শাহ নূর জালাল

১১ ডিসেম্বর, ২০১৭ ১৩:৩৬

শাহ আবদুল করিম বিষয়ে ভুলভাবে লেখালেখি হয়

বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমকে নিয়ে এখন পত্রপত্রিকা এবং ফেসবুকে অনেক লেখালেখি হয়। কিন্তু, অনেকেই না জেনে না শুনেই অনেক কিছু ভুলভাবে লিখে থাকেন। যেমন, আমার মায়ের নাম নিয়েও ভুল লেখালেখি হচ্ছে। বর্তমানে অনেকেই লিখে থাকেন যে আমার মায়ের নাম 'আফতাবুন্নেছা'। কিন্তু, তা সঠিক নয়।

আমার মার তিন বোন ছিল; আতরজান বিবি, মমজান বিবি, সরজান বিবি। আমার মা ছিলেন মধ্যম। আমার মায়ের নাম হল মমজান বিবি এবং ডাক নাম ছিল 'বৈশাখী'। হয়তো বৈশাখ মাসে জন্ম নিয়ে ছিলেন বলেই বৈশাখী নামে ডাকতেন। আমার মা অত্যন্ত সহজ সরল ছিলেন বলে বাবা (শাহ আবদুল করিম) সরলা বলে ডাকতেন। মাকে নিয়ে বাবা অনেক গানও লিখেছেন, যেমন-

"সরল তুমি শান্ত তুমি নূরের পুতুলা,
সরল জানিয়া নাম রাখি সরলা"।।

"সরলা গো কার লাগিয়া কী করিলাম,
আপনার ধন পরকে দিয়া
ধনের কাঙাল সাজিলাম"।।

আরেকটি বিষয় মনে পড়ে গেল যে,--
'কেন পিরিতি বাড়াইলায়রে বন্ধু, ছেড়ে যাইবায় যদি' অনেকে বলে থাকেন গানটি আমার মায়ের মৃত্যুর পর বাবা মায়ের উদ্দেশে এই গানটি লিখেছেন। কিন্তু, তা ঠিক নয়। এই গানটি ১৯৮১ সালে 'কালনীর ঢেউ' বইয়ে প্রকাশ হয়েছে। আর আমার মা মৃত্যুবরণ করেন ১৯৯০ সালে।

তাহলে, এই গানটি মাকে উদ্দেশ্য করে মায়ের মৃত্যুর পর কিভাবে লিখা হল?

মায়ের মৃত্যুর পর যে গানটি লিখেছিলেন সেই গানটি হল-

আর জ্বালা সয় না গো সরলা,
তুমি আমি দু'জন ছিলাম
এখন আমি একেলা।।

দুনিয়া কঠিন ঠাই
দুঃখ কইবার জায়গা নাই গো,
মনের দুঃখ কারে জানাই
বসে কাঁদি নিরালা।।

দুঃখে আমার জীবন গড়া
সইলাম দুঃখ জনম ভরা গো,
হইলাম সর্বস্বহারা
এখন যে আর নাই বেলা।।

দুঃখিত হবেন না, আমি বলতে চাই যারা লেখক, গবেষক, শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক এবং মিডিয়াকে,আপনাদের সহযোগিতায়ই শাহ আবদুল করিম আজ সারাবিশ্বে বহুল প্রচারিত। আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি। তবে, বিশেষ করে আমার এই অনুরোধ রইল যে, ভাল করে জেনেশুনে যেকোনো বিষয়টি উপস্থাপন করবেন।

জানার জন্য 'শাহ আবদুল করিম রচনা সমগ্র' বইটি পড়লেই সঠিকভাবে অনেক কিছু জানতে পারবেন। এমনকি আমি সহ বাবার অনেক ভক্তবৃন্দের মধ্যে যারা বাবার সঙ্গ করেছেন তারা অনেকেই এখনও বেঁচে আছেন। তারাও বাবার সম্পর্কে অনেকটা সঠিক তথ্য দিতে পারবেন।

দুঃখ লাগে অনেক লেখক, গবেষক রয়েছেন যারা কখনও শাহ আবদুল করিমকে নিয়ে চর্চা করেন নি, শাহ আবদুল করিমকে সঠিক ভাবে না জেনেই তারা শুধু বাণিজ্যের জন্য আমার অনুমতি না নিয়ে,আমাকে না জানিয়ে অনেক সময় দেখা যাচ্ছে বই প্রকাশ করে যাচ্ছেন। এই সমস্ত বইয়ে অনেক ভুল তথ্য উপস্থাপন হচ্ছে। যার ফলে আজ আমার মায়ের নামটিও ভুলভাবে 'আফতাবুন্নেছা' নামে প্রচারিত হচ্ছে। এমনকি কেউ কেউ আমার মাকে হিন্দু বলেও লিখেছেন। আর লিখেছেন আমার মায়ের মৃত্যুর পর, 'বাবা যে কাঠে শুইতেন সেই কাঠের নিচেই নাকি মাকে দাফন করা হয়েছে'। নিশ্চয়ই আপনারা যারা শাহ আবদুল করিম এর স্মৃতি বিজড়িত উজানধল গ্রামে এসেছেন তারা অবশ্যই দেখেছেন বাবা আদর করে বাড়ির উঠোনে মাকে সমাহিত করেছেন।

কিছু শিল্পী রয়েছেন যারা ক্যাসেট থেকে গান শুনে শুনেই শিখে গাইছেন। যাতে রয়েছে অনেক ভুলভ্রান্তি। যেমন,
"দিবানিশি ভাবি যারে
তারে যদি পাই না,
রঙ্গের দুনিয়া
তরে চাই না।।"

এটার বদলে গাইছেন----
"২৪ ঘন্টা ভাবি যারে
তারে যদি পাই না"।

অন্যজন গাইছেন---"রঙ্গের দুনিয়া তরে চায় না"

আরেকটা গানে-
"পাড়াপড়শি বাদি আমার,
বাদি কাল ননদী"।

এর পরিবর্তে গাইছেন-
"বাদি কালনী নদী"

অন্য আরেকটা গানে আছে-
"রাবেয়া সপিয়া দিলেন
দেহ প্রাণ মন,
বলকের ইব্রাহিম ছাড়ে সিংহাসন।।"

এখানে 'বলকের' পরিবর্তে 'পলকে ইব্রাহিম ছাড়ে সিংহাসন' বলে গাইছেন। এভাবে অনেকেই ভুলভাবে গাইছেন। গানের একটা শব্দ ভুলের কারণে, গানের মূল ভাবার্থ নষ্ট হয়ে যায়।

তাই, আমি মনে করি কবি নিজে যেভাবে লিখেছেন সেভাবে গাওয়ার চেষ্টা করাই উচিত।

বাংলা একাডেমি আমাদের দেশের সংস্কৃতিকে লালন করে। এদেশের সংস্কৃতি নিয়ে অনেক বই প্রকাশ করে থাকেন। সেই বইগুলোতেও যে এতো ভুল তথ্য প্রকাশ হচ্ছে। যারা দায়িত্বে রয়েছেন, তারাও ঢাকায় বসে বসেই বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেন। তারা যাদের উপর দায়িত্বভার অর্পণ করেন, তারা কতটুকু সঠিক তথ্য দিচ্ছেন, সেটা আমার মনে হয় বড়কর্তারা খতিয়ে দেখেন নি। তার প্রমাণ, ২০১৪ সালে বাংলা একাডেমি বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা সিলেট এভাবে বিভিন্ন নামে প্রকাশ হয়েছে।

এই বইগুলোতে রয়েছে অসংখ্য ভুল। এতে শাহ আবদুল করিমের লেখা অনেক গান অন্যজনের নামে ছাপা হয়েছে। যেমন-
"মাটির পিঞ্জিরায় সোনার ময়নারে, তোমারে পুষিলাম কত আদরে"

বহুল প্রচারিত এই গানটি কোথাকার 'দুদু মিয়া'র নামে ছাপা হয়েছে।

আরেকটি গান-
"তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো,
আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে"

এই গানটি দুর্বিণ শাহের নামে প্রকাশ হয়েছে।

একুশে পদক প্রাপ্ত কবি দিলওয়ার সাহেবের লেখা (তুমি রহমতের নদীয়া, দয়া কর মোরে হযরত শাহ জালাল আওলিয়া) এই গানটি দুর্বিন শাহের নামে ছাপা হয়েছে। আমার বাবা শাহ আবদুল করিমমের আরেকটি গান (প্রাণ বন্ধু আসিতে সখি গো, আর কতদিন বাকী) এই গানটির কথা লেখা হয়েছে, যে এই গানটি সিলেটের বাইরের কবি কর্তৃক রচিত।

আরেকটি গান আমাদের সিলেটের মরমী কবি আরকুম শাহের লেখা, গানটি হল-
(কৃষ্ণ আইলা রাধার কুঞ্জে,
ফুলে পাইলা ভ্রমরা
ময়ূর বেশেতে সাজইন রাধিকা।।)

এই গানটি ছাপা হয়েছে শাহ আবদুল করিমের নামে।

আরও দুঃখের বিষয় হল যে গানটি (আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম) একাদশ শ্রেণিতে কবিতা আকারে পাঠ্য করা হয়েছে। সেই গানটিও বাংলা একাডেমির বইয়ে ভুলভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। এভাবে আরও অনেক গান ভুলভাবে প্রকাশ হয়েছে।

শাহ নূর জালাল: বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের পুত্র।

[লেখাটি ফেসবুক থেকে নেওয়া]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত