আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

উগ্রবাদকে রুখতে দরকার রাজনৈতিক পদক্ষেপ

স্বকৃত নোমান  

মৌলবাদী উগ্রপন্থিরা এখন সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চায়। আলোচনার মাধ্যমে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান করতে চায়। কিন্তু না, তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা নয়, কোনো বৈঠক নয়, কোনো সমঝোতা নয়। তাদেরকে শক্তিশালী ভাবার কোনো কারণ নেই। ফেয়ার ইলেকশন হলে তারা ঠিকমতো একটা সিটও পাবে না। বিগত দিনে পায়নি। এদেশের মানুষ যে ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা করে রাখে, এটাই তার বড় প্রমাণ। এই উগ্রবাদীদের কাজ ধর্মব্যবসা। ধর্মকে তারা পণ্যে রূপান্তর করেছে। ভাস্কর্য ইস্যুতে বাংলাদেশ একটা মোড় নিচ্ছে। সাংস্কৃতিক মোড়, ঐতিহাসিক মোড়, রাজনৈতিক মোড়। এই যাত্রায় বাংলাদেশ হয় ধর্মীয় উগ্রতার কাছে আত্মসমর্পণ করবে, নয় ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-সহিষ্ণুতা-উদারবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করবে।

এখন যদি এই উগ্রবাদীদের সঙ্গে সরকার আলোচনার নামে বৈঠকে বসে, তারা আবার প্রশ্রয় পেয়ে যাবে। ভাববে, শেষ পর্যন্ত সরকারকে তো আমাদের সঙ্গে বৈঠকে বসতেই হলো। বসাবসি অনেক হয়েছে, আর নয়। ছাড় ও আপস অনেক হয়েছে, আর নয়। এবার কোণঠাসা করার পালা। লোহা এখন তপ্ত। লাল। বাড়িটা ঠিক এখুনি মারতে হবে। ঠিকমতো বাড়ি মারতে পারলে তারা বেঁকে যাবে। ইতোমধ্যেই বেঁকে গেছেও বটে। ভাস্কর্য ভাঙাকে ‘নিয়ম বহির্ভূত’ বলেছে। আরেকজন তো নিজেকে সাবেক ছাত্রলীগ কর্মী ঘোষণা করেছে। আরও বাঁকানো চাই। তাদের ইতিহাস বেঁকে যাওয়ার ইতিহাস। যুগে যুগে তারা বেঁকেছে। মানুষের অসীম ক্ষমতার কাছে, মানুষের বিকাশের কাছে, মানুষের সৃজনশক্তি ও শুভবোধের কাছে তারা বারবার হেরেছে।

তাদেরকে প্রশ্রয় দেওয়া মানে বাংলাদেশকে হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া। এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে ধর্মীয় উগ্রতার সঙ্গে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের কোনো সম্পর্ক নাই। সম্পর্ক নিশ্চয়ই আছে। এই উগ্রপন্থিদের কারণেই আফগান, পাকিস্তান, ইরাক, সিরিয়া ধ্বংস হয়েছে, হচ্ছে। এদেরকে দাবার গুঁটি হিসেবে ব্যবহার করছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। প্রাচ্যের সমস্ত ইতিহাস-ঐতিহ্যকে তারা লুপ্ত করে দিতে চাইছে। প্রাচ্যের সমস্ত অহঙ্কারকে, সমস্ত গৌরবকে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব জয়যাত্রাকে তারা থামিয়ে দিতে চাইছে। অনেক ক্ষেত্রে তারা সফল হয়েছেও বটে। কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত তারা সফল হবে না। সৌদি আরব ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। নারীমুক্তির পথে যাত্রা করছে। রক্ষণশীলতাকে পেছনে ফেলে উদারনীতি ও প্রগতির পথে হাঁটতে শুরু করেছে। একই পথে যাত্রা শুরু করেছে আরব আমিরাতও। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক মুসলিম-প্রধান দেশ উগ্রপন্থার কবল থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। উগ্রবাদীদের স্থান সেসব দেশে আর হবে না।

সেই কারণে এই উগ্রবাদীদের পরবর্তী টার্গেট বাংলাদেশ। এই দেশকে তারা রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল করতে চাইছে। অলরেডি করেছেও। এদেরকে প্রতিরোধ করা না গেলে এক কঠিন পরিস্থিতির মুখে দাঁড়াতে হবে টন-টন রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই বাংলাদেশকে। এই মুষ্টিমেয় উগ্রবাদীদেরকে প্রতিরোধ করা গেলে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য পাহারায় পুলিশের প্রয়োজন হবে না, এদেশের মানুষই পাহারা দেবে। দা-বটি-খুন্তি-কুড়াল নিয়ে পাহারা দেবে। উগ্রপন্থিদের সামাজিকভাবে রুখে দেবে। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা আর শত শত নদ-নদী বিধৌত এই দেশের সব মানুষ উগ্রপন্থি, এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। এই ভূমিতে মানবতাবাদের, উদারতার, সহিষ্ণুতার বীজ রয়েছে। সেই বীজের নাম লালন, হাছন, রাধারমণ, শাহ আবদুল করিম এবং হাজার হাজার আউল-বাউল। তাদের মতাদর্শকে উজাগর করে দিন। ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’, এই গান বাজতে শুরু করলে তারা দশ হাত গভীর গর্তে ঢুকে যাবে। প্রয়োজনে ইতিহাসের কাছে হাত পাতুন। সুলতানি ও মুঘল আমলের ধর্মীয় উদারনীতির ইতিহাস, ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক রাখার ঘুমন্ত ইতিহাসকে সামনে নিয়ে আসুন। বাংলার বারো ভুঁঞারা কীভাবে সংগীত ও নৃত্যকে, সর্বোপরি বাংলার সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন, সেই ইতিহাসকে সামনে নিয়ে আসুন। বর্তমান যদি বিঘ্নের কবলে পড়ে, তবে ইতিহাসের কাছে আশ্রয় নিতে হয়, ইতিহাসের কাছে হাত পাততে হয়।

চষা ভূমিতে এখন এসব বীজ বুনতে হবে। এই বীজমন্ত্রেও যদি কাজ না হয়, তবে সামনে নিয়ে আসুন মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমিকে। প্রেমের যে বন্যা তিনি বইয়ে দিয়েছিলেন, সেই বন্যাকে আবার আহ্বান করুন। প্রয়োজনে জেলায় জেলায় উপজেলায় উপজেলায় ‘রুমি সম্মেলন’ করুন। ‘মসনভি’-কে সামনে নিয়ে আসুন। ফেরদৌসির ‘শাহনামা’-কে সামনে নিয়ে আসুন। ইবনুল আরাবির আন্তঃধর্মীয় ঐক্যের তত্ত্ব প্রচারের ব্যবস্থা করুন। ওমর খৈয়াম ও হাফিজের সম্প্রীতি-নীতি প্রচারের ব্যবস্থা করুন। রুমি, আরাবি, জামি, মনসুর হাল্লাজ, রুশদ, হাফিজ, খৈয়াম প্রমুখগণ এই কট্টরপন্থিদের যম। সহজপন্থার বীজগুলো ঠিকঠাক বোনা গেলে অচিরেই ফলতে শুরু করবে সোনালি শষ্য। বাপ-বাপ করে পালাতে শুরু করবে উগ্রবাদের ভূত।

জঙ্গি হামলার কথা বলে চৈত্র সংক্রান্তি উৎসবকে সংকুচিত করা হয়েছে, বৈশাখি মেলাকে সংকুচিত করা হয়েছে, নবান্ন উৎসবকে সংকুচিত করা হয়েছে, সকল প্রকারের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকে সংকুচিত করা হয়েছে। এই সংকোচন নীতি সম্পূর্ণ ভুল। এই সংকোচন আর নয়। শরিয়ত বয়াতিকে মুক্তি দিন। রীতি দেওয়ানের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করুন। পালাগান, বাউল গান, কবিগানের চর্চার ক্ষেত্রকে আরও প্রসারিত হওয়ার সুযোগ করে দিন। সারা দেশে বিজ্ঞানমেলার আয়োজন করুন। মানুষের সমস্ত সম্ভাবনা ও বিকাশ-ক্ষমতার কথা জানিয়ে দিন প্রজন্মকে।

ডেঙ্গু মশার ভয়ে সন্ধ্যায় ঘরে ঢুকে মশারি টানিয়ে বসে থাকা কোনো সমাধান নয়। মশার বংশকে ধ্বংস করাই হচ্ছে সমাধান। বাঙালি সংস্কৃতির যত অনুষঙ্গ আছে, সবকটিকে উজাগর করে দিন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে আরও শক্তিশালী করুন। এই মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে দেশের সর্বত্র সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করুন। ওরা সংগীতকে ভয় পায়, নৃত্যকে ভয় পায়, বাঙালি সংস্কৃতির তাবৎ অনুষঙ্গকে ভয় পায়। এই কাজে প্রয়োজনে সমাজসেবা মন্ত্রণালয়কেও সম্পৃক্ত করুন। সবই রাজনীতির হাতে। রাজনীতিই সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। রাজনীতি যদি এখন সঠিক পদক্ষেপটি নেয়, উগ্রবাদিরা পালিয়ে যাবে। গর্তে ঢুকে যাবে। আমরা নিশ্চিত। রাজনীতি ভুল করলে এই দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিপণ্নতা যে তরান্বিত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

স্বকৃত নোমান, কথাসাহিত্যিক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ