হৃদয় দাশ শুভ

০৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ১৩:০৪

পাখির কিচিরমিচিরে মুখরিত হাইল হাওর

অফুরন্ত জলরাশির মধ্য দিয়ে বয়ে চলছে ছোট ছোট ছিপ নৌকা। সেই নৌকাগুলোতে বসে কেউ মাছ ধরছেন, আবার কেউ বা মাছ ধরার আয়োজন করতে ব্যস্ত। মাঝারি আকৃতির নৌকাগুলো জলরাশি ভেদ করে ধীরলয়ে চলছে। সেগুলো অবশ্য মাছ ধরার নৌকা নয়, সে নৌকোগুলো হলো পর্যটকবাহী নৌকা।

পর্যটকরা এখানে আসেন স্নিগ্ধ শান্ত জলরাশির মধ্যে সূর্যাস্ত দেখার জন্য। শরতের পড়ন্ত বিকেলে রক্তিম সূর্যের আলোয় লালচে আকাশ। রাখালরা গরু নিয়ে বাড়ি ফিরছে। জেলেরা তীরে নৌকা ভিড়াচ্ছে। একদল জেলে নৌকার বৈঠা কাঁধে একপ্রান্তে জাল আর অন্য প্রান্তে মাছের ঝুড়ি বেঁধে গ্রামের বাজারের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। পাখির দল এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে চলছে। দেশি-বিদেশি পাখির কিচিরমিচিরে মুখরিত চারপাশ।

আর কিছুক্ষণ পরই ডুবে যাবে লাল সূর্য। ঘনিয়ে আসবে সন্ধ্যা। বলছিলাম মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওরের কথা। হাইল হাওর সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার সদর ও শ্রীমঙ্গল উপজেলা এবং হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলা জুড়ে বিস্তৃত।

এতে রয়েছে ১৪টি বিল এবং পানি নিষ্কাশনের ১৩টি নালা। এই হাওরটির মোট আয়তন ১০ হাজার হেক্টর, যার ৪ হাজার হেক্টর প্লাবন ভূমি, ৪ হাজার ৫১৭ হেক্টর হাওর, ১ হাজার ৪০০ হেক্টর বিল, ৪০ হেক্টর খাল এবং ৫০ হেক্টর নদী।

শ্রীমঙ্গলের ঐতিহ্যবাহী এই হাইল হাওর প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য ও জীবন-জীবিকার বিবেচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি। শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪টি ইউনিয়ন যথা- কালাপুর, শ্রীমঙ্গল, ভূনবীর ও মির্জাপুর নিয়ে বিস্তৃতি এ হাওরের।

পর্যটক কিংবা ভ্রমণপিপাসুদের কাছে বরাবরই প্রিয় মৌলভীবাজার। কিন্তু এখানে যে চমৎকার একটি হাওর আছে, এটা খুব কম পর্যটকই জানেন। এ হাওরটি লতাপাতার হাওর নামেই পরিচিত। কারণ এখানে প্রচুর লতা এবং গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ রয়েছে।

হাইল হাওরের আসল সৌন্দর্য হল এখানকার পাখি। বহুদিন ধরেই এখানে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির আনাগোনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বারো মাসই হাইল হাওর মুখরিত থাকে পাখিদের কলতানে। আর এই কলতান বছরের যেকোনো সময়কে ছাড়িয়ে যায় শীতকালে। এ সময় স্থানীয় পাখির পাশাপাশি অসংখ্য প্রজাতির পাখি এসে ভিড় জমায় এখানে।

হাওরের একটা অংশে বেশ কিছু ছন জাতীয় গাছ রয়েছে। এসব গাছের আড়ালে পাখিরা ডিম পাড়ে। যারা এখানে বেড়াতে যান তারা নির্দিষ্ট একটা দূরত্ব থেকে পাখি কিংবা পাখির বাসা দেখতে পারেন।

বর্ষা মৌসুমে হাইল হাওরের সুনীল জলরাশি চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। শুধু পানি আর পানি। হাইল হাওরের পানির প্রধান উৎস গোপলা নদী। উজানে বিলাসছড়া থেকে উৎপত্তি লাভ করে হাইল হাওরকে দ্বিখণ্ডিত করে গোপলা নদী ভাটিতে বিজনা নদীর মাধ্যমে মেঘনার সাথে মিলিত হয়েছে। হাইল হাওরে গেলে আপনি এর অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন।

ভ্রমণপিপাসুদের জন্য নৌকা ভ্রমণের উৎকৃষ্ট স্থান হল এই হাওর। ভোরে ঘুমন্ত হাইল হাওর যেন জেগে উঠে। হাওরের চারপাশে হাজার হাজার মৎস্যজীবীর মাছ আহরণের দৃশ্য অত্যন্ত মোহনীয়। বিকেলের হাইল হাওর থাকে যেন পাখিদের দখলে। সন্ধ্যায় হাইল হাওরে ভ্রমণ করলে মনে হবে সারা রাত কাটিয়ে দেই পাখিদের এ রাজ্যে।

বহুল পরিচিত বাইক্কা বিল হল হাইল হাওরের একটি মৎস্য অভয়াশ্রম। এখানে দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মাণ করেছে মৎস্য অধিদপ্তরের আওতাধীন এবং ইউএসএআইডির আর্থিক সহায়তাপুষ্ট ম্যাচ (ম্যানেজমেন্ট অব এ্যাকুয়াটিক ইকোসিস্টেম থ্রো কমিউনিটি হাজবেন্ড্রি)। পর্যটক ও দর্শনার্থীর জন্য নির্মিত পর্যবেক্ষণ দ্বিতল বিশিষ্ট এ টাওয়ার থেকে দূরবীন ও বাইনোকুলার দিয়ে পাখি এবং বিশাল বিস্তৃত হাইল হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।

হাইল হাওরে ঘুরতে আসা স্থানীয় সমাজসেবামূলক সংগঠন 'উদ্দীপ্ত তারুণ্যের' মুখপাত্র সানজিতা শারমিন সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আমরা যারা শহুরে জীবনযাপন করি তাদের আসলে বর্তমানে ঘুরে বেড়ানোর মত তেমন কোন জায়গা নেই। হাইল হাওরে এসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছি। এখানকার পরিবেশটা এত সুন্দর ও স্নিগ্ধ যে এটা এখানে যারা আসবে না তাদের বলে ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। সুন্দর জলজ উদ্ভিদের আধার এই হাওর।

ঢাকা থেকে ঘুরতে আসা পর্যটক ইমরান হোসেন বলেন, আমাদের আসলে ইকো ট্যুরিজমকে আরও প্রমোট করা দরকার। এই হাওরে ঘুরতে এসে পানিতে ভাসমান খাবারের প্যাকেট, চিপসের প্যাকেট দেখতে পেয়েছি। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয় ৷ ঘুরতে এসে প্রকৃতি ও পরিবেশকে কোনভাবেই নষ্ট করা যাবে না।

স্থানীয় পর্যটন ব্যবসায়ী এসকে সুমন বলেন, অপার সম্ভাবনার এই হাইল হাওর পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। পর্যটকরা এখানের সৌন্দর্য উপভোগ করবেন এটাই আমরা চাই। কিন্তু হাওরের প্রবেশমুখের রাস্তাগুলো তেমন ভালো নয়। তাই প্রশাসনের কাছে আমাদের দাবি রাস্তাগুলো যেন সংস্কার করে পর্যটকবান্ধব করা হয়।

স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠন 'লাউয়াছড়া বন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা আন্দোলন' এর আহ্বায়ক প্রভাষক জলি পাল বলেন, রামসার সাইট হিসেবে স্বীকৃত পৃথিবীর অন্যান্য জলাভূমির বৈশিষ্ট্য হাইল হাওরে রয়েছে। হাইল হাওরকে রামসার সাইট ঘোষণা করা দরকার। শীত মৌসুমে হাইল হাওরে ২০ হাজারের বেশি দেশীয় এবং পরিযায়ী পাখির আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে বৈচিত্র্যপূর্ণ বহু বিরল প্রজাতির মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণির প্রজননক্ষেত্র এই হাওরগুলো। হাওরটিকে রামসারের গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হলে এর পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য বিশেষ সংরক্ষণের আওতায় আসবে, যা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকার মানোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

যেভাবে যেতে হবে: হাইল হাওরে যাওয়ার জন্য শ্রীমঙ্গল থেকে বেশ কয়েকটি রাস্তা আছে। শহরের সবুজবাগ থেকে আপনি হাওরে যেতে পারবেন। পারবেন পশ্চিম ভাড়াউড়া বা রুপসপুর দিয়েও যেতে। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে যেকোনো সিএনজি বা টমটম চালককে বললেই আপনাকে নিয়ে যাবে হাওরে। ভাড়া পরবে ১৫০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে।

আপনি যদি বাইক্কা বিল দেখতে চান তাহলে আপনাকে শ্রীমঙ্গল-মৌলভীবাজার সড়ক ধরে কালাপুর বাজার হয়ে একটু সামনে এগোলেই বরুনা-হাজীপুর পাকা রাস্তার দেখা মিলবে। এ রাস্তায় প্রবেশ করে যেতে হবে হাজীপুর বাজারে। স্থানীয়দের কাছে এ বাজারটি ঘাটেরবাজার নামে পরিচিত। সেখান থেকে মোটর সাইকেলে বা পায়ে হেটে প্রায় ৩-৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হাইল হাওর।

হাজীপুর বাজারে বেশ কয়েকজন গাইড আছেন। আপনি চাইলে গাইডের সাহায্যও নিতে পারেন। গাইড আপনাকে পুরো হাওর ও বাইক্কা বিল দেখতে সাহায্য করবে। সিএনজিতে শ্রীমঙ্গল থেকে বাইক্কা বিলের ভাড়া পরবে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকার মতো।

কোথায় থাকবেন: হাওর এলাকায় বিল ইজারাদারদের দোচালা কুটিরগুলোয় দুই-চারজন পর্যটক থাকার জন্য চমৎকার। তবে অবশ্যই বিল মালিকের অনুমতি নিতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় বিল এলাকায় তাঁবু ফেলে রাত্রিযাপন। জোছনা রাতে নৌকাতেও রাত্রিযাপন করতে পারেন। এখানে নৌকা থেকে ভোরবেলা পাখি পর্যবেক্ষণ যেকোনো অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় পর্যটককে বিমোহিত করবে।

তাছাড়া শ্রীমঙ্গলে ভালো কোনো হোটেলে রাত্রিযাপন করেও হাইল হাওর পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। তবে অ্যাডভেঞ্চার চাইলে হাওরের পাশের কুটির কিংবা নৌকাতে থাকা উত্তম।

খাওয়া দাওয়া: হাওরে রাত্রিযাপন করতে হলে সঙ্গে নিয়ে আসতে হবে চাল-ডাল। হাওর এলাকার শ্রমজীবী মানুষকে সামান্য কিছু টাকা দিলে পছন্দ মতো টাটকা মাছের ঝোলের তরকারি দিয়ে তা পরিবেশন করবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত