রিপন দে, মৌলভীবাজার

০৮ মার্চ, ২০২০ ২২:৪৩

বর্ষা মৌসুমে মৌলভীবাজারবাসীর আতঙ্কের নাম মনু নদ

মৌলভীবাজার জেলার প্রাণকেন্দ্র দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে মনু নদ। প্রকৃতির আশীর্বাদ এই নদ দীর্ঘদিনের অবহেলা আর ড্রেজিংয়ের অভাবে দিন দিন মানুষের কাছে অভিশাপে রূপ নিয়েছে। মৌলভীবাজারের যে নদ দিয়ে এক সময় জাহাজ চলতো সে নদে এখন ৩৫টি চর। বছর বছর বন্যায় প্লাবিত হয় বিস্তীর্ণ এলাকা, ক্ষয় ক্ষতি ছাড়িয়ে যায় শত থেকে হাজার কোটি। বর্ষা মৌসুমে এই অঞ্চলের আতঙ্কের নাম মনু নদের খনন হয়নি কখনো। ভুক্তভোগীরা রাজপথে নেমে আন্দোলন করলেও টনক নড়েনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।

আসছে বর্ষায় পুনরায় প্লাবিত হবার আগেই নদটি খননের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। অন্যথায় আবারও তারা আন্দোলনে যাবার হুমকি দিচ্ছেন। যদিও এ বছর মেগা প্ল্যান হাতে নিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), তবে পূর্বের মতো লাল ফিতায় বন্দী থাকবে নাকি মন্ত্রণালয় প্রকল্প গ্রহণ করবে তা নিয়ে রয়েছে সংশয়।

পাউবো সূত্রে জানা গেছে, মনু একটি আন্তর্জাতিক নদ। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে উৎপত্তি হয়ে ১৮৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদ বাংলাদেশ অংশের ৭৪ কিলোমিটার অংশের পুরুটাই মৌলভীবাজার জেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মিলিত হয়েছে কুশিয়ারা নদীতে। গড়ে ৩০০ মিটার প্রস্থ মনু নদের উভয় পাশের ১৪৮ কিলোমিটার প্রতিরক্ষা বাঁধের ৬৭টি স্থানের ৩০ কিলোমিটার এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ। সাপের মতো একে বেঁকে বয়ে চলা এই নদে প্রাকৃতিকভাবে রয়েছে প্রচুর মোড়। অনেক জায়গা ইউটার্ন করে ঘুরে গেছে এমনকি কিছু জায়গায় বাক অনেকটা ভি আকৃতির। ছোট ছোট চরের পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে রয়েছে বড় আকারের ৩৫টি চর। এক সময়ের ২০ মিটার গভীর মনু নদ বর্তমানে ১০ মিটারেরও কম।

বিগত ২০ বছরের হাইড্রলজিক্যাল ডাটা পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, বর্ষাকালে নদটিতে প্রতি সেকেন্ডে ২৫০ ঘন মিটার এবং শুষ্ক মৌসুমে প্রায় ১৫ ঘন মিটার পানি প্রবাহিত হয়। পাহাড়ি নদ হওয়ায় বর্ষা ও শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহের বিরাট তারতম্য এবং উজানে পাহাড় ও উঁচু ভূমি থাকায় বানের সঙ্গে প্রচুর মাটি, বালি এসে নদীতে পড়ে। ফলে নদের তলদেশে পলি পড়ে। প্রচুর বাক থাকায় এসব বাঁকের এক পাশে চর ও অপর পাশে ভাঙন সৃষ্টি হয়। মনু নদের ৯১ শতাংশ স্ক্যাচমেন্ট এরিয়া উজানে ভারতীয় অংশে হওয়ায় সেখানে বৃষ্টি হলে দ্রুত পানি ৩-৪ মিটার বৃদ্ধি পেয়ে ফ্ল্যাশ ফ্লাড সৃষ্টি হয়। আর এর প্রভাবে প্রতিরক্ষা বাধ ভেঙে পানি লোকালয়কে প্লাবিত করে।

সর্বশেষ ১৯৮৪ সালের ভয়াবহ বন্যার পর মনু নদের প্রতিরক্ষা বাঁধ মেরামত শুরু করলেও বাজেট স্বল্পতার কারণে তা হয়েছে বিচ্ছিন্নভাবে। যা হয়েছে তাও রক্ষণাবেক্ষণ করা যায়নি আর। সেই সঙ্গে এত দিনের পুরনো বাধ এবং শহর রক্ষা বাধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকায় পানির চাপ বাড়লেই ভেঙে পড়ে। ভাঙনের এই খেলা মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া, রাজনগর ও সদর উপজেলাসহ আশেপাশের প্রতিটি এলাকায় আর্থ সামাজিক উন্নয়নে প্রতিনিয়তই বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

সড়ক পথের আগে পানি পথে ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য এই মনু নদ ছিল এই এলাকার একমাত্র ভরসা। ভৈরব থেকে কুশিয়ারা নদী হয়ে ছোট ছোট জাহাজ আসত মৌলভীবাজারে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, বছর বছর মৌলভীবাজারের মনু নদের ভাঙনে ক্ষতি হয় শত কোটি টাকা। বন্যা বেশি হলে সে ক্ষতির পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় কয়েক হাজার কোটিতে। অথচ এক বছরে ক্ষতির যে পরিমাণ তা দিয়ে স্থায়ীভাবে মানুষকে এই সমস্যা থেকে মুক্তি দেওয়া যেত। কিন্তু এ বিষয়ে সব সময় উদাসীন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। বছর বছর এ নিয়ে চাহিদাপত্র বা প্রকল্প প্রস্তাব থেকেছে লাল ফিতায় বন্দি।

মৌলভীবাজার চেম্বার্স অব কমার্সের সাবেক পরিচালক ডা. আবদুল আহাদ বলেন, ‘প্রতি বছর বন্যায় এ এলাকায় যে ক্ষতি হয় তার এক দুই বছরের টাকা দিয়ে স্থায়ী সমাধান দেওয়া সম্ভব, কিন্তু কেন তা হচ্ছে না জানি না। ২০১৮ সালের বন্যায় শুধু পৌরসভার ভেতরের ব্যবসায়ীদের কয়েকশ' কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। শেষ ঈদুল ফিতরের আগে টানা ৭/৮ দিন বন্ধ ছিল শহরের প্রাণকেন্দ্র সাইফুর রহমান রোডসহ বেশির ভাগ এলাকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ঈদের দিনসহ প্রতিটি দিন কেটেছে আতঙ্কে।'’

তিনি আরও বলেন, ‘শহর রক্ষা বাঁধ শহরের সবচেয়ে উঁচু রাস্তা সাইফুর রহমান রোড থেকে ৫ ফুট উপরে হলেও তা উপচে পানি ঢুকেছে। কখন কি হয় সেই আতঙ্কে নিজেদের গাড়িসহ মূল্যবান সম্পদ অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছিল শহরবাসী। প্রতিরক্ষা বাধ ভাঙলে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটত। শহরে জলাবদ্ধতা হতো পাঁচ থেকে ১৫ ফুট পর্যন্ত।’

জানা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মনু নদে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জন্য ১৪০০ কোটি টাকা চাওয়া হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের অবহেলায় তা মিলেনি। এরপর ২০১৮ সালে বন্যায় মৌলভীবাজারের শহর প্লাবিত হয় এবং জেলার প্রায় ৩ লাখ মানুষ দীর্ঘদিন পানিবন্দী থাকে। বন্যার প্রভাবে আর্থিক ক্ষতি হয় হাজার কোটি টাকার উপরে। এরপর সরকারের মন্ত্রী এবং পদস্থ কর্মকর্তাও এলাকা ঘুরে আশ্বাস দেন বরাদ্দ দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে মনু খননের দাবিতে রাস্তায় নামে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন। চাপ তৈরি হয় সরকার দলীয় সাংসদ এবং জনপ্রতিনিধিদের উপর। কিন্তু আশ্বাস এবং হচ্ছে, হবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে মনু নদের খনন কাজ।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন মৌলভীবাজারের আহ্বায়ক আ স ম সোহেল বলেন, ‘সর্বশেষ ২০১৮ সালের বন্যায় ক্ষতি হয়েছিল হাজার কোটি টাকার উপরে। এরপর আমরা আন্দোলনে নামি। পাউবো অফিস ঘেরাওসহ বিভিন্ন কর্মসূচি দেই। কিন্তু আশ্বাসের মধ্যেই সব সীমাবদ্ধ। মনু আমাদের আশীর্বাদ কিন্তু উদাসীনতায় তা হয়ে গেছে আতঙ্কের নাম। বন্যার হাত থেকে বাঁচার জন্য আমাদের আন্দোলন করতে হয়; এটা দুঃখজনক তবে এভাবে চলতে থাকলে আবারও মৌলভীবাজারবাসী রাস্তায় নামবে।’

শাহবন্ধর এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা গোলাম তোরাব আলী বলেন, ‘স্বাধীনতার পরেও মনু নদে ছোট ছোট জাহাজ চলত। এমনকি শীত মৌসুমে জাহাজ ভিড়ত পশ্চিম বাজারের বর্তমান খেয়া ঘাটে। কিন্তু বর্তমানে বছর বছর পাহাড়ি ঢলে পলি জমে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে শতকরা ৬০ ভাগ পানি ধারণ ক্ষমতা কমে গেছে। শীত মৌসুমে কোথাও হাঁটু পানি কোথাও একেবারে শুকনো। এত বছরেও ড্রেজিং না করায় এবং পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় মনু হারিয়েছে নদ পানি ধারণের ক্ষমতা।’

তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে তারা সমাধানের পথে হাঁটছে। তারা চলতি বছর আবারও এক হাজার দুই কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে; যা পাশ হলে এই এলাকার সমস্যার সমাধান হবে। প্রকল্পটি একনেকে উঠার অপেক্ষায় আছে। প্রকল্পটি ইতিমধ্যে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা (পিইসি) থেকে ছাড়পত্র পেয়েছে।

মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রণেন্দ্র শঙ্কর চক্রবর্তী বলেন, ‘মনু নদের ভাঙন থেকে মৌলভীবাজার সদর, রাজনগর ও কুলাউড়া উপজেলা রক্ষায় একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, যা বর্তমানে একনেকে চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।’

প্রকল্পে রয়েছে-  সিসি ব্লক দিয়ে নদের ৩০ কিলোমিটার অংশের ৬৭টি স্থানে পাড় সংরক্ষণ, বড়হাট থেকে শাহবন্দর পর্যন্ত ২.৫ কিলোমিটার আরসিসি ফ্লাডওয়াল নির্মাণ, নদের ১২.১১ কিলোমিটার এলাকায় ড্রেজিং কার্যক্রম, ৩৫টি চর অপসারণসহ ৮৬ কিলোমিটার প্রতিরক্ষা বাধ পুনর্নির্মাণ।

২০১৮ সালের বন্যার পর বেশ কিছু কাজ খণ্ডিতভাবে হয়েছে জানিয়ে প্রকৌশলী রণেন্দ্র শঙ্কর বলেন, ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ অর্থ বছরে জরুরি ভিত্তিতে ছয় কোটি ১৪ লাখ টাকা ব্যায়ে ৪৯টি ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে ৯ কিলোমিটার বাধ মেরামত করা হয়েছে। জরুরিভিত্তিতে এই কাজগুলো করার কারণেই ২০১৯ সালে তেমন বন্যা হয়নি।

তিনি আরও বলেন, ‘এই প্রকল্প গ্রহণের আগে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখেছে যে, শহরাংশের গুরুত্ব বিবেচনায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ছাড়াও বিকল্প প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে বড়হাট থেকে শাহবন্দর নতুন ফ্লাড ওয়াল নির্মাণ করা প্রয়োজন। দীর্ঘদিন নদ খনন না হওয়ার কারণে নদের পানি ধারণ ক্ষমতা কমে গেছে। ড্রেজিং এর মাধ্যমে নদীর নাব্যতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রাপ্ত ড্রেজ ম্যাটেরিয়ালস দ্বারা বাঁধ শক্তিশালীকরণ ও ভূমি উন্নয়ন সম্ভব হবে, যা পরবর্তীতে জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।’

এ বিষয়ে বন পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন জানান, ‘মনু শুধু দুঃখ নয়, জীবনের অংশও। দুঃখ কাটানোর চেষ্টা করছি। মনুর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে, নাব্যতা হারিয়ে গেছে, খনন করে গভীরতা বাড়াতে হবে। মনু প্রকল্প একনেকে পাস করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে সেটা আমরা বলব।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত