নিজস্ব প্রতিবেদক

১২ জুলাই, ২০১৮ ০০:২৯

ইশতেহার বাস্তবায়নে ব্যর্থ দুই মেয়রই

সিলেট সিটি নির্বাচন

পরিবর্তনের সুর থেকে ২০১৩ সালের নির্বাচনে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মেয়র পদে বিজয়ী হওয়া আরিফুল হক চৌধুরীর অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিলো- সিলেটকে সাইবার সিটিতে পরিণত করা। নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ও জনবহুল স্থান ওয়াইফাইয়ের আওতায় নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আরিফ। তবে মেয়াদ শেষে ইশতেহারের এই আশ্বাস বাস্তবায়ন করতে পারেননি আরিফ।

আরিফের আগে দুই মেয়াদে সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলেন বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। দুইবারই নির্বাচনী ইশতাহারেই তিনি সিলেট নগরীকে জলবদ্ধামুক্ত করার আশ্বাস দিয়েছিলেন। টানা প্রায় এগারো বছর মেয়রের দায়িত্ব পালন করলেও এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে পারেননি কামরান। এখনো বৃষ্টিতে জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে নগরীর অনেক এলাকা।

সিলেট পৌনসভাকে ২০০২ সালে সিটি করপোরেশনে উন্নীত করা হয়। এরপর দুই মেয়াদে কামরান ও এক মেয়াদে আরিফ মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আগের নির্বাচনগুলোর আগে দেওয়া তাদের নির্বাচনী ইশতেহার বিশ্লেষন করে দেখা গেছে, দু’জনই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে পারেননি।

আগামী ৩০ জুলাই ৩য়বারের মতো সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে বদরউদ্দিন আহমদ কামরান ও বিএনপি থেকে আরিফুল হক চৌধুরী প্রার্থী হয়েছেন।

সিলেটের সাবেক দুই মেয়রই ইশতেহার বাস্তবায়ন করতে পারেননি উল্লেখ করে সক্ষুব্দ নাগরিক আন্দোলন সিলেটের সমন্বয়ক আব্দুল করিম কীম বলেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিশাল ইশতেহার দিলেই হয় না। ইশতেহার বাস্তবায়ন না করা জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করার শামিল।

তিনি বলেন, প্রার্থীদের ইশতেহারে এমন কিছু উল্লেখ করা উচিত নয় যা তাঁরা বাস্তবায়ন করতে পারবেন না। যা সাধ্যের মতো সেইগুলোই ইশতেহারে উল্লেখ করা উচিত।

গত নির্বাচনে ১৪ দফা নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন আরিফুল হক চৌধুরী। একই নির্বাচনে কামরান ২০ দফা ইশতেহার দেন। ওই নির্বাচনে কামরানকে হারিয়ে বিজয়ী হন আরিফুল হক চৌধুরী।

২০১৩ সালের সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) নির্বাচনে ১৮ দল সমর্থিত সম্মিলিত নাগরিক জোটের প্রার্থী ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য আরিফুল হক চৌধুরী। ওই নির্বাচনে আরিফের ১৪ দফার ইশতেহারে ছিল- সিটি করপোরেশনকে জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়া, নগরীর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন, নিজস্ব আয় বৃদ্ধি, সাইবার সিটি গড়ে তোলা, পানীয় জলের সমস্যার সমাধান, জলাবদ্ধতা দূরীকরণ, যানজট ও পরিবহন সংকট দূরীকরণ, শিক্ষা উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিচ্ছন্ন নগরী গঠন ও প্রবাসী সেবাকেন্দ্র স্থাপন।

ইশতেহারে বলা হয়, আরিফুল হক চৌধুরী মেয়র নির্বাচিত হলে সিলেট নগরীর জন্য মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করবেন। সিলেট কারাগারের জায়গায় আধুনিক সাইবার সিটি গড়ে তোলা হবে। পানীয় জলের সমস্যা সমাধানে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের সময় নেয়া উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে নগরীর প্রতিটি ঘরে সুপেয় খাবার পানি পৌঁছে দেওয়া হবে। বেসরকারি উদ্যোগে নগর বাস সার্ভিস আরও সম্প্রসারণ এবং বিআরটিসি বাস ও ট্যাক্সি ক্যাব সার্ভিস চালু করা হবে। পথচারীদের নিরাপদ পারাপারের জন্য ওভারব্রিজ ও গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হবে।
ইশতেহারে আরও বলা হয়, নগরীর শিক্ষার উন্নয়ন ও প্রসারে নগর বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ ছাড়া বিদেশের সঙ্গে লিঙ্ক প্রোগ্রামের মাধ্যমে প্রফেশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হবে। স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে স্যাটেলাইট ক্লিনিক স্থাপন করা হবে।

গত ২ জুন নতুন নির্বাচন কমিশনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগে মেয়র পদ থেকে পদত্যাগ করেন আরিফ। তবে মেয়াদ কালে পাঁচবছর আগে দেওয়া প্রতিশ্রুতির বেশিরভাগই বাস্তবায়ঢন করতে পারেননি তিনি।

সুপেয় পানি সঙ্কট, যানজট, গণপরিবহন সঙ্কট- এগুলো এখনো নগরীর প্রধান সমস্যা। জলাবদ্ধতা নিরসনে কিছু উদ্যোাগ নিলেও এখনো বর্ষায় নগরীতে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। নগর বিশ^বিদ্যালয়, ফ্লাই্ওভার, ফুটওভার ব্রিজের মতো বৃহৎ আশ^াসের কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি।

ইশতেহারের পূর্ণ বাস্তবায়ন না করতে পারা প্রসঙ্গে আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, আমি মেয়রের দায়িত্ব নেওয়ার পর একেএকে সবগুলো প্রতিশ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার কিছুদিন পরই নানা ষড়যন্ত্র আর মামলার মাধ্যমে আমার উন্নয়ন কর্মকান্ড ব্যাহত হয়। প্রায় আড়াই বছর আমাকে কারাগারে আটকে রেখে নগরবাসীকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তারপরও যেটুকু সময় পেয়েছি সেই সময়ে নগরবাসীর জন্য কাঙ্খিত উন্নয়ন করতে চেষ্টা করছি। নগরবাসী আবার আমাকে মূল্যায়ণ করলে বাকীগুলোও বাস্তবায়ন করবো।

২০০৮ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নির্বাচনে কারাগারে থেকেই বিজয়ী হয়েছিলেন বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। সে নির্বাচনে কোনো ইশতেহার দেননি তিনি। এরআগে ২০০৩ সালের  প্রথম সিটি নির্বাচনের ইশতেহারে কামরান নগরীর জলাবদ্ধতা দূরীকরণ,  নাগরিকদের সেবা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবা ও চিত্তবিনোদনের সুযোগ তৈরি, হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজারসহ নগরীর অন্যান্য মাজার উন্নয়ন, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শ্মশান সংস্কার ও উন্নয়ন, শহীদ মিনার সংস্কার ও নির্মাণ, নগরীর সড়ক নির্মাণ ও সংস্কার, ড্রেন সংস্কার, ফুটপাত নির্মাণ ও সংস্কার, হকার পুণর্বাসন, পানীয়জল সরবরাহ এবং নগরীর সৌন্দর্য বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করেন।

কামরানের দেওয়া এসব আশ্বাসের বেশিরভাগই বাস্তবায়ন হয়নি বলে মনে করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন সিলেটর সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কীম। তিনি বলেন, পানীয় জলের ব্যবস্থা, চিত্তবিনোদনের সৃযোগ তৈরি, যানজট ও জলজট নিরসনসহ বিভিন্ন আশ^াস পুরণে ব্যর্থ হয়েছেন কামরান। একইভাবে আরিফুল হকও অনেক প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেননি।

তবে এ ব্যাপারে বদরউদ্দিন আহমদ কামরান বলেন, আমি নির্বাচিত হওয়ার পর সিংহভাগ প্রতিশ্রুতিই আমি বাস্তবায়ন করতে পেরেছিলাম। যে প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করা সম্ভব হয়নি তা পূরণ করতে গত নির্বাচনের ইশতেহারে সংযুক্ত করেছিলাম। কিন্তু পরাজিত হওয়ায় তা বাস্তবায়ন করা যায়নি।

তিনি বলেন, বর্তমানে সিসিকের যে উন্নয়ন হয়েছে এর সবই আমার সময়কার পরিকল্পনার অংশ। এই পরিকল্পনার বিষয়টি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজে জানতেন। যা কিছুটা বর্তমান করপোরেশন বাস্তবায়নে কাজ করেছে। তবে সিংহভাগ উন্নয়নই আলোর মুখ দেখেনি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত