

নগরীর চৌহাট্টা এলাকায় আসাম প্যাটার্নের 'ইউ' আকৃতির একটি একতলা বিশাল ভবন। দেখলেই মনে হয় পুরনো জমিদার বাড়ি। প্রাচীন এই ভবনটি এই প্রজন্মের নগরবাসীর কাছে ‘আবু সিনা ছাত্রাবাস’ নামে পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধসহ আর বহু ইতিহাসের স্বাক্ষী পুরনো এই ভবনটি সম্প্রতি ভেঙ্গে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এই ভবন ভেঙ্গে নির্মাণ করা হচ্ছে আড়াইশ’ শয্যা বিশিষ্ট সিলেট জেলা হাসপাতাল।

গত বছরের জানুয়ারিতে এই হাসপাতালের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইতোমধ্যে হাসপাতালের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে ভবনের কিছু অংশ। এই ভবনের গাঁ ঘেষেই রয়েছে ‘শহীদ ডা. শামসুদ্দিন হাসপাতাল' নামের আরেকটি হাসপাতাল।

এদিকে, পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী এ ভবনটি ভাঙ্গার খবরে নগরবাসীর মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। ইতিহাসের স্বাক্ষী নান্দনিক নির্মাণশৈলীর এই ভবনটি সুরক্ষার দাবি জানিয়েছেন তারা। এই ভবন রক্ষা করে কিংবা অন্যত্র হাসপাতাল স্থাপনের দাবি সিলেটের বিশিষ্টজনদের।

সিলেটের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা জানান, প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী জনপদ সিলেটে পুরনো ভবন প্রায় নেই বললেই চলে। ১৮৬৯ ও ১৮৯৭ সালে দুটি প্রলয়ঙ্করী ভ’মিকম্পে সিলেটের প্রায় সব পাকা স্থাপনাই ভেঙ্গে ধ্বংসস্তপে পরিণত হয়। ‘আবু সিনা ছাত্রাবাস’-এর স্থাপনাটি এখনো টিকে আছে। তাই ইতহাস আর ঐতিহ্যের সুরক্ষার স্বার্থেই এই স্থাপনাটি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।

বিশাল এই ভবনটির নির্মাণ ইতিহাস নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। প্রাবন্ধিক ও গল্পকার সেলিম আউয়াল তাঁর ‘সিলেটের প্রথম সংবাদপত্র ও কবি প্যারিচরণ’ প্রবন্ধে লিখেছেন- সিলেটের প্রথম সংবাদপত্র ‘শ্রীহট্ট প্রকাশ’-এর প্রেস ছিলো এই ভবনে। শ্রীহট্টপ্রকাশ প্রকাশিত হয় ১৮৭৬ সালে।

সিলেটের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাতা নিরঞ্জন দে জানান, ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই ভবনটি বার্মা ও ব্রিটিশ বাহিনীর ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ১৯৩৯ সালে শুরু হয়ে ১৯৪৫ সালে শেষ হয়। ১৯৩৬ সালে এই ভবনে স্থাপিত হয় সিলেট হাসপাতাল। তবে শুরুতে এটি একটি জমিদার বাড়ি ছিলো বলে জানা গেছে। তবে কোন জমিদার কবে ভবনটি নির্মাণ করেন তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা না গেলেও, দুৃটি তথ্য পাওয়া গেছে।

সিলেট জেলা আইজনীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদউল্লাহ শহীদুল ইসলাম শাহিন জানান, সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলা দুহালিয়া জমিদার বাড়ির সম্পত্তি ছিলো এটি। যা ‘দুহালিয়া হাউজ’ নামে নির্মিত হয়।

আর মুক্তিযোদ্ধা-সংগঠক এডভোকেট মুজিবুর রহমান চৌধুরী বলেন, এটি সুনামগঞ্জ সদরের গৌরাং রাজার বাড়ি ছিলো।

সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলে হাসপাতালের নথিপত্র ঘেঁটে জানা যায়, ১৯৩৬ সালে এই বাড়িতে স্থাপিত হয় সিলেট সিভিল হাসপাতাল। ১৯৪৮ সালে হাসপাতালকে পাশ্ববর্তী জায়গায় স্থানান্তর করে এই ভবনে সিলেট মেডিকেল স্কুল’র যাত্রা শুরু করে। যা ১৯৬২ সালে মেডিকেল কলেজে উন্নীত হয়। ১৯৭১-৭২ সালে এই মেডিকেল কলেজ বর্তমান স্থান নগরীর কাজলশাহতে স্থানন্তরিত হয়। আর ওই ভবনটি মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যা ‘আবু সিনা ছাত্রাবাস’ নামে নামকরণ করা হয়।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই ভবনেও ধ্বংসযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি সেনারা। পাশ্ববর্তী হাসপাতালে দায়িত্বরত অবস্থায় পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন এই মেডিকেল কলেজের শল্য বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. শামসুদ্দিন আহমদ।
এমন ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার জায়গায় ৮৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মান করা হচ্ছে ২৫০ শয্যার হাসপাতাল।
নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, হাসপাতালের জন্য ১৫ তলা ভিত বিশিষ্ট ৮তলা ভবন নির্মিত হবে। গত বছরের জুলাইয়ে এই প্রকল্পের কার্যাদেশ হয়। কাজ ২৪ মাসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ্ওই ভবনের সামনের উঠানে পাইলিংয়ের জন্য পিলার তৈরি করছেন শ্রমিকরা। নির্মাণসামগ্রী বহনকারী গাড়ি প্রবেশের জন্য ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে ভবনের কিছু অংশ।  ভবনটির বিভিন্ন কক্ষের কাঠের দরজা ইতোমধ্যে খোয়া গেছে।

এই ভবনটি প্রত্মতত্ত্ব বিভাগের তালিকাভূক্ত নয় বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল নির্মাণকারী সংস্থা গনপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী কুতুব আল হোসাইন। তিনি বলেন, এই ভবনটি পুরনো হলেও প্রত্মতত্ত্ব বিভাগের তালিকাভূক্ত নয়। তাই এটি ভাঙ্গতে কোনো সমস্যা নেই। তাছাড়া ওসমানী হাসপাতালের পাশাপাশি সিলেটে আরেকটি হাসপাতালেরও প্রয়োজন।

তবে এমন বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করে প্রত্মততত্ত্ব বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক আতাউর রহমান বলেন, কোনো একটা স্থাপনা প্রত্নতত্ত্বের তালিকায় না থাকলেও প্রত্মতাত্ত্বিক সম্পদ হতে পারে। তিনি বলেন, একশ’ বছরের পুরাতন বা ঐতিহ্যবাহী কোনো ভবন কোনো মন্ত্রণালয় ভাঙ্গতে চাইলে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে আগে জানাতে হবে- এটি  প্রত্নতত্ত্বের তালিকাভূক্ত সম্পদ হওয়ায় যোগ্য কি না। তখন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ তা যাছাই করে দেখবে। যদি তালিকাভূক্ত হওয়ার মত না হয় তখন এটি ভাঙ্গা যাবে।

তিনি বলেন, সিলেটের ওই ভবনটির ভাঙ্গার ব্যাপারে স্বাস্থ্য বিভাগ বা গণপূর্ত মন্ত্রণালয় কেউই আমাদের কিছু জানায়নি। সিলেট আমাদের কোনো অফিস না থাকায় তাৎক্ষণিক আমরা কিছু করতেও পারছি না। তবে আমরা খোঁজ নেবো।

এই স্থানে হাসপাতাল স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদউল্লাহ শহীদুল ইসলাম শাহিন। তিনি বলেন, ‘আবু সিনা ছাত্রাবাসের গা লাগোয়াই শহীদ ডা. শামসুদ্দিন হাসপাতাল। তাই নতুন আরেকটি হাসপাতাল এই স্থানে না করে অন্য কোনো স্থানে করলে জনগনও উপকৃত হতো। ভবনটিও রক্ষা পেতো।

পুরনো এই ভবন না ভেঙ্গে এই স্থানে যাদুঘর স্থাপনের দাবি জানিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন, সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কীম বলেন, সিলেটে কোনো যাদুঘর নেই। এই জায়গাটি যাদুঘরের জন্য উত্তম জায়গা হতে পারে।

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় পরিচালক ডা. পু চু নু’র সাথে একাধিকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। বৃহস্পতিবার তাঁর অফিসে গেলে তিনি মিটিংয়ে আছেন বলে জানানো হয়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত