সাহাদুল সুহেদ, স্পেন

০৩ জুন, ২০১৮ ১৩:০৬

স্পেনের প্রধানমন্ত্রী হওয়া সানচেজের জন্য ছিল অপ্রত্যাশিত

অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই স্প্যানিশ স্যোশালিস্ট পার্টির নেতা পেদ্রো সানচেজ স্পেনের প্রধানমন্ত্রী হলেন। শনিবার (২ জুন) স্থানীয় সময় সকাল ১১টায় জারজুয়েলা রাজপ্রাসাদে রাজা ফেলিপে ষষ্ঠ এর উপস্থিতিতে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ পাঠের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি স্পেনের ৭ম প্রধানমন্ত্রী।

স্যোশালিস্ট পার্টির পক্ষে ৩য় ব্যক্তি হিসেবে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। সৃষ্টিকর্তায় অবিশ্বাসী সানচেজ স্পেনের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাইবেল বা ক্রুশবিদ্ধ যিশু মূর্তি ছাড়াই শপথ গ্রহণ করলেন।

ভাগ্যই সুযোগ করে দিয়েছে সানচেজকে
মাদ্রিদ অটোনমাস বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ফের্ণান্দো ভাইয়েসপিন স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে সানচেজের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘ভাগ্যই তাকে (সানচেজকে) সুযোগ করে দিয়েছে।’ আসলেই কি তাই? প্রধান বিরোধী দল স্যোশালিস্ট পার্টির নেতা পেদ্রো সানচেজ ২০১৫ সালের ২০ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী হয়ে সরকার গঠনের সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু সমমনা দলগুলো তাদের সাথে কোয়াশিলনের সরকার গঠনে সম্মত না হওয়ায় ভেস্তে যায় সুযোগ। ঐ নির্বাচনে ৩৫০টি আসনের মধ্যে সানচেজের স্যোশালিস্ট পার্টি পেয়েছিল ৯০টি আসন। একক সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন কোন দল না পাওয়ায় এবং কোয়ালিশন সরকার গঠনে প্রধান দুই দলের কেউই অন্যান্য দলগুলোর সাথে সমঝোতায় না পৌঁছায় ২০১৬ সালের ২৬ জুন দ্বিতীয় দফা সাধারণ নির্বাচন হয়।

ঐ নির্বাচনে সানচেজের স্যোশালিস্ট পার্টির আসন কমে যায়। কিন্তু তখন আবারো কোন দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেতে ব্যর্থ হওয়ায় এবং কোয়ালিশন সরকার গঠনে সমঝোতায় না পৌঁছায় স্পেনের রাজার পরামর্শক্রমে পার্লামেন্টে সংসদ সদস্যদের কণ্ঠভোটের আয়োজন করা হয়। ১৭০জন কণ্ঠভোটে অংশগ্রহণ করেন। ১১১ ভোট পেয়ে দ্বিতীয়বারের মতো স্পেনের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হোন পপুলার পার্টির মারিয়ানো রাখোই। সরকার গঠনের পর থেকেই মারিয়ানো রাখোই এবং তাঁর দল পপুলার পার্টির বিরুদ্ধে দুর্নীতির নানা অভিযোগ ওঠে। কিন্তু সেগুলোর কোনোটাই তারা স্বীকার করেনি।

দুর্নীতি কেলেঙ্কারিতে রাখোইয়ের নাম সরাসরি জড়িয়ে পড়লে সানচেজ সুযোগ পেয়ে যান। ১জুন শুক্রবার পার্লামেন্টে রাখোইয়ের বিরুদ্ধে সময়মতোই বিচক্ষণতার সাথে অনাস্থা প্রস্তাব আনেন তিনি। সাথে পেয়ে যান অন্য ৬টি বিরোধীদলের সমর্থন। অনাস্থা ভোটে হেরে পদচ্যুত হোন প্রধানমন্ত্রী মারিয়ানো রাখোই। এতে প্রধানমন্ত্রী হতে আর বাঁধা থাকেনি স্যোশালিস্ট পার্টি প্রধান পেদ্রো সানচেজের। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে কোয়ালিশন সরকার গঠনে যে দলগুলোর সমর্থন আদায় করতে পারেননি তিনি, সেই দলগুলোকে সরকারী দলের দুর্নীতি প্রসঙ্গ এনে তাদের সমর্থন আদায় করা ছিল চ্যালেঞ্জিং। সেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে সফল হলেন সানচেজ। তাই প্রধানমন্ত্রী হবার পর সেই দলগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুল করেননি তিনি।

সানচেজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার
৪৬ বছর বয়সী অর্থনীতিতে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জনকারী পেদ্রো সানচেজ ২০০০ সালে রাজনীতিতে সক্রিয় হোন। সেই সময় তিনি স্যোশালিস্ট পার্টির ৩৫তম ফেডারেল কংগ্রেসের একজন প্রতিনিধি ছিলেন। সানচেজ ২০০৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত মাদ্রিদ সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর ছিলেন। সেইসময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খোসে লইস রদ্রিগেজ জাপাতেরো প্রশাসনের আইন প্রণেতা হিসেবে সংসদে প্রবেশ করেন। ২০১৩ সালে নিজ দল স্যোশালিস্ট পার্টির প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হোন। ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে তার দল দ্বিতীয় হয় এবং প্রধান বিরোধী দল হিসেবে পার্লামেন্টে কার্যত থাকে। ২০১৬ সালের দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে সানচেজের দলের আসন আরো কমায় নিজ দলে সমালোচনার মুখোমুখি হোন তিনি।

তবে পার্লামেন্টে সরকারী দলের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন ও তার পক্ষে অন্যান্য দলগুলোর সমর্থন আদায় করে প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় যে রাজনৈতিক বিচক্ষণতা দেখিয়েছেন, সমালোচকদের জবাব দেয়ার জন্য তা যথেষ্ট। নিজের দল স্যোশালিস্ট পার্টির জন্যও এটা বিরাট এক সাফল্য। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে অভিজ্ঞতা রয়েছে সানচেজের। মাতৃভাষা স্প্যানিশ ভাষার সাথে ইংরেজি ও ফ্রেঞ্চ ভাষায় পারদর্শী সানচেজ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে এডভাইজার হিসেবে কাজ করেছেন।

সরকার পরিচালনায় চ্যালেঞ্জ
১জুন শুক্রবার পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে হেরে পদচ্যুত হওয়া প্রধানমন্ত্রী মারিয়ানো রাখোই পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে সাংসদদের বলেন, ‘আমি যে অবস্থায় স্পেন পেয়েছিলাম, তার চেয়ে উত্তম একটি স্পেন রেখে যেতে পারা সম্মানের ব্যাপার।’ রাখোইর ভাষায় বর্তমানে স্পেন যদি ‘উত্তম’ হয়; সেই স্পেনকে কতটুকু অগ্রসর করতে পারেন পেদ্রো সানচেজ; সেটা দেখার বিষয়।

আগামী দুই বছর পার্লামেন্টের অবশিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের পথ যে কন্টকমুক্ত নয়; সেটা সানচেজ ভালোই অনুধাবন করছেন। বিশেষ করে ৩৫০ আসনের পার্লামেন্টে মাত্র ৮৪ আসন থাকায় যেকোনো আইন পাসের জন্য সমস্যায় পড়তে হবে সানচেজ সরকারকে। তাছাড়া ‘কাতালোনিয়া ক্রাইসিস’তো রয়েছেই।

সানচেজের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার দিন কাতালোনিয়ার আঞ্চলিক সরকার প্রধান হিসেবে কিম তররেও শপথ নিয়েছেন, যিনি কাতালোনিয়ার ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট ও স্বাধীনতাপন্থী নেতা কার্লেস পুইজদেমনের ঘনিষ্ঠজন। তবে সানচেজ কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা পক্ষের দলগুলোর সাথে সংলাপের প্রক্রিয়া শুরু করার কথাও দিয়েছেন। পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে জয়ের জন্য আগামী দুই বছর সরকার পরিচালনা করাটাও সানচেজের জন্য চ্যালেঞ্জিং।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত