আজ মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২৪

Advertise

কোন অতল অন্ধকারে তলিয়ে গেল বিবেক!

স্বকৃত নোমান  

যারা অধ্যাপক জাফর ইকবালকে গালি দিচ্ছেন, তাঁকে নব্য রাজাকার বলছেন, ষাঁড় বলছেন এবং আরও নানা ব্যাঙ্গ-বিদ্রূপ করছেন, তারা কি তাঁর পুরো লেখাটি পড়েছেন? না, পড়েননি। নিশ্চিতভাবেই পড়েননি। তাঁর অবস্থান কোটা পদ্ধতির পক্ষে, না বিপক্ষে―তাও তারা ঠিকমতো জানেন না। তাঁর অবস্থান যে স্পষ্টতই কোটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে, তা জানা যাবে ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনের সময় তাঁর লেখা এবং সাক্ষাৎকারগুলো পড়লে। অনলাইনে রয়েছে। সার্চ দিয়ে দেখতে পারেন। আজকের অসমাপ্ত লেখাটিতেও তিনি কোটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান ব্যক্ত করেছেন।

তিনি আমাদের মতো ফেসবুক দেখেন না, সারাক্ষণ অনলাইনে পড়ে থাকেন না। কোনো একটা ভিডিওতে দেখেছেন যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কোটা আন্দোলনকারীরা’ স্লোগান দিচ্ছে : ‘তুমি কে আমি কে/রাজাকার রাজাকার।’ সেদিন রাতে জসীমউদ্দীন হলের আশপাশে এই স্লোগান যে দেওয়া হয়েছিল, তা তো সত্যি। যে বা যারাই দিক। কারা দিয়েছিল জানা নেই। তবে নানা ভিডিও ফুটেজ প্রমাণ করছে যে, কোটাবিরোধী প্রকৃত আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের স্লোগান ছিল এমন : ‘তুমি কে আমি কে/রাজাকার রাজাকার/কে বলেছে কে বলেছে/স্বৈরাচার স্বৈরাচার।’

জাফর ইকবাল নিশ্চয়ই একটি ভিডিওর স্লোগানটাই শুনেছেন, যেখানে স্লোগান দেওয়া হচ্ছিল, ‘তুমি কে আমি কে/ রাজাকার রাজাকার।’ মুক্তিযুদ্ধকালে একজন শহিদের সন্তান হিসেবে বর্তমান প্রজন্মের কারো মুখে এই স্লোগান শুনলে তাঁর মর্মাহত হওয়ার কথা। তিনি তা-ই হয়েছেন এবং নিজের মতামত ব্যক্ত করেছেন। লিখেছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমার বিশ্ববিদ্যালয়, আমার প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়। তবে আমি মনে হয় আর কোনোদিন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে চাইবো না। ছাত্র-ছাত্রীদের দেখলেই মনে হবে, এরাই হয়তো সেই রাজাকার। আর যে কয়দিন বেঁচে আছি, আমি কোনো রাজাকারের মুখ দেখতে চাই না। একটাই তো জীবন। সেই জীবনে আবার কেন নতুন করে রাজাকারদের দেখতে হবে?’

কেউ কেউ বলছেন, জাফর ইকবাল আন্দোলনরত ছাত্রদের স্যাটায়ার বুঝতে পারেননি, স্যাটায়ার ধরতে পারেননি। যারা এটা বলছেন তাদের উদ্দেশে বলি, নিজেকে রাজাকার দাবি করা কোনো স্যাটায়ার হতে পারে না, নিজেকে খুনি দাবি করা কোনো স্যাটায়ার হতে পারে না, নিজেকে গণহত্যাকারী দাবি করা কোনো স্যাটায়ার হতে পারে না। রাগ-ক্ষোভ কিংবা মান-অভিমান প্রকাশের আরও ভাষা আছে, অনেক শব্দ আছে। সেই ভাষা প্রয়োগ করা যেতে পারে। লাখো শহিদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এই দেশে কোনো অবস্থাতেই কেউ নিজেকে রাজাকার, আলবদর বা আল-শামস দাবি করতে পারে না। করলে তা হবে মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান, লাখো শহিদের অপমান।

কোটা পদ্ধতি নিয়ে জাফর ইকবালের বক্তব্য কী? তার বক্তব্য খুবই স্পষ্ট। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, “বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়, স্বচ্ছ নয়। পৃথিবীর অনেক দেশেই কোটা রয়েছে। কিন্তু সেটা যুক্তিপূর্ণ ও সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। আমি কোনোভাবেই কোটার পক্ষে না। যতটুকু শুনলাম মেধাবীর চেয়ে কোটার সংখ্যা বেশি। এটা কেমন কথা! এটা মোটেই যুক্তিপূর্ণ না, কোনোভাবেই না। এছাড়া কোটা প্রথার সুযোগে মুক্তিযুদ্ধকে অসম্মান করার একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমি কোনোভাবেই কোটার পক্ষে না। একটা কোটা একবার ব্যবহার করা যায়। চার/পাঁচবার ব্যবহার কোনোভাবেই ফেয়ার না। এটার অবসান হওয়া দরকার।”

আমরা বিচার-বিবেচনা করি না। কোনো কথার আগ-পিছ দেখি না। কোনো কথার পরিপ্রেক্ষিত বোঝার চেষ্টা করি না। জাফর ইকবাল কোন পরিপ্রেক্ষিতে লেখাটি লিখেছেন, তার গভীরে আমরা যাইনি। না গিয়ে তাঁকে আমরা অপমান করছি, অশ্রদ্ধা করছি, গালাগালি করছি; তাঁকে নব্য রাজাকার বানিয়ে দিয়েছি, গণশত্রু বানিয়ে দিয়েছি। চিরকাল ধর্মান্ধ, প্রতিক্রিয়াশীল এবং যুদ্ধাপরাধীরা তাঁকে ‘ষাঁড়’ ডেকে বিদ্রূপ করেছে, আজ তথাকথিত প্রগতিশীলরাও তাঁকে ‘ষাঁড়’ ডাকছে। কালের কী নির্মম পরিহাস! হায় আমাদের বিবেক! কোন অতল অন্ধকারে তলিয়ে গেল আমাদের বিবেক!

কোটা পদ্ধতি প্রশ্নে ব্যক্তিগতভাবে আমি আমার অবস্থান সংক্ষেপে শুধু এটুকু বলি, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ত্রিশ পার্সেন্ট রাখাটা স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য বেমানান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা কেবল তাঁদের স্ত্রী-সন্তান তথা পরিবারের জন্য যুদ্ধ করেননি। যুদ্ধ করেছেন এই দেশের সমস্ত মানুষের মুক্তির জন্য, একটি বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনের জন্য। মুক্তিযোদ্ধারা জীবন দিয়েছেন এই দেশের সমস্ত মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের জন্য।

সুতরাং যৌক্তিকভাবেই তাঁদের মহান অবদানের সুফলভোগী কেবল তাঁদের পরিবার নয়, এই দেশের সমস্ত জনগণ। এই দেশের সমস্ত জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদেরই পরিবার, মুক্তিযোদ্ধাদেরই স্বজন-পরিজন; কেবল তারা ছাড়া, যারা স্বাধীনতাবিরোধী এবং তাদের উত্তরাধিকারী ও অনুসারী, যারা এখনো মুক্তিযুদ্ধে তাদের এবং তাদের পূর্বজদের অপকর্মের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেনি।

কোটা ইস্যুতে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বর্তমান প্রজন্মের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো। আজ ছয়জনের প্রাণহানি ঘটে গেল। এই প্রাণহানি নির্মম, বেদনাদায়ক। এবং কেবল একপক্ষের নয়, সংঘাতে লিপ্ত উভয়পক্ষের লোকজন আহত হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোনো দরকার ছিল না এই ইস্যুটাকে সংঘাত এবং প্রাণহানির পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার।

মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের স্বার্থে, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানের স্বার্থে এবং বৈষম্যহীন রাষ্ট্রের স্বার্থে কোটা পদ্ধতির যৌক্তিক সংস্কার আশু আবশ্যক। নইলে একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হবে। মুক্তিযুদ্ধকে তারা অর্থহীন মনে করবে। তাদের মধ্যে তৈরি হবে মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকে অস্বীকার করার মনোভাব। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়, কাম্য হতে পারে না।

স্বকৃত নোমান, কথাসাহিত্যিক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অধ্যাপক ডা. শেখ মো. নাজমুল হাসান ২৭ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৮ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৪ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৪ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০৯ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪২ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩২ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪৩ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯৩ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ২১ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ শাখাওয়াত লিটন শাবলু শাহাবউদ্দিন