প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
জাহিদ নেওয়াজ খান | ২১ মে, ২০১৬
ছোটবেলায় চিলে কান নিয়ে যাওয়ার গল্প কম শুনিনি। অমুক তমুক জায়গায় তমুক অমুকের কান নিয়ে যাওয়ার সেইসব গল্প শুনে ভয়ে ভিরমি খেতাম। জনশূন্য জায়গা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তাই হাত দিয়ে ঢেকে রাখতাম কান। কানকাটা মানুষও দেখেছি কমপক্ষে দুইজন। এদের একজন টেলিভিশন নাটকের চরিত্র ‘কানকাটা রমজান’। আরেকজন বাস্তবে, তবে বাস্তব কারণে তার নাম বলা যাচ্ছে না।
সেটা ১৯৯৬ সাল। যারা সেই ঘটনা দেখেছেন তারাতো দেখেছেনই। কিন্তু এখন যারা একেবারেই তরুণ, বয়স উনিশ কিংবা বিশ, তারা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন থেকে মোটামুটি একটা ধারণা পেতে পারেন। ওই বছর ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহীন একটা নির্বাচন হয়েছিল। তখন সরকারে থাকা বিএনপি ছাড়া বড় দলগুলো অংশ না নিলেও সুযোগসন্ধানী সাইনবোর্ড-সর্বস্ব দলগুলো ওই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। তার একটি বঙ্গবন্ধুর খুনি কর্নেল রশিদের ফ্রিডম পার্টি। আরেকটি বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর নিরাপত্তা উপদেষ্টা হওয়া, কিন্তু পরে আবার আওয়ামী লীগের টিকেটেই প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়া জেনারেল (প্রয়াত) এমএজি ওসমানীর হরিণ মার্কার দল।
নির্বাচন তখন শেষ হয়েছে। আমরা যে রিপোর্টাররা নির্বাচন কমিশন কাভার করি তারা সার্কাস পার্টি কাভারেজের মতো সকাল-বিকাল নির্বাচন কমিশনে যাই। প্রয়াত ওসমানীর উত্তরসূরি হিসেবে হরিণ মার্কা দলের প্রধান একদিন নির্বচন কমিশনে এসে নিজের কান দেখিয়ে সাংবাদিকদের বললেন, কান কিন্তু কাটা যায়নি। আমাদের কেউ কেউ টিপেটুপে পরীক্ষা করলেন, আসলেই কান কাটা যায়নি তার, শুধু কানে একটু কাটা দাগ আছে। সুতরাং, এবার তিনি যৌক্তিকভাবেই দাবি করতে পারলেন, নির্বাচনের দিন তার কান কেটে দেওয়া হয়েছে বলে যে খবর প্রকাশ হয়েছে তা ভুল। আমরা শুধু একমতই হলাম না, কেউ কেউ তাকে আশ্বস্ত করে বললেন, খবরের ভুল ঠিক করে আবার খবর করা হবে: কান কাটা যায়নি, কানে শুধু কাটা দাগ। আহ্লাদিত তিনি বিগলিত হয়ে দাঁত কেলিয়ে বিদায় হলেন।
সেই কানকাটা নেতা আরো অনেক বছর রাজনীতিতে (নামকাওয়াস্তে যদিও) ছিলেন। তবে তার বিদায়ে বাংলাদেশ থেকে যে কানকাটা রাজনীতিকরা বিদায় হননি তার প্রমাণ নিত্যদিন পাই। সবচেয়ে বড় প্রমাণতো এইচ এম এরশাদ নিজে। তার সঙ্গে তারাও যারা কানেকানে অথবা মুখেমুখে তাকে আদর-সোহাগে ভরিয়ে তুলে এক ধরনের গড়গড়ে অনুভূতি দেন। তবে এরা বুঝেন না যে, এদের কেউ কেউ যখন অন্যকে কান ধরে উঠবস করান তখন আসলে নিজেই কানমলা খান।
সেই কানমলাটা অবশ্য তাদের অনুভূতিতে আসে না। যেদিন আসবে সেদিন দাদাভাইয়ের লেখা ওই কবিতাটার কথা মনে পড়বে। নিশ্চয়ই ‘গাধার কান’ নামে রোকনুজ্জামান খানের কবিতাটা আমাদের পড়া আছে। ভুলে গিয়ে থাকলে কিংবা পড়া না থাকলে আরেকবার পড়ে নিতে পারি: ‘একটা দড়ির দুদিক থেকে টানছে দু’দল ছেলে/ তাই না দেখে বনের বানর লাফায় খেলা ফেলে। সকল বানর ফন্দি আঁটে জবর মজার খেলা/ এমন খেলা খেলেই সবাই কাটিয়ে দেব বেলা। কিন্তু দড়ি মিলবে কোথায়? ঘাবড়ে গেল মাথা/ পালের সেরা বানর বলে মগজ তোদের যা-তা। নেইকো দড়ি বয়েই গেল ভাবিস মিছে হাবা/ লেজে লেজে ধরব টেনে হবে দড়ির বাবা। যেইনা বলা দু’দল বানর দু'দিক থেকে বসে/ একের লেজটি ধরল টেনে জোরসে চেপে কষে। বনের গাধা দাঁড়ায় মাঝে উঁচিয়ে দু’টি কান/ বলে, আমার দুদিক থেকে কান ধরে দে টান। কান ধরে এই মাথা নিবি আপন দলে টেনে/ জিতবি তবে এই খেলাতে, রাখিস সবাই জেনে।
অমনি দুদল হেঁইয়ো টানে- গাধার বিপদ ভারি/ কান ছিঁড়ে সব হুমড়ি খেয়ে পড়ল সারি সারি। সাঙ্গ হল দড়ির খেলা বানররা সব হাসে/ কান হারিয়ে গাধা শুধুই চোখের জলে ভাসে।’
তবে ওই রাজনীতিকদের চোখের জলে ভাসানোটা খুব সহজ কম্মো নয়। কেন নয় সেটা আবার শামসুর রাহমান বলেছেন তার ‘পণ্ডশ্রম’ কবিতায়। এটাও যদি ভুলে গিয়ে থাকি অথবা পড়া না থাকে তাহলে চোখ বুলিয়ে নেই: ‘এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ! কান নিয়েছে চিলে/ চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে। কানের খোঁজে ছুটছি মাঠে, কাটছি সাঁতার বিলে/ আকাশ থেকে চিলটাকে আজ ফেলব পেড়ে ঢিলে। দিন-দুপুরে জ্যান্ত আহা, কানটা গেল উড়ে/ কান না পেলে চার দেয়ালে মরব মাথা খুঁড়ে। কান গেলে আর মুখের পাড়ায় থাকল কি-হে বল/ কানের শোকে আজকে সবাই মিটিং করি চল। যাচ্ছে, গেল সবই গেল, জাত মেরেছে চিলে/ পাঁজি চিলের ভূত ছাড়াব লাথি-জুতো কিলে। সুধী সমাজ! শুনুন বলি, এই রেখেছি বাজি/ যে-জন সাধের কান নিয়েছে জান নেব তার আজই। মিটিং হল ফিটিং হল, কান মেলে না তবু/ ডানে-বাঁয়ে ছুটে বেড়াই মেলান যদি প্রভু! ছুটতে দেখে ছোট ছেলে বলল, কেন মিছে/ কানের খোঁজে মরছ ঘুরে সোনার চিলের পিছে? নেইকো খালে, নেইকো বিলে, নেইকো মাঠে গাছে/ কান যেখানে ছিল আগে সেখানটাতেই আছে। ঠিক বলেছে, চিল তবে কি নয়কো কানের যম/ বৃথাই মাথার ঘাম ফেলেছি, পণ্ড হল শ্রম।’
আসল কানকাটা রাজনীতিকদের চোখের জলে ভাসানো যেন কোনভাবেই সফল না হয় সেজন্য তাদের কানকাটা ছানাপোনা কম নেই। এদের কেউ কেউ আবার আপনার সঙ্গেই হয়তো লুঙ্গি কাছা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার ভাণ করে। আসল কানকাটা রাজনীতিকদের মুখোশ উন্মোচনে ওদের ছানাপোনাদের কানটুপি আর কারো কারো লুঙ্গি উন্মোচনও তাই জরুরি।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য