বড়লেখা প্রতিনিধি

১৯ জানুয়ারি, ২০২০ ২২:৫৮

রক্তে লাল সবুজ চা বাগান, নৃশংসতায় বাকরুদ্ধ শ্রমিকরা

বড়লেখার পাল্লাতল চা বাগানে স্ত্রী-শ্বাশুড়িসহ ৪জনকে হত্যার পর যুবকের আত্মহত্যা

‌দেশের অন্যান্য চা বাগানগুলোর মতোই মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার পাল্লাতল চা বাগানও শান্ত আর সবুজ। এই সবুজ চা বাগানই রক্তে লাল হয়ে ওঠে রোববার ভোরে। এই বাগানেরই এক পরিবারের তিনজনের সাথে পাঁচজন মারা গেছেন। এদের মধ্যে ৪ জনকে খুন করা হয়েছে। আর যিনি খুন করেছেন তিনিও পরে আত্মহত্যা করেছেন।

অন্য বাগানের মতো বড়লেখার ভারত সীমান্তবর্তী দুর্গম পাহাড়ি এলাকার পাল্লাতল চা বাগানের শ্রমিকদেরও টানাটানির সংসার, তবু আশ্চর্য সরল তাদের জীবনযাপন। কাজ আর বাড়ি- এতেই বাঁধা তাদের জীবন। রোববার বাগানের সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তাই শনিবার দেরী করেই ঘুমাতে গিয়েছিলেন শ্রমিকরা। তবে রোববার ভোরেই ঘুম ভাঙ্গে সকলের। তাও ভয়ঙ্কর এই খবর শোনে।

এমন লোমহর্ষক ঘটনা আগে কখনোই দেখেননি পাল্লাতল চা বাগানের শ্রমিকরা। এই ঘটনার আকস্মিকতায় প্রায় সকলেই বাকরুদ্ধ। আফসোস আর আহাজারি ছাড়া তেমন কোনো কথাই বলতে পারছেন না কেউ।

লতা রানী কর্মকারের কথাই তার প্রমাণ মিলবে। পাল্লাতল চা বাগানেরই শ্রমিক লতা। তিনি বলেন, ‘বাপ-দাদা ও পূর্ব পূরুষেরা এই বাগানে বাস করেছে। কোনো দিন এরকম ঘটনা ঘটেনি। আমরা বাগানের মানুষ। শান্তিতে বসবাস করি। কারো সাথে ঝগড়া বিবাদে নাই। আমরা হতবাক হয়ে গেছি। নির্মল এ বাগানের শ্রমিক ছিল না। সে জলিকে বিয়ে করে এখানে ওঠে। প্রায়ই তাদের মাঝে ঝগড়া হত। এটা শোনতাম।’

রোববার সকালে ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ি ঘিরে নারী-পুরুষ চা শ্রমিকদের ভিড়। খবর পেয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন এসেও ভিড় করেছেন এখানে।

উপস্থিত শ্রমিকরা জানান, বাগানের বিষ্ণু বুনার্জির মেয়ে জলি বুনার্জি। স্বামীর সাথে বনিবনা না হওয়ায় একমাত্র মেয়েকে নিয়ে কয়েক বছর আগে বাবার বাড়ি চলে আসেন জলি। প্রায় দুই বছর আগে তিনি বিয়ে করেন নির্মল কর্মকারকে। নির্মল অন্য গোত্রের হওয়ায় এতে পরিবারের মত ছিল না। তবে পরিবারের অমত সত্ত্বেও নির্মলকে বিয়ে করেন জলি। নির্মল বাগানের শ্রমিক নন। তবে স্ত্রীকে নিয়ে শশুর বাড়িতেই থাকতেন। বছরখানেক ভালোই চলছিল তাদের।

তবে গত কয়েক মাস থেকে পারিবারিক বিষয় নিয়ে প্রায়ই নির্মল ও জলির মাঝে ঝগড়া হতো। কিন্তু এই ঝগড়া যে এমন ভয়ঙ্কর রূপ নেবে তা ঘুণাক্ষরেও আন্দাজ করতে পারেনি বাগানের কেউ। রোববার ভোরের ঘটে যাওয়া ঘটনা এখনও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে বাগানের শ্রমিকদের।

শ্রমিকরা জানান, রোববার ভোরে পারিবারিক কলহের জের ধরে নির্মল কর্মকার প্রথমে তার স্ত্রী জলি বুনার্জি (৩০)কে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করেন। আক্রমন ঠেকাতে আসলে শাশুড়ি লক্ষ্মী বুনার্জি (৬০) কে এবং পরে দুই প্রতিবেশী বসন্ত বক্তা (৬০) এবং বসন্ত বক্তার মেয়ে শিউলী বক্তা (১৪) কে কুপিয়ে জখম করেন। ঘটনাস্তলেই এ চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় গুরুতর আহত হন কানন বক্তা।

জলি বুনার্জির আগের স্বামীর মেয়ে ও পাল্লাতল চা বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী চন্দনা ঘর থেকে পালিয়ে গিয়ে চিৎকার দিলে আশপাশের শ্রমিকরা ছুটে এসে বাড়ি ঘেরাও করেন। এ অবস্থায় নির্মল কর্মকার (৩৮) ঘরের দরজা লাগিয়ে তীরের সাথে ঝুলে আত্মহত্যা করেন।

নিহত জলির বাবা বিষ্ণু বুনার্জি বলেন, ‘মেয়ে আমাদের কথার বাইরে গিয়ে নির্মলকে বিয়ে করে। প্রায়ই তাদের মধ্যে ঝগড়া হত। দুই মাস ধরে আমি অন্য মেয়ের বাড়িতে থাকি। ঘটনার খবর পেয়ে বাগানে এসে আমার স্ত্রী, মেয়েসহ প্রতিবেশীদের রক্তাক্ত দেহ দেখেছি।’

ঘটনাস্তলে কথা হয় সেলিম আহমদ নামে স্থানীয় এক ব্যক্তির সাথে। তিনি বলেন, ‘এটা অবিশ্বাস্য একটি ঘটনা ঘটেছে। বাগানের বাসিন্দারা এমনিতেই শান্ত মানুষ। কারো সাথে বিরোধেও ঝড়ায় না। চা বাগানের মত একটি শান্তির এলাকায় এই ঘটনা ঘটবে। চিন্তাই করা যায় না।’

স্থানীয় উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান আহমদ জুবায়ের লিটন বলেন, ‘ঘটনাটি আমাদের হতবাক করেছে। নৃশংস এই ঘটনাটি সকলকে স্তব্ধ করে দিয়েছি।’

মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মো. ফারুক আহমদ বলেন, ধারণা করা হচ্ছে পারিবারিক কলহের জেরে ঘটনাটি ঘটেছে। রাতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অনেকক্ষণ ঝগড়া হয়েছিল। এ থেকেই ঘটনার সূত্রপাত। লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়েছে। এই ঘটনায় গুরুতর আহত একজন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। বিস্তারিত তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত