এস আলম সুমন, হাকালুকি থেকে ফিরে

১৩ ফেব্রুয়ারি , ২০২০ ২২:১৪

হাকালুকির পরিবেশ ধ্বংস করছে ‘প্লাস্টিকের চাঁই’

প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন হাকালুকি হাওরে পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য এমনিতেই মানব সৃষ্ট বিভিন্ন দূষণে হুমকির মুখে পড়েছে। এর মাঝে অরক্ষিত হাকালুকিতে প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে চিংড়ি শিকারের জন্য ব্যবহৃত ‘প্লাস্টিকের চাঁই’। গত বছর দুয়েক ধরে হাকালুকি হাওরে ‘প্লাস্টিকের চাঁই’ এর অবাধ ব্যবহার বেড়েছে। এতে চরম হুমকির মুখে রয়েছে হাকালুকির পরিবেশ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্লাস্টিকের চাঁই হওয়ায় এগুলো পচে না। অবাধে এসব চাঁই ব্যবহার ও চাইয়ে ব্যবহৃত মাছ শিকারের জন্য টোপ অন্যান্য জলচর প্রাণীসহ মাছের জন্যও ক্ষতিকর। মৎস্যজীবীরা ছোট মাছ ও চিংড়ি শিকারের জন্য প্লাস্টিকের চাঁই ব্যবহারের পর হাওরের যত্রতত্র ফেলে রেখে দেয়। প্লাস্টিকের চাঁই ব্যবহার রোধ না করা গেলে হাকালুকির পরিবেশ ও জীববৈচিত্র আরও ঝুঁকির মুখে পড়বে।

সরেজমিনে হাকালুকির গেলে দেখা যায়, হাকালুকির চকিয়া, নাগুয়া, গৌড়কুড়ি, ফুটবিল, হাওরবর্ণা, হিঙ্গাজি, টলার বিল ও বৈরাগীকুল, গোল্লা, বাঘদল, মেধাবিল, পালুয়া, চাঙ্গুয়া, লালুর বিল (জলাশয়) নামে ছোট বিলের পাশে ছড়িয়ে ছিটে রয়েছে প্লাস্টিকের চাঁই। জানা যায়, আগে শুধুমাত্র বাঁশের তৈরি চাঁই ব্যবহার করা হতো চিংড়ি ধরার জন্য। তবে একাধিকবার ব্যবহার ও কম খরচে তৈরি করা ‘প্লাস্টিকের চাঁই’ এখন স্থানীয়দের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এজন্য গত বছর দুয়েক ধরে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে প্লাস্টিকের চাঁই।

দেখতে গোলাকার বৈশিষ্ট্যের হয় এ ‘প্লাস্টিকের চাঁই’। প্লাস্টিক মুড়িয়ে বাঁশের কঞ্চি ও তার দিয়ে এই চাঁই তৈরি করা হয়।

হাওরের মৎস্যজীবী মো. ছলুক মিয়া, বিধু চন্দ্র, সজল মালাকার ও রছিম মিয়া নামে জানান, প্লাস্টিকের চাঁই দিয়ে সহজে বেশি পরিমাণ চিংড়িসহ ছোট মাছ শিকার করা যায়। বর্ষায় পুরো হাওরজুড়ে ও শুকনো মৌসুমে হাওরের বিল এবং জলাশয়ে পানির নিচে সারিবদ্ধভাবে সুতো দিয়ে বেধে টোপ দেওয়া প্লাস্টিকের চাঁই রেখে দেওয়া হয়। পরে এসব চাই তুলে এর ভিতর থেকে চিংড়ি ও ছোট মাছ বের করে সেগুলো এমনি ফেলে রেখে দেওয়া হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক মৎস্যজীবী জানান, শুকনো মৌসুমে ইজারাকৃত বিলের ইজারাদারদের নিষেধাজ্ঞার কারণে ও যেসব বিলে মাছ ধরা বন্ধ ওইসব বিলে লুকিয়ে প্রতিদিন সন্ধ্যায় চাঁই পানির নিচে সুতো দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। পরদিন ভোরে সেগুলো পানি থেকে তুলা হয় ও চিংড়ি সংগ্রহ করা হয়। ওই মৎস্যজীবী জানান, আগে বাঁশের তৈরি চাঁই দিয়ে চিংড়ি শিকার করা হতো। কিন্তু প্লাস্টিকের চাঁই দুই তিনবার ব্যবহার করা যায় ও কম খরচে সহজে তৈরি করা যায়। এজন্য চিংড়ি শিকারে প্লাস্টিকের চাঁই ব্যবহার বেড়েছে।

বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ বশির আহমদ বলেন, প্লাস্টিক পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। প্লাস্টিকের চাঁই ব্যবহারের পর হাওরের যত্রতত্র ফেলে রাখায় হাকালুকির পরিবেশ ও জীববৈচিত্র চরম হুমকির মুখে পড়বে। এগুলো ব্যবহার রোধে স্থানীয় হাওরবাসীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ও আইনের সঠিক প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরী।

তিনি আরও বলেন, প্লাস্টিক পচে না। পানির নিচে ও জলাশয়ে ফেলে রাখা প্লাস্টিকের চাঁই থাকা মাছসহ জলচর বিভিন্ন প্রাণীর জন্য চরম ক্ষতিকর।

এ ব্যাপারে মৌলভীবাজার সদর মৎস্য অধিদপ্তর কার্যালয়ের সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. সুলতান মাহমুদ বলেন, হাকালুকিতে গত দুই বছর ধরে চিংড়ি শিকারের জন্য প্লাস্টিকের চাঁইয়ের ব্যবহার বেড়েছে। আমরা বিভিন্ন সময় পরিদর্শনে গেলে প্লাস্টিকের চাঁই হাওরে যত্রতত্র ফেলে রাখা অবস্থায় দেখতে পাই। মৎস্য আইনে চাঁই ব্যবহার নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে স্পষ্ট কোন নির্দেশনা নেই। তাই কারা ব্যবহার করেন এসব চাঁই সেটা না জানায় কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি না। তবে নিষিদ্ধ প্লাস্টিকের চাঁই তৈরি রোধে ও এসব চাঁই ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করতে হাওরের মৎস্যজীবীদের সচেতন করে আসছি। প্লাস্টিকের চাঁইয়ের ব্যবহার বন্ধে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত