আজ বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

ছোটদের জন্য লেখা

মুহম্মদ জাফর ইকবাল  

সেদিন একটি মেয়ে খুব দুঃখ করে আমাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছে। মেয়েটি লিখেছে—সে যখন ছোট ছিল তখন স্কুলে রীতিমতো কাড়াকাড়ি করে বই পড়েছে। তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দ ছিল গল্পের বই পড়া। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে লিখেছে, তার একটা ছোট ভাই ক্লাস সেভেনে পড়ে। সে মোটেও কোনো বই পড়তে চায় না। এখন পর্যন্ত কোনো গল্প বই পড়েনি, সময় কাটায় ফেসবুক করে। মেয়েটি আমার কাছে জানতে চেয়েছে কেন এমন হলো?



আমি এরকম চিঠি আজকাল মাঝে-মাঝেই পাই। শুধু যে চিঠিপত্র পাই তা নয়, নানারকম ভয়ের গল্পও শুনি। একটা ভয়ের গল্প এরকম, মা নানা কাজে খুব ব্যস্ত থাকেন, তাই ছোট শিশুটিকে সময় দিতে পারেন না। আবিষ্কার করেছেন ছোট শিশুর হাতে একটা স্মার্ট ফোন বা ট্যাবলেট ধরিয়ে দিলে সেটা নিয়ে সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যস্ত থাকে। তাই শিশুটিকে ব্যস্ত রাখার জন্যে তার হাতে স্মার্ট ফোন দিয়ে রাখেন। একদিন কোনো কারণে শিশুটিকে একটু শাসন করা প্রয়োজন হল, সামনে দাঁড়িয়ে যখন তাকে একটি শক্ত গলায় কিছু বললেন তখন হঠাত্ আবিষ্কার করলেন শিশুটি তার দিকে তাকিয়ে বাতাসের মাঝে হাত বুলিয়ে তাকে সরিয়ে কিংবা অদৃশ্য করে দিতে চেষ্টা করছে।



স্মার্ট ফোন বা ট্যাবলেটের স্ক্রীনে হাত দিয়ে স্পর্শ করে ঘষে দিলেই সেটা সরে যায় কিংবা অদৃশ্য হয়ে যায়। শিশুটি মায়ের শাসনটুকু পছন্দ করছে না, তাকে সামনে থেকে সরিয়ে অদৃশ্য করার জন্যে একই কায়দায় হাত বুলিয়ে তাকে অদৃশ্য করার চেষ্টা করছে। যখন মা অদৃশ্য হয়ে গেল না কিংবা সরে গেল না, তখন শিশুটি অবাক এবং বিরক্ত হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকল। এই মা যখন তার সন্তানের এই গল্পটি আরেকজনের সাথে করছিলেন তখন তিনি ভেউ ভেউ করে কাঁদছিলেন, নিজেকে শাপ-শাপান্ত করছিলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই দেশে অনেক মা (এবং বাবা) আছেন যারা এই ধরনের ঘটনার মধ্যে সন্তানদের বুদ্ধিমত্তা এবং প্রযুক্তিতে আকর্ষণ আবিষ্কার করে আনন্দে আটখানা হয়ে যান।



আমার ধারণা, ছোট শিশুদের নিয়ে আমরা একটা কঠিন সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। শুধু আমরা নই, সারা পৃথিবীতেই মোটামুটি একই অবস্থা। তবে অনেক দেশের মানুষজনের মাত্রাজ্ঞান আছে, বাবা-মায়ের কমনসেন্স আছে। যতই দিন যাচ্ছে আমার মনে হচ্ছে আমার দেশের অভিভাবকদের অনেকেরই মাত্রাজ্ঞান বা কমনসেন্স কোনোটাই নেই। গত অল্প কয়েকদিনে আমি যে চিঠি পেয়েছি তার মাঝে একজন জানিয়েছে তার পরিচিত একটি ছেলে এইচএসসি পরীক্ষা দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রস্তুতিটি বিচিত্র, পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে পুরো পরিবার ফেসবুকে নজর রাখছে। কোনো একটা কারণে তারা নিঃসন্দেহ যে, প্রশ্ন ফাঁস হবে এবং সেটা দিয়েই চমত্কার একটা পরীক্ষা এবং অসাধারণ একটা গ্রেড পেয়ে যাবে।



দ্বিতীয় চিঠিটি লিখেছে একটি মেয়ে, সে খুব সুন্দর ছবি আঁঁকতে পারত। তার খুব সখ ছিল ছবি আঁঁকা শিখবে। মা-বাবা তাকে কোনোভাবেই ছবি আঁঁকতে দেবে না, তাই সে ছবি আঁঁকতে পারে না। তার পরিচিত কেউ কেউ ছবি আঁঁকার ক্লাস নিয়ে এখন যখন সুন্দর সুন্দর ছবি আঁঁকে তখন সে তাদের দিকে হিংসাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।



আরেকজন লিখেছে তার খুব শখ ছিল গণিত অলিম্পিয়াডে যাবে। মা-বাবার কাছে ইচ্ছেটা প্রকাশ করার সাথে সাথে তারা বকুনী দিয়ে বলেছে পাঠ্যবইয়ের গণিত করাই যথেষ্ট—গণিত অলিম্পিয়াড নিয়ে আহ্লাদ করার কোনো প্রয়োজন নেই। সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনাটি গল্প বই নিয়ে। শিশুটি বই পড়তে চায়, মা-বাবা কিছুতেই বই পড়তে দেবে না। শিশুটিকে একটি উচিতশিক্ষা দেবার জন্যে বই পুড়িয়ে ফেলেছে!



এই ঘটনাগুলো শোনার পর ঠিক করেছি এখন থেকে সুযোগ পেলেই সবাইকে বোঝাতে থাকব পৃথিবীতে একজন শিশুকে গড়ে তোলার যতগুলো উপায় আছে তার মাঝে সবচেয়ে সহজ আর সবচেয়ে চমকপ্রদ উপায় হচ্ছে বই পড়া। পৃথিবীতে বই পড়ে এখনো কেউ নষ্ট হয়নি কিন্তু বই না পড়ে, পুরোপুরি অপদার্থ হয়ে গেছে—সেরকম অসংখ্য উদাহরণ আছে।



.

বই পড়ার কারণে মানুষের জীবনে কী অসাধারণ ঘটনা ঘটতে পারে সেটা আমি আমার নিজের চোখে দেখেছি। মনোবিজ্ঞানী বা বিজ্ঞানী গবেষকরা হয়তো এটা আগে থাকতেই জানেন—আমরা জানতাম না এবং আমার স্ত্রীর কারণে এটা হঠাত্ করে আমরা আবিষ্কার করেছিলাম। বিষয়টা বোঝানোর জন্যে একেবারেই আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনা বলতে হবে—আগেই সে জন্যে সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমি আর আমার স্ত্রী দুজনেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মোটামুটি একই সময়ে পিএইচডি শেষ করেছিলাম, যখন পোস্টডক করছি তখন আমাদের প্রথমপুত্র সন্তান জন্ম নেয় এবং আমার স্ত্রী কোনো চাকরি-বাকরি না করে ঘরে বসে আমাদের ছেলেটিকে দেখে-শুনে রাখার সিদ্ধান্ত নিল।



কয়েক মাসের একটা বাচ্চাকে নানাভাবে ব্যস্ত রাখার একটি প্রক্রিয়া হিসেবে সে আমাদের ছেলেটিকে বই পড়ে শোনাতে শুরু করল। প্রথম প্রথম সে বইটিকে টেনে নিয়ে সেটাকে দিয়ে কোনো এক ধরনের খেলা আবিষ্কারের চেষ্টা করলেও আট মাস বয়স হবার পর হঠাত্ করে সে বইয়ের দিকে নজর দিতে শুরু করল। আমরা মোটামুটি বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করলাম দুরন্ত ছটফটে একটা শিশুকে খুব সহজেই বই পড়ে শুনিয়ে শান্ত করে ফেলা যায়। আমাদের ছেলের বয়স যখন আড়াই বছর তখন আমাদের মেয়ের জন্ম হয় এবং আমার স্ত্রী তার দুই ছেলেমেয়েকে দুইপাশে শুইয়ে বই পড়ে যেতে লাগল। দুইজন ছোট শিশু তাদের মায়ের দুই পাশে শুয়ে গম্ভীরভাবে বই পড়া শুনে যাচ্ছে দৃশ্যটি খুব মজার—আমি বেশ অবাক হয়ে সেটি উপভোগ করতাম।



আমার ছেলের বয়স যখন ঠিক চার বছরের কাছাকাছি তখন আমাদের একজন আমেরিকান প্রতিবেশী তার ছেলের জন্মদিনে আমাদের ছেলেকে দাওয়াত দিয়েছে। বিকেল বেলা গাড়ি করে বাসা থেকে তুলে নিয়ে কয়েক ঘণ্টা পর ভদ্রমহিলা আমাদের ছেলেকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে যাবার সময় আমার স্ত্রীকে বলল, ‘তুমি তো আমাকে কখনো বলনি যে তোমার ছেলে সবকিছু পড়তে পারে।’



আমার স্ত্রী আকাশ থেকে পড়ল, বলল, ‘না। আমার ছেলে মোটেও পড়তে পারে না। তাকে আমরা একটা অক্ষরও পড়তে শেখাই নি।’



আমেরিকান ভদ্রমহিলা বলল, ‘আমার কথা বিশ্বাস না হলে তুমি পরীক্ষা করে দেখ। জন্মদিনে আমার ছেলে অনেক গিফট পেয়েছে, গিফটগুলো জুড়ে দেবার জন্যে সাথে যে ইন্সট্রাকশান শিট ছিল তোমার ছেলে সেটা পড়ে পড়ে শুনিয়েছে অন্য সব বাচ্চা মিলে তখন সেগুলো জুড়ে দিয়েছে।’



আমেরিকান ভদ্রমহিলা চলে যাবার সাথে সাথে আমার স্ত্রী একটা সিরিয়ালের বাক্স নামিয়ে আমার ছেলের হাতে দিয়ে বলল, ‘এখানে কী আছে পড় দেখি।’



আমার ছেলে গড়গড় করে সেটা পড়ে শোনালো। আমার স্ত্রী একটা শব্দ দেখিয়ে বলল, ‘এটা বানান কর দেখি।’



আমার ছেলে ফ্যাল ফ্যাল করে আমার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইল, বানান? সেটা আবার কী? আমার স্ত্রী একটু পরেই আবিষ্কার করল সে একটা অক্ষরও চিনে না, কোনটা কোন্ অক্ষর জানে না, কিন্তু সবকিছু পড়তে পারে। আমি নিজের চোখে না দেখলে এটা বিশ্বাস করতাম না যে, একজন মানুষ কোনো অক্ষর না জেনে পুরোপুরি পড়ে ফেলতে পারে। অনেক পরে সে যখন স্কুলে গিয়েছে তখন সে এবিসিডি শিখেছে!



অনেকের ধারণা হতে পারে আমি খুব সূক্ষ্মভাবে আমার ছেলেকে অসাধারণ একজন মেধাবী শিশু হিসেবে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করছি। কারণ এটা মোটেই সেরকম কিছু নয়, এবং আমার মেয়ের বেলাতেও হুবহু সেই একই ব্যাপার ঘটেছে। এটা হওয়া সম্ভব জানার পর আমি সবাইকে এটা বলেছি এবং যারা আমাদের কথা বিশ্বাস করে তাদের ছোট শিশুদের বই পড়ে শুনিয়েছেন তাদের সবার বাচ্চা চার বছর বয়সে কিংবা তার আগেই বই পড়তে শিখে গিয়েছে। আমার কমবয়সী সহকর্মীরা যখন বিয়ে করে এবং যখন তাদের ঘর আলো করে একটা ছোট শিশুর জন্ম হয় তখন আমরা সবাই আগে এই তথ্যটি দিই: ‘একেবারে ছেলেবেলা থেকে তোমাদের বাচ্চাদের বই পড়ে শোনাও দেখবে কতো তাড়াতাড়ি তারা বই পড়তে শিখে যাবে! আমি খুব ছোট বাচ্চাদের জন্যে রং-চংয়ের ছবিসহ কয়েকটা বই লেখারও চেষ্টা করেছিলাম। কোনো সহকর্মীর সন্তান জন্ম হয়েছে খবর পেলে সেই বইগুলোর এক-দুইটিও তাদের হাতে ধরিয়ে দিই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, অবধারিতভাবে শিশুগুলোর বাবা কিংবা মা কিছুদিন পর আমার কাছে আরেক কপি বই নিতে আসেন। সবসময়েই দেখা যায় শিশুটিকে অসংখ্যবার একটা বই পড়িয়ে শোনাতে শোনাতে বইটি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। পড়তে পড়তে একটা বই ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হওয়ার মতো সুন্দর ঘটনা আর কী হতে পারে?



একটি ছোট শিশু যখন নিজে-নিজেই পড়তে শিখে যায়, তখন আরেকটি চমকপ্রদ ঘটনা ঘটে। এই শিশুটির সময় কাটানো নিয়ে কোনো সমস্যা হয় না। আমরা সবাই নিশ্চয়ই দেখেছি চার-পাঁচ বছরের একটা বাচ্চাকে নিয়ে মা-বাবাদের খুব ব্যস্ত থাকতে হয়। বাচ্চা ঘ্যান ঘ্যান করে কাঁদছে, প্রথমে আদর করে শান্ত করার চেষ্টা করছেন, তারপর যখন পরিবেশটুকু অসহ্য হয়ে গেছে তখন বাচ্চাকে বকুনী দিচ্ছেন, বাচ্চা আরো জোরে গলা ফাটিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে—এরকম দৃশ্য কে দেখেনি। কিন্তু একটা শিশু যখন পড়তে শিখে যায় তখন আর এই সমস্যা হয় না, শিশুটির হাতে একটা মোটা বই ধরিয়ে দিতে হয়। শিশুটি গভীর মনোযোগে সেই বই পড়তে থাকে। একটি ছোট শিশু গভীর মনোযোগ দিয়ে আকারে তার থেকে বড় একটা বই পড়ছে—এর চাইতে সুন্দর দৃশ্য পৃথিবীতে নেই। আমাদের সবার ঘরে ঘরে এই দৃশ্য হওয়া সম্ভব—আমি বাজি ধরে বলছি, নতুন বাবা-মায়েরা পরীক্ষা করে দেখুন! বিফলে মূল্য ফেরত!


.

আমাকে মাঝে-মাঝেই টেলিভিশনে ইন্টারভিউ দিতে হয়—বিষয়টি আমি একেবারেই উপভোগ করি না, কিন্তু আমার কিছু করার নেই। আগে শুধু ঢাকা শহরে সাংবাদিকেরা টেলিভিশন ক্যামেরা নিয়ে ঘুরোঘুরি করতেন। আজকাল ছোট-বড় সব শহরেই সব চ্যানেলে তাদের পাওয়া যায়। মাঝে-মাঝেই সাংবাদিকেরা আমাকে বলেন, ‘ছোটদের জন্যে কিছু একটা বলেন।’ আমি অবধারিতভাবে ছোটদের উদ্দেশ করে বলি, ‘তোমরা অনেক বেশি বেশি বই পড়বে এবং অনেক কম কম টেলিভিশন দেখবে।’



আমি জানি না টেলিভিশন চ্যানেলগুলো আমার এই বক্তব্য প্রচার করেন কিনা—কিন্তু কেউ যেন মনে না করে আমি কৌতুক করে বা হালকাভাবে কথাগুলো বলি। আমি যথেষ্ট গুরুত্ব নিয়েই কথাগুলো বলি। একটা বই পড়ে একজন বইয়ের কাহিনী বইয়ের চরিত্র ঘটনা সবকিছু কল্পনা করতে পারে। যার কল্পনাশক্তি যত ভালো সে তত সুন্দর করে কল্পনা করতে পারে, তত ভালোভাবে বইটা উপভোগ করতে পারে। টেলিভিশনে সবকিছু দেখিয়ে দেয়া হয়, শুধু তাই নয় দুঃখের দৃশ্য কিংবা ভয়ের দৃশ্যগুলোর সাথে সেরকম মিউজিক বাজতে থাকে, কাজেই যে টেলিভিশন দেখছে তার কল্পনা করার কিছু থাকে না! কাজেই কেউ যদি শুধু টেলিভিশন দেখে বড় হয়, তার মানসিক বিকাশের সাথে একজন বই পড়ে বড় হওয়া শিশুর খুব বড় একটা পার্থক্য থাকলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।



আমেরিকার কর্নেল ইউনিভার্সিটির একজন অধ্যাপকের একবার ধারণা হল খুব শিশু বয়সে বেশি টেলিভিশন দেখলে একজন শিশুর অটিজম শুরু হতে পারে। তিনি নানাজনকে বিষয়টা একটু গবেষণা করে দেখতে অনুরোধ করলেন, কিন্তু অধ্যাপক ভদ্রলোক মনোবিজ্ঞানী নন, ব্যবসা প্রশাসন বিভাগের। তাই কেউ তার কথার কোনো গুরুত্ব দিল না! কর্নেল ইউনিভার্সিটির সেই অধ্যাপক তখন নিজেই নিজের মতো করে একটা গবেষণা শুরু করলেন—সেটি মোটেও চিকিত্সা বিজ্ঞানের গবেষণা নয়— অর্থনীতি বা ব্যবসা প্রশাসন ধরনের গবেষণা।



তিনি চিন্তা করে বের করলেন বৃষ্টি বেশি হলে বাচ্চারা বেশি ঘরে থাকে, বাচ্চারা বেশি ঘরে থাকলে বেশি টেলিভিশন দেখে; তাই যেসব এলাকায় বেশি বৃষ্টি হয় সেখানে বাচ্চারা বেশি টেলিভিশন দেখতে বাধ্য হয়। যদি টেলিভিশন বেশি দেখার সাথে অটিজম বেশি হওয়ার একটা সম্পর্ক থাকে তাহলে যেসব এলাকায় বৃষ্টি বেশি হয় সেখানে নিশ্চয়ই বেশি বাচ্চা অটিজম আক্রান্ত হয়। কর্নেলের অধ্যাপক দেখতে পেলেন সত্যি সত্যি যেসব এলাকায় বৃষ্টি বেশি হয় সেসব এলাকায় অটিজম আক্রান্ত শিশু বেশি। তিনি এখানেই থামলেন না, গবেষণা করে দেখালেন আমেরিকায় যেসব স্টেটে কেবল টেলিভিশন দ্রুত বেড়ে উঠেছে সেসব এলাকায় অটিজমও দ্রুত বেড়ে উঠেছে। মজার ব্যাপার হল, তার গবেষণাটি বৈজ্ঞানিক মহল মোটেও গ্রহণ করল না, শুধু তাই নয় উল্টো গবেষণা করে এরকম একটা তথ্য আবিষ্কার করে সবাইকে বিভ্রান্ত করে দেয়ার জন্যে সবাই তাকে অনেক গালমন্দ করতে শুরু করল।



আমি আঠারো বছর আমেরিকা ছিলাম, আমি এর সাথে আরেকটা তথ্য যোগ করতে পারি, আমেরিকাতে টেলিভিশনের ব্যবসা এতোই শক্তিশালী সেই দেশে সত্যি সত্যি যদি গবেষণা করে দেখা যায় টেলিভিশনের সাথে অটিজমের একটা সম্পর্ক আছে, সেই তথ্যটাও কেউ কোনোদিন প্রকাশ করার সাহস পাবে না! (আমেরিকার যে কোনো মানুষ যখন খুশি দোকান থেকে একটা বন্দুক রাইফেল কিংবা রিভলবার কিনে আনতে পারবে! আমরা সবাই জানি সেই দেশে কিছু খ্যাপা মানুষ মাঝে-মাঝেই এরকম অস্ত্র কিনে এনে স্কুলের বাচ্চাদের হত্যা করে ফেলে। সেই দেশে ন্যাশনাল রাইফেল এসোসিয়েশন এতোই শক্তিশালী যে তারপরেও কেউ যদি এতো সহজে এতো মারাত্মক অস্ত্র কিনে আনতে পারার বিরুদ্ধে একটা কথা বলে তার কপালে অনেক দুঃখ আছে।) 



অটিজম এক সময়ের একটা অপরিচিত শব্দ ছিল, এখন আমাদের দেশেও মোটামুটিভাবে সবাই অটিজম কিংবা অটিস্টিক শব্দটা শুনেছে। সারা পৃথিবীতেই অটিস্টিক বাচ্চার সংখ্যা বছরে ৬ থেকে ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। পৃথিবীতে এখন শতকরা এক ভাগ মানুষ অটিস্টিক (আমেরিকাতে আরো অনেক বেশি)। কেন এতো দ্রুত এই সংখ্যাটি বেড়ে যাচ্ছে, এখনো কেউ জানে না। কোনোরকম বড় গবেষণা না করেই আমরা বলতে পারি নিশ্চয়ই এখন বাচ্চাদের যে পরিবেশে বড় করা হয় সেটি আগের থেকে ভিন্ন। সেটি কী—আমরা জানি না, কিন্তু যেটি নিশ্চিতভাবে আগের থেকে ভিন্ন সেটি হচ্ছে টেলিভিশন, ভিডিও গেম, স্মার্ট ফোনের ব্যবহার।



বৈজ্ঞানিকভাবে এটা প্রমাণিত হয়নি—কিন্তু আশংকাটা কী কেউ উড়িয়ে দিতে পারবে? কেউ কি কখনো ভিডিও গেমের কাগজটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছে? সেখানে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা থাকে ভিডিও গেম খেলার সময় কোনো কোনো শিশুর মাঝে মৃগী রোগ শুরু হতে পারে! এতো সব জানার পর ছোট একটা শিশুকে টেলিভিশন বা ভিডিও গেমের সামনে বসিয়ে দিতে কি আমাদের জান ধুকপুক ধুকপুক করবে না?



তার চাইতে কতো চমত্কার হচ্ছে একটা বই পড়ে শোনানো! একটা বাঘের গল্প পড়তে পড়তে হঠাত্ করে বাঘের গলায় হালুম করে ডেকে উঠলে একটা ছোট শিশুর মুখে যে আনন্দের ছাপ পড়ে তার সাথে তুলনা করার মতো আনন্দময় বিষয় কী আছে? একটা ভূতের গল্প পড়ে শোনানোর সময় নাকিসুরে ভূতের গলা অনুকরণ করলে একটা শিশু যেভাবে খিলখিল করে হেসে ওঠে, সেটা কি আমরা সবাই দেখিনি?



তাহলে কেন আমরা ছোট একটা শিশুকে বই পড়ে শোনাব না? কেন একজন কিশোর-কিশোরীকে বই পড়তে উত্সাহ দেব না? কেন একজন তরুণ-তরুণীকে কবিতা লিখতে দেব না?



ছোট একটি জীবন, সেই জীবনকে আনন্দময় করে তোলার এতো সহজ উপায় থাকতেও কেন জীবনকে আনন্দময় করে তুলব না?

মুহম্মদ জাফর ইকবাল, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ