শাকিলা ববি

৩০ জুন, ২০১৯ ১৭:১৪

‘লালে লাল বাবা শাহজালাল’

জোহরের নামাজের পরই হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজার প্রাঙ্গণ পরিণত হয় জনস্রোতে। মাথায় লাল কাপড় বেঁধে নারী পুরুষ দলে দলে প্রবেশ করেন দরগাহে। নাকাড়া বেজে উঠার সাথে সাথে ‘লালে লাল বাবা শাহজালাল’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠে দরগাহ প্রাঙ্গণ।

‘শাহজালাল বাবা কী জয়’ ‘৩৬০ আউলিয়াকি জয়’ ‘লালে লাল বাবা শাহজালাল’ স্লোগান দিয়ে শাহজালাল ভক্তরা লাক্কাতুড়া বাগান অভিমুখে রওয়ানা দেন। তলোয়ার, দা-কুড়াল ও লাল-ঝাণ্ডা হাতে ভক্তবৃন্দের মিছিলে গোলাপজলও ছিটানো হয়।

রোববার (৩০ জুন) সকাল থেকেই সিলেট শহর ও শহরতলী, বিভিন্ন উপজেলা  থেকে  বাদ্য বাজিয়ে দরগাহ প্রাঙ্গণে শুরু হতে থাকেন মানুষজন। শুধুমাত্র সিলেট শহর নয় অন্যান্য জেলা, মাজার-খানকা শরিফ, বাউল সংগঠন ও গ্রামগঞ্জ থেকে মানুষজন আসেন এই লাকড়ি তোড়া উৎসবে।

বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গানের তালে তালে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে লাক্কাতুড়া ও মালনীচড়া বাগানের মধ্যবর্তী টিলায় যান ভক্তবৃন্দ। সেখান গিয়ে টিলায় মিলাদ পড়ে শিরনি বিতরনের পর লাকড়ি সংগ্রহ শুরু হয়। সংগ্রহীত লাকড়ি নিয়ে আবার দরগায় আসেন সবাই। সেই লাকড়ি দরগাহের পুকুরের পানিতে ধুয়ে উরসের শিরনিতে ব্যবহারের জন্য স্তূপ করে রাখা হয়।

সরজমিনে দেখা যায়, নারী পুরুষ নির্বিশেষে লাকড়ি তোড়া উৎসবে অংশগ্রহণ করেন হাজারো মানুষ। বাদ যায়নি শিশুরাও। বড়দের মত তারাও মাথায় লাল কাপড় বেঁধে  ‘লালে লাল বাবা শাহজালাল’ স্লোগান দিয়ে লাকড়ি তোড়া উৎসবে যোগ দেয়।

দক্ষিণ সুরমা ৩৬০ আউলিয়া বাউল সমাজ কল্যাণ পরিষদ থেকে তিন ট্রাকে করে ভক্ত আশেকানরা আসেন দরগাহে। নগরের ভাতালিয়া যুবসংঘ থেকে আসেন একদল ভক্তবৃন্দ। বৃহত্তর বাধাঘাট এলাকা ভক্তবৃন্দের নামের ব্যানারে আসেন প্রায় ৩ শতাধিক ভক্ত আশেকান, আরকুম শাহ শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীবৃন্দসহ বিভিন্ন মাজার-খানকা শরিফ, বাউল সংগঠনের সদস্যরা পিকাআপ গাড়িতে সাজসজ্জা করে বিভিন্ন ধর্মীয় গান, গজল পরিবেশন করে লাকড়ি তোড়া উৎসবে অংশগ্রহণ করেন।

মাজার থেকে টিলাতে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে ভক্তবৃন্দদের পানি পানের ব্যবস্থাও করেন একদল স্বেচ্ছাসেবক। পানির পাত্র নিয়ে টিলার নিচে দাঁড়িয়ে থাকেন স্বেচ্ছাসেবকরা।

টিলা থেকে লাকড়ি নিয়ে মাজারে আসার পর ভক্তবৃন্দরা জিকির মেতে উঠেন।  দরগাহ প্রাঙ্গনে অনেক ভক্তবৃন্দ লাঠি খেলা প্রর্দশন করেন। অনেকেই নফল নামাজ পড়েন।  

বৃহত্তর বাধাঘাট এলাকা ভক্তবৃন্দের মধ্যে রফিক মিয়া বলেন, প্রতি বছরই আমরা এলাকা থেকে বাদ্য বাজিয়ে লাকড়ি তোড়া উৎসবে আসি। এবারও প্রায় ৩ শতাধিক ভক্ত এসেছেন। শাহজালাল বাবার প্রতি ভালবাসার টানে মাজারের সকল কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করি।  

শেরপুর থেকে পরিবারের পাঁচজন সদস্য নিয়ে আসেন আরব আলী। এই পাঁচ জনের মধ্যে আছে দেড় বছরের একটি শিশু। দরগাহে এসে তারা ভক্তবৃন্দরে আখনি বিতরণ করেন। আরব আলী বলেন, আমি আরো অনেক বার এসেছি এই লাকড়ি তোড়া উৎসবে। এবার আমার নাতিসহ পরিবারের সকলকে নিয়ে এসেছি। আমার নাতির জন্য মানত ছিল তাই সবাইকে নিয়ে এসেছি।

টুকেরবাজার এলাকার শরিফ আহমেদ বলেন, আমি একজন জালালী ভক্ত। শাহজালাল বাবার সব অনুষ্ঠানাধিতে আমি অংশগ্রহণ করি। সে হিসেবে লাকড়ি তোড়া উৎসবে এসেছি। আগে আমার বাবার সাথে আসতাম। তিনি মারা যাওয়ার পর আমি আমার সন্তানদের নিয়ে মাজারের বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে আসি।

কিশোরগঞ্জের ইটনা থেকে এসেছেন জুলেখা বেগম। তিনি বলেন, আমি শাহজালাল বাবার ভক্ত। তার দরবারে এসে আমি অনেক কিছু পেয়েছি। তাই বাবার উরসসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমি নিয়মিত অংশগ্রহণ করি। এবারও লাকাড়ি তোড়া উৎসবে অংশগ্রহণ করতে ২ দিন আগে সিলেট এসেছি। আজ উৎসব শেষ করে বাড়ি ফিরে যাবো। আবার উরসের সময় আসবো।  

উল্লেখ্য, ৭০৩ হিজরী ১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দ ২৬ শাওয়ালের এই দিনে ওলিকুল শিরোমণি হযরত শাহজালাল (রহ.) ৩৬০ আউলিয়া নিয়ে সিলেটে পদার্পণ করেন। ওইদিনই তিনি অত্যাচারী রাজা গৌড়গোবিন্দকে পরাজিত করে সিলেট বিজয় করেন। তাই এই দিনকে সিলেটে ইসলামের বিজয় দিবস হিসেবেও পালন করা হয়। পরবর্তীতে ৭২৫ হিজরী ২৬ শাওয়ালের দিনে শাহজালাল (রহ.) মুর্শিদ হযরত সৈয়দ আহমদ কবির (রহ.) পাঞ্জাব প্রদেশের ভাওয়াল জেলার উচ নগরীতে ইন্তেকাল করেন। তাই এইদিনটি শাহজালাল (রহ.) এর মুর্শিদের পবিত্র উরস শরীফ হিসাবেও উদযাপন করা হয়। এছাড়াও ‘লাকড়ি তোড়া’ উৎসব নিয়ে কন্যা দায়গ্রস্থ এক কাঠুরের একটি গল্প প্রচলিত আছে। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও আভিজাত্যের গৌরব ধ্বংস করার জন্য এই লাকড়ি তোড়া উৎসব উদযাপন করা হয় বলে মনে করা হয়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত