কানাইঘাট প্রতিনিধি

০৪ ডিসেম্বর, ২০১৯ ১৭:০৭

আজ কানাইঘাট মুক্ত দিবস

আজ ৪ ডিসেম্বর, কানাইঘাট মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে শত্রু মুক্ত হয় সিলেটের কানাইঘাট উপজেলা।

১৯৭১ সালের আগস্ট থেকে শুরু হয় কানাইঘাটের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকবাহিনীর সম্মুখযুদ্ধ। সেই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল কানাইঘাটের স্থানীয় প্রায় ৪ শতাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সময় ৪নং সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর সিআর দত্ত, সাব সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মাহাবুবুর রব সাদী, টু-আইসি ছিলেন খাজা নিজাম উদ্দিন ভুঁইয়া, ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান, গ্রুপ ক্যাম্প কমান্ডার ছিলেন মুন্সিগঞ্জ-টঙ্গিবাড়ী উপজেলার বাসিন্দা আ. রউফ মোল্লা। তারাসহ আরো অনেকে ১৯৭১ সালে কানাইঘাটে অবস্থান করে  মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

১৯৭১ সালের ৪টা সেপ্টেম্বর কানাইঘাটের নক্তিপাড়া গ্রামের কালাহাজীর বাড়ীতে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একই এলাকার কটালপুর ব্রিজ ধ্বংস করার পরিকল্পনা করা হয়। ব্রিজ ধ্বংস করতে গিয়ে পাক বাহিনীর হাতে শহীদ হন ৪নং সেক্টরের টু-আইসি কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার লামাপাড়া গ্রামের খাজা নিজাম উদ্দিন ভুঁইয়া। শহীদ খাজা নিজাম উদ্দিন ভুঁইয়া ‘বীরউত্তম’ এর কবর কানাইঘাটের লক্ষীপ্রসাদ পূর্ব ইউপির বড়খেওড় গ্রামে রয়েছে।

২৫ শে মার্চ রাতে পাক-হানাদার বাহিনী বাঙ্গালিদের উপর হামলা চালালেও কানাইঘাট উপজেলায় হামলা করে জুন মাস থেকে। দীর্ঘ সময় যুদ্ধ করে শত লাশের বিনিময়ে অবশেষে ৪ ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত হয় কানাইঘাট উপজেলা। এর আগে শেষ যুদ্ধ হয় উপজেলার নগলার ব্রিজ হতে ডাকবাংলা, চাপনগর ও ভাড়ারীমাটি জুড়ে।

এ সময় মুক্তি বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন ৪নং সেক্টর কমান্ডার সিআর দত্ত বীরবিক্রম এবং পাকবাহিনীর নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন বসারত আর ।

জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এ এলাকার মানুষ সীমান্তবর্তী লক্ষীপ্রসাদ পূর্ব ইউপিকে দ্বিতীয় ভারত বলে ডাকতো। যার কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্গ ছিল পাহাড়ি অঞ্চলের লোভাছড়া চা-বাগানে। ৪নং সেক্টরের ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রব সাদির নেতৃত্বে তখন এ বাগানের কারখানাটি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। কারণ দেশ ভাগের পূর্বে এ বাগানটি শোষণ করতো পাকিস্তানিরা।

কানাইঘাট উপজেলা থেকে মোট কতজন মুক্তিযোদ্ধা অংশ নিয়েছিলেন তার কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে প্রায় সাড়ে ৪’শ জন মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। কারণ স্বাধীনতার পর থেকে অনেকবার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাটি রদবদল হয়েছে। পাকিস্তানি বেলুচ রেজিমেন্টের সদস্যদের হাতে এ উপজেলায় প্রথম শহীদ হয়েছেন ভাড়ারীমাটি গ্রামের শাহাদাৎ হোসেন।

মুখোমুখি যুদ্ধে যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধা সেদিন শহীদ হয়েছিলেন তাদের সমাধি আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তারা হলেন- উপজেলার বাখালছড়া গ্রামের আহসান আলী তার কবরটি আটগ্রাম বাজারে, চারখাই দসাখালিতে দর্পনগরের রফিকুল হক, ভারতের কমলপুরে বড়চাতলের আব্দুল খালিক, নিজ বাড়ি উজান বারাপৈতে নক্তিপাড়ার মশাহিদ আলী, নিজ বাড়িতে খুলুরমাটির নুরউদ্দিন, নিজ গ্রামে নক্তিপাড়ার আব্দুর রহমান, জুলাই বীরাখাই ব্রিজের পার্শ্বে শহীদ আব্দুল লতিফ, সাতবাঁক ঈদগাহে দিনাজপুর জেলার কুতুয়ালী সদর থানার কালিতলা গ্রামের মরহুম তছির উদ্দিনের পুত্র ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান বীরউত্তম, বড়খেয়রে কুমিল্লার ব্রাক্ষণপাড়া উপজেলার লামাপাড়া গ্রামের ক্যাপ্টেন খাজা নিজাম উদ্দিন বীরউত্তম, জুলাই কুওরের মাটিতে ফরিদপুর জেলার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা বিএইচএম শহীদ আব্দুল হাকিমের কবর রয়েছে। এছাড়াও খুকুবাড়ির আহমদ হোসেন, দক্ষিণ লক্ষীপ্রসাদ কুওড়গড়ির আবু সিদ্দেক, ছোট দেশের সাইদুল হোসেন, পাক-হানাদার বাহিনীর সাথে মুখোমুখি যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন।

এছাড়া কানাইঘাটের লক্ষীপ্রসাদ পূর্ব ইউপিতে ৫টি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প ছিল- নক্তিপাড়া হাজী আবু বক্কর উরফে ‘কালা হাজী’র বাড়ী মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প, উজান বারাপৈত মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প, নাইরাইনপুর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প, বড়খেওড় রাজারটিলা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প, বড়খেওড় সালামের টিলায় মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প।

১৯৭১ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে নক্তিপাড়ার কালা হাজীর বাড়ীতে থেকে স্বাধীনতাযুদ্ধ করেছেন কুমিল্লার বুড়িচং ব্রাক্ষণপাড়ার খাজা নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া ‘বীর-উত্তম’, কুমিল্লার আব্দুর রাজ্জাক, মুন্সিগঞ্জ-টঙ্গিবাড়ীর আ.রউফ মোল্লা, কুমিল্লার ইলিয়াছ, মুন্সিগঞ্জ-টঙ্গিবাড়ীর দিপঙ্কর গুপ্ত, চাদপুর-মতলবের স্বপন, আমানুল্লাহ, মোঃ শরিফ, বেলুচী, ঢাকা-শিমুলিয়া-দোহার আবু তাহের, ওয়াসেক মোল্লা, কানাইঘাটের দর্পনগরের আনোয়ার মাষ্টার।

১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর পাক সেনাদের সাথে কটালপুর এলাকায় সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন দিনাজপুর জেলার কোতোয়ালী সদর থানার কালিতলা গ্রামের মরহুম তছির উদ্দিনের পুত্র ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান। শহীদ ক্যাপ্টেন মাহবুর রহমান ‘বীরউত্তম’ এর কবর দিঘীরপার পূর্ব ইউপির সাতবাঁক ঈদগাহ কবরস্থানে রয়েছে।

কানাইঘাটের চাপনগর এলাকায় পাকবাহিনীরর সাথে সম্মুখযুদ্ধে ১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর শহীদ হন ফরিদপুর জেলার বাসিন্দা বিএইচএম আব্দুল হাকিম। শহীদ আব্দুল হাকিমের কবর কানাইঘাটের সাতবাঁক ইউপির কুওরের মাটিতে রয়েছে। এছাড়া ১৯৭১ সালের ১লা সেপ্টেম্বর পাক বাহিনীর জল্লাদ ক্যাপ্টেন বসারতের হাতে বড়চতুল ইউপির মালিগ্রামের ২৪জন গ্রামবাসী শহীদ হয়েছিলেন। সেই শহীদদের গণকবর কানাইঘাটের বিষ্ণুপুর ব্রিজের পার্শ্বে রয়েছে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত