রাজেশ পাল

৩১ অক্টোবর, ২০১৬ ২২:১৯

‘ক্ষমা করো হযরত’

মন্দিরে হামলা, লুটপাট ও ভাঙচুরের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সতর্ক অবস্থান

আমাদের দেশে মানুষের অজস্র অনুভূতি আগে দিনরাত শুধু আহত হতো। নুন থেকে চুন খসলেই খুন অবস্থা। আর এখন হয় নিহত। যেকোনো ব্যাপারে অনুভূতির ঠ্যালায় আমরা ক্রমাগত পরিণত হচ্ছি একটি চরম অনুভূতিশীল জাতি রাষ্ট্রে। সামান্য দ্বিমত হলেই আমাদের ধর্মানুভূতি, দলানুভূতি, আস্তিকানুভূতি, নাস্তিকানুভুতি, ক্রিকেটানুভূতি, ফুটবলানুভূতি থেকে শুরু করে হালের বিশ্ববিদ্যালয় অনুভূতি পর্যন্ত অনুভূতির নানা রঙ আমরা দেখতে পাচ্ছি হরহামেশাই। এ যেন এক অনুভূতিপ্রবণ পৃথিবীর অন্তবিহীন যাত্রা।

আর এই অতি অনুভূতিশীলতার রূপই দেখা গেল রোববার (৩০ অক্টোবর) ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ঘটনার সূত্রপাত রসরাজ দাস নামের একছেলের ফেসবুকে একটি ধর্মীয় অবমাননাকর ছবি পোস্ট করার মধ্য দিয়ে। যদিও রসরাজ ছেলেটি পরে পোস্ট দিয়ে ক্ষমা চেয়ে বলে যে , তার একাউন্ট হ্যাকিং করে অন্য কেউ এটা করেছে। তথাপি ছেলেটির বিরুদ্ধে মামলা রুজু হয় এবং তাকে পুলিশ গ্রেফতারও করে। বর্তমানে সে জেলহাজতে আছে। বিচারে সে প্রকৃতই দোষী কি নির্দোষ তা সম্মানিত আদালতই চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ করবে।

কিন্তু ওই যে বললাম অনুভূতি, সে অনুভূতির জোশে থাকতে না পেরে গতকাল সমাবেশের ডাক দেন আহলে সুন্নত এর অনুসারীরা। যাদের সমাবেশ থেকে রীতিমতো তৈমুর লঙের কায়দায় ঝাঁপিয়ে পড়া হয় সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে। ভেঙে-চুরে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হয় তিন শতাধিক বাড়িঘর আর ১৫ টি মন্দির। সেই সাথে চলে মধ্যযুগীয় কায়দায় লুটপাট আর 'গণিমতের মালের' ভাগ বাটোয়ারা। সারা দেশের শান্তিপ্রিয় বিবেকবান মানুষ বোবা বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখলো আধুনিক সভ্যতার দেশে মধ্যযুগের পুনরাগমন।

এই হামলাটির ক্ষেত্রে একটি প্রধান ব্যাপার লক্ষণীয়। হামলাটিতে অংশ নিয়েছিল যে মাদ্রাসা ছাত্ররা, সেই আহলে সুন্নতের অনুসারীরা মূলত জামায়াত শিবির বিরোধী হিসেবেই পরিচিত। আর সেই কারণে "শত্রুর শত্রু বন্ধু" বিবেচনায় তারা প্রগতিশীল স্যাকুলার শক্তির ও ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত সর্ব মহলে। কিন্তু তারাই যখন জামায়াত শিবিরের চেয়েও ভয়াবহ হিংস্রতার পরিচয় দেয়, তখন আসলেই বিস্মিত হতে হয় বইকি। আর সম্ভবত সেই কারণেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে এই তাণ্ডবলীলা চললেও পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্য বাহিনীগুলো দেখিয়েছেন অস্বাভাবিক নির্লিপ্ততা। গায়ে রাষ্ট্রীয় ইউনিফর্ম থাকলেও ঘুরেফিরে সেই অনুভূতির হাতেই তাই তাদের অসহায় আত্মসমর্পণ।

এইতো প্রথমবার নয়, ২০০০ সালে এনজিওদের বিরুদ্ধে অনুভূতি আহত করার অভিযোগে এই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাণ্ডব চালিয়েছিল তারা। যেরকম চালিয়েছিল কিছুদিন আগে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সঙ্গীত নিকেতন ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। আমার জানামতে দুটি ঘটনার একটিরও অদ্যাবধি কোন বিচার হয়নি। ফলে আবারো একইধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে তাদের দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি।

আমি ব্যক্তিগতভাবে বেশ কয়েকজন মাদ্রাসার ছাত্রের সাথে কথা বলেছি এর আগে। দেখেছি ব্যক্তিগতভাবে তারা যথেষ্টই শান্ত নিরীহ প্রকৃতির। কিন্তু যখন সমষ্টিগতভাবে তারা অনুভূতির জোশে রাজপথে নেমে আসেন, তখন তা চূড়ান্ত রকম ভায়োলেন্ট আকার ধারণ করে থাকে। এদের আইটি জ্ঞানের বহর অনেকটাই হতাশাব্যঞ্জক।

হেফাজতের ঢাকা মার্চ করার সময়ে তাদের "ব্লগ দিয়ে ইন্টারনেট চালানো নাস্তেক ব্লগারদের পুসি চাওয়া"র কাহিনী তো সবারই জানা। মানুষ যে কখনো চাঁদে গিয়েছিল, তা তাদের অধিকাংশই এখনো বিশ্বাস করেননা। যেমন অধিকাংশই জানেন না, পৃথিবীর সবকটি মহাদেশ বা মহাসাগরের নামও। কাজেই সুস্পষ্ট ভাবেই বোঝা যাচ্ছে হুমায়ূন আজাদ স্যারের ভাষায় এইসব "এক বইয়ের পাঠক"-দের কোন সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী পূর্ব-পরিকল্পিতভাবেই উত্তেজিত করে নামিয়ে দেয় এই প্রলয়নাচনে। আসল ঘটনার কুশীলবরা চিরকালই থেকে যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে।

এদেশে অনুভূতিতে আঘাত লাগার বিষয়টিও তাই রয়ে যায় একতরফা। সংখ্যাগরিষ্ঠদের অনুভূতি আহত হলে তাই হামলা, মামলা, ঝামেলা হলেও লঘিষ্ঠদের অনুভূতি নিহত হলেও তাই কিছুই বলার থাকেনা। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা একদিন এভাবেই পাকিস্তান আর আফগানিস্তানের জন্ম দিয়েছিল ধীরে ধীরে। লাল সবুজের বাংলাদেশে তারই প্রতিধ্বনি শোনা যায় যেন প্রতিনিয়ত।

শুধু আক্রান্তদের সমব্যথী হওয়া সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্যে উদার অংশটি আমার প্রিয় কবি কাজী নজরুলের ভাষায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ওঠেন-

"ভিন্নধর্মীর পূজা মন্দির, ভাঙতে আদেশ দাওনি হে বীর,
আমরা আজিকে সহ্য করিতে পারিনাকো পরমত।
ক্ষমা করো হযরত"

  • রাজেশ পাল : আইনজীবী, অনলাইন এক্টিভিস্ট।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত