নিজস্ব প্রতিবেদক

১৮ এপ্রিল, ২০২০ ২২:৩১

সিলেটে করোনা চিকিৎসার অব্যবস্থাপনার চিত্র তুলে ধরলেন ডা. মঈনের স্বজন

করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মঈন উদ্দিন। গত ১৫ এপ্রিল ঢাকার কুর্মিটোলা হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

ডা. মঈনকে ঢাকার প্রেরণের পরই সিলেটে করোনা চিকিৎসার অপ্রতুলতা ও অব্যস্থাপনার অভিযোগ ওঠে। অনেক চিকিৎসকও সিলেটে করোনার চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালের প্রস্তুতি ও সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। যদিও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও সিলেটের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা শুরু থেকে সিলেটে করোনা মোকাবেলার সবধরণের প্রস্তুতি থাকার দাবি করে আসছেন।

বিজ্ঞাপন

এ অবস্থায় মারা যাওয়া চিকিৎসক ডা. মঈন উদ্দিনের স্বজন ডা. তানভীর মোহিত সিলেটে করোনা মোকাবেলায় অব্যবস্থাপনা ও সঙ্কটের বিষয়টি তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে সিলেটে ডা. মঈনউদ্দিনের চিকিৎসা নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন তিনি।

ডা. তানভীর মোহিত মারা যাওয়া ডা. মঈন উদ্দিনের ভায়রা। তিনিও ওসমানী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।

সিলেটে ডা. মঈনের চিকিৎসা প্রসঙ্গে একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাতকারে ডা. তানভীর মোহিত বলেন, উনার যেদিন করোনা পজেটিভ ধরা পড়ে, আমরা বাসায়ই তাকে আইসোলোটেড করে রাখি। বাসায় তাকে অক্সিজেন সাপোর্টও দিয়ে রাখি। কিন্তু একটা সময় দেখা গেলো তার অবস্থার অবনতি হচ্ছে। তখন তাকে আমরা হাসপাতালে নেওয়ার জন্য যোগাযোগ করি। কারণ তার আইসিইউ প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু হাসপাতাল থেকে যে অ্যাম্বুলেন্স পাঠানো হলো তাতে অক্সিজেনের ব্যবস্থা ছিলো না। হাসপাতালে যাওয়ার পরও ২০ মিনিট অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা যায়নি। সেখানে সেন্ট্রাল অক্সিজেন নেই। তখন মঈন বলছিলেন- আমার খুব খারাপ লাগছে। আমাকে হয় আইসিইউ-এ নাও, নতুবা বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে যাও।

বিজ্ঞাপন

ডা. তানভীর বলেন, প্রায় ২০ মিনিট পরে তাকে অক্সিজেন সাপোর্ট দেওয়া হয়। তখন আমরা জানি পরদিন সকালে তাকে ওসমানী মেডিকেল কলেজের হাসপাাতালে স্থানান্তর করা হবে। এইটুকু জানার পর আমরা তাকে রাতে শামসুদ্দিন হাসপাতালে রাখার সিদ্ধান্ত নিই। নতুবা আমরা ওই রাতেই তাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতাম। ওখানে কখনো রাখতাম না। কারণ আমরা জানি, শামসুদ্দিনে গুরুতর রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার কোনো ব্যবস্থাই নেই।

ডা. মঈনের এই স্বজন বলেন, প্রশাসন থেকে বলা হয়েছে- ডা. মঈন উদ্দিনের নাকি আইসিইউর প্রয়োজন ছিলো না। এটি অত্যন্ত হাস্যকর কথা। সিভিয়ার নিউমোনিয়া দেখা দেওয়া একটা রোগীর জন্য যদি আইসিইউর প্রয়োজন না হয় তাহলে কোন রোগীর জন্য আসলে আইসিইউ প্রয়োজন? এটা অত্যন্ত দুঃখজনক কথা।

তিনি বলেন, ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে ২৪ ঘন্টা সময় লেগছে। আমরা এক বিকেলে তাকে শামসুদ্দিন হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছি। পরদিন বিকেলে রওয়ানা করে রাতে শিফট করেছি। আমরা যদি জানতাম তিনি সিলেটে আইসিইউ পাবেন না তাহলে প্রথম রাতেই আমরা তাকে ঢাকায় নিয়ে যেতাম। তার অবস্থা আরও খারাপ হওয়ার আগেই নিয়ে যেতে পারতাম।

ডা. তানভীর বলেন, যদি শামসুদ্দিন হাসপাতালে ভেন্টিলেটর, আইসিইউসহ সব ব্যবস্থাই থাকতো তাহলে তাকে কেনো এগুলো দেওয়া হলো না।

পরিবারের ইচ্ছায় ডা. মঈনকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে- ওসমানী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এমন বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ডা. তানভীর বলেন, আমার রোগী মারা যাচ্ছে, তাকে সাপোর্ট দেওয়া যাচ্ছে না। তাকে আমরা ঢাকা নিয়ে যাবো না তো এখানে ফেলে রাখবো নাকি?

বিজ্ঞাপন

ওসমানী হাসপাতালের আইসিইউতে ডা. মঈনকে স্থানান্তর না করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষ বলেছেন, করোনা রোগীকে ওসমানী হাসপাতালে নিলে সেখানকার অন্য রোগীরা সংক্রমিত হতে পারেন। এটা খুবই ভালো কথা। কিন্তু শামসুদ্দিন হাসপাতালে যারা বিকেলে ও রাতে দায়িত্ব পালন করছেন তারা তো সবাই ওসমানী হাসপাতালের চিকিৎসক। বিকেলে শামসুদ্দিনে দায়িত্ব পালন করে তারা আবার পরদিন সকালে ওসমানী হাসপাতালে এসে ডিউটি করছেন। এখন ভাইরাসটা কি এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে- সে কেবল রোগীর মাধ্যমে ছড়াবে। ডাক্তারদের মাধ্যমে ছড়াবে না! অত্যন্ত হাস্যকর যুক্তি তাদের।

ডা. মঈনের আক্রান্ত হওয়া প্রসঙ্গে তার এই স্বজন বলেন, গত একমাসের মধ্যে পরিবার বা আত্মীয়স্বজনের কেউ বিদেশ থেকে আসেননি। বিদেশি কারো সাথে আমাদের সাক্ষাত হয়নি। এবং ডা. মঈন মার্চের মাসের ১৮ তারিখ থেকে চেম্বার বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ফলে তার চেম্বার থেকে সংক্রমিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে এই সময়ে হাসপাতালে ডিউটি করেছেন।

তিনি বলেন, কীভাবে তিনি আক্রান্ত হতে পারেন তা আমরা অনেক চিন্তা করেও এখন পর্যন্ত বের করতে পারিনি। এটি খুব ভয়ঙ্কর ব্যাপার। যার মাধ্যমে তিনি আক্রান্ত হয়েছেন সে এখনও সমাজে আছে। এবং সে হয়তো আরও অনেককে সংক্রমিত করবে।

সিলেটে চিকিৎসকদের সুরক্ষাসামগ্রী প্রদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাকে যে একটামাত্র পিপিই দেওয়া হয়েছে তা একটি সাধারণ রেইনকোট। অনলাইনে সার্চ করলেই তা যে কেউ বুঝতে পারবে।

তিনি বলেন, ডা. মঈনের পাশে থাকায় আমিও এখন কোয়ারেন্টিনে আছি। তবে কোয়ারেন্টিন শেষ হলে আমি আবার হাসপাতালে যাবো। রোগী দেখবো। যে রেইনকোট দেওয়া হয়েছে পিপিই হিসেবে সেটা পরেই যাবো। কারণ আমি ডাক্তার। এই কাজটাই আমাকে শেখানো হয়েছে। আমি এটা ছাড়া আর কিছু জানি না।

এ প্রসঙ্গে শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. সুশান্ত কুমার মহাপাত্র বলেন, ‘ডা. মঈন উদ্দিনের শারীরিক অবস্থা আইসিইউতে রাখার মতো খারাপ ছিল না। অক্সিজেন সাপোর্ট দেওয়ার পর তার অবস্থা স্বাভাবিকই ছিল। যেহেতু এখানকার আইসিইউ নতুন, আর ওসমানী মেডিকেলের আইসিইউ অনেকদিন ধরে সচল; তাই তিনি প্রথমে সেখানে যেতে চান। কিন্তু সেখানে তাকে ভর্তি না করতে পারায় তিনি ঢাকায় যেতে চান।’

বিজ্ঞাপন

ওসমানী হাসপাতালের আইসিইউতে কেন তাকে ভর্তি করা যায়নি, এ ব্যাপারে হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. হিমাংশু লাল রায় বলেন, ‘করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসায় আলাদা ইউনিট করার নির্দেশনা থাকায় আমরা পুরো শামসুদ্দিন হাসপাতালকে করোনা আইসোলেশন সেন্টার হিসেবে ঘোষণা করি, যাতে মূল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটি করোনামুক্ত রাখা যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘যেহেতু ওসমানী মেডিকেলের আইসিইউতে সব ধরনের রোগী আছেন, তাই এখানে ডা. মঈনকে ভর্তি করা যায়নি। পরে তিনি ঢাকায় যেতে চাইলে আমরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে তাকে ঢাকায় রেফার করি। সরকারি আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স না থাকায় তিনি বেসরকারি একটি আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে ঢাকায় যান। ওনাকে আইসিইউতে ভর্তির ব্যাপারে কোনো ব্যক্তিগত কিছু ছিল না, আর ওনার মৃত্যুতে আমরাও শোকাহত।’

প্রসঙ্গত, গত ৫ এপ্রিল সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মঈন উদ্দিন করোনাভাইরাস আক্রান্ত হিসেবে সনাক্ত হন।

প্রথমে নগরীর হাউজিং এস্টেট এলাকার বাসায় রেখেই তার চিকিৎসা চলে। সেখানে শারিরীক অবস্থার অবনতি হলে ৭ এপ্রিল রাতে তাকে সিলেট শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালের করোনা আইসোলেশন সেন্টারে ভর্তি করা হয়। তবে পরদিন ৮ এপ্রিল ঢাকায় পাঠানো হয় এই চিকিৎসককে। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৫ এপ্রিল সকাল পৌনে সাতটায় তিনি মারা যান।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত