নিজস্ব প্রতিবেদক

১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:৩০

হবিগঞ্জে শিল্পবর্জ্যে বিবর্ণ সুতাং নদী, হুমকিতে কৃষিজমি

গ্যাস-বিদ্যুতের প্রাপ্যতা, সঙ্গে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের মাধবপুর থেকে হবিগঞ্জ পর্যন্ত ৫২ কিলোমিটারেই অর্ধশতাধিক শিল্প-কারখানা। অচেনা হবিগঞ্জে যেন শিল্পবিপ্লব। এসব শিল্পের মধ্যে বেশকিছু বড় গ্রুপের কারখানাও রয়েছে। অনেকে জায়গা কিনে রেখেছেন নতুন শিল্প গড়ার প্রত্যাশায়। চালু শিল্পের বিষাক্ত বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে জেলার নদী-খাল। একই দূষণে হুমকিতে পড়েছে জেলার মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া সুতাং নদীও।

মাধবপুর থেকে হবিগঞ্জ পর্যন্ত শিল্প এলাকাগুলোতে ঘুরে দেখা যায়, শিল্প-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য সরাসরি মিশছে খাল-বিল ও জলাশয়ে। খাল-জলাশয় বেয়ে একই বর্জ্য বিষিয়ে তুলছে সুতাং নদীর পানি। এর মধ্যে হবিগঞ্জের অলিপুর এলাকায় গড়ে ওঠা শিল্প-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে ব্যাপকভাবে দূষিত হয়েছে নদীটি।

শিল্পবর্জ্যের দূষণের কারণে নদী-তীরবর্তী বুল্লা, করাব, লুকড়া, নূরপুর, ব্রাহ্মণডোরা, রাজিউড়া, লাখাই সদরসহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের গ্রামে কৃষি, স্বাস্থ্য ও দৈনন্দিন জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। শিল্পবর্জ্যের উত্কট গন্ধে অতিষ্ঠ এলাকার মানুষজন। দূষণের কারণে নদী-তীরবর্তী প্রায় ৪০ কিলোমিটার এলাকার ফসলি জমি ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। এ নদীতে এক সময় প্রচুর মাছ পাওয়া গেলেও এখন তার দেখা নেই। এতে হুমকিতে পড়েছে কয়েক হাজার জেলের জীবন-জীবিকা। কৃষকরা সেচের কাজেও ব্যবহার করতে পারছেন না সুতাংয়ের পানি। গভীর নলকূপের মাধ্যমে সেচ দিতে গিয়ে তাদের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। নদীপাড়ের মানুষ এক সময় ব্যাপকহারে হাঁস পালন করলেও এখন আর পারছেন না। নদীর পানির বিষক্রিয়ায় মারা যাচ্ছে হাঁসও।

শিল্পবর্জ্যের দূষণের প্রভাবে সুতাং ছাড়াও অন্যান্য নদী ও খালের পানিও দূষিত হচ্ছে। এর মধ্যে লাখাইয়ের বেলেশ্বরী নদীতে প্রতি বছর সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পুণ্যস্নান অনুষ্ঠান হয়ে এলেও দূষণের কারণে কয়েক বছর ধরে তা বন্ধ। শিল্পবর্জ্যে নদী দূষণের প্রভাব জীবন-জীবিকার ওপর পড়ায় ক্ষুব্ধ এলাকাবাসীও।

হবিগঞ্জ সদর উপজেলার সাধুরবাজারে গিয়ে কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে। সুতাং নদীর দূষণের বিষয়ে জানতে চাইলে তারা বলেন, প্রাণ-আরএফএল ও স্কয়ার গ্রুপ অলিপুরে বিশাল এলাকাজুড়ে একাধিক শিল্প-প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে সুতাং নদীতে।

স্থানীয় বাসিন্দা মো. নুরুল ইসলাম বলেন, তিন-চার বছর ধরেই নদীর পানি স্বাভাবিক রঙ হারিয়েছে। কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যের কারণে আশপাশের ৪০-৫০টি গ্রামের মানুষ দুর্ভোগে আছে। এ পানিতে গোসল করার কারণে মানুষের বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ হচ্ছে। বিষাক্ত পানির কারণে মারা যাচ্ছে গবাদিপশুও। অনেকবার আমরা এর প্রতিবাদ জানিয়েছি। জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপিও দিয়েছি। তাতেও কাজ হচ্ছে না।

স্থানীয় যুবক ফয়সাল জানান, কৃষিকাজ, মাছ ধরা, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি লালন-পালন করে এখানকার মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। কিন্তু কারখানার বিষাক্ত শিল্পবর্জ্য শৈলজুড়া খালের মাধ্যমে সুতাং নদীর পানিকে দূষিত করছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এলাকার মানুষ। এক সময় হাঁস পালনের সঙ্গে জড়িত থাকলেও বিষাক্ত পানির কারণে অনেক হাঁস মারা যাওয়ায় তিনি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

রাজিউড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম বাবুল জানান, সুতাং নদীর বিষাক্ত পানির কারণে এলাকার মানুষ অনেক কষ্টে আছে। এজন্য একাধিকবার প্রশাসনের কাছে প্রাণ ও স্কয়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সর্বশেষ এক মাস আগে তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে চিঠি দিয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বলে জানতে পেরেছি।

প্রাণের কারখানার তরল বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে হবিগঞ্জের সুতাং নদীর পানি, স্থানীয়দের এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এ বছরের মার্চে তদন্তে যায় পরিবেশ অধিদপ্তর। সরেজমিন পরিদর্শনে অভিযোগের সত্যতাও পায় তারা। পরিদর্শনে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা দেখতে পান, নালার মাধ্যমে প্রাণের তরল বর্জ্য নদীতে ফেলা হচ্ছে। যদিও ইটিপির মাধ্যমে এসব বর্জ্য কারখানার ভেতরেই পরিশোধন করার কথা। এ সময় পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা পরীক্ষার জন্য সুতাং নদীর পানির নমুনাও সংগ্রহ করেন।

নমুনা পরীক্ষায় সুতাংয়ের পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন (ডিও) পাওয়া গেছে নির্ধারিত মাত্রার অনেক কম। সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়েছে বায়োকেমিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড (বিওডি), কেমিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড (সিওডি) ও পিএইচ।

বিষয়টি উল্লেখ করে গত ২৫ মার্চ প্রাণ গ্রুপকে কারণ দর্শানো নোটিস দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। জবাবে গত ৩ এপ্রিল প্রাণ জানায়, সুতাং নদীতে তারা নয়, আশপাশের আরো কয়েকটি কারখানা তরল বর্জ্য ফেলে। প্রাণের বর্জ্যের কারণে নদীর পানি দূষিত হয়নি।

জবাব পাওয়ার পর আবার প্রাণ কর্তৃপক্ষকে নোটিস পাঠায় পরিবেশ অধিদপ্তর। এতে পরিবেশ ছাড়পত্রের শর্ত ভঙ্গ করে তরল বর্জ্য নদীতে ফেলার ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়। এরপর প্রাণ কর্তৃপক্ষ বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে নিজেদের পানি পরীক্ষা করিয়ে সে প্রতিবেদন পরিবেশ অধিদপ্তরে জমা দেয়। সে পরীক্ষায় বর্জ্যে কোনো ক্ষতিকর উপাদান পাওয়া যায়নি বলে জানান প্রাণের নিয়োগকৃত বিশেষজ্ঞরা। সর্বশেষ গত জুলাইয়ে প্রাণ কর্তৃপক্ষকে চিঠির মাধ্যমে দ্রুত ইটিপির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর।

প্রাণের কারখানায় পরিদর্শনে যাওয়া আলতাফ হোসেন বর্তমানে পরিবেশ অধিদপ্তরের সিলেট কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের দায়িত্বে আছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রাণের তরল বর্জ্য নদীতে ফেলার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। সেই সঙ্গে পানিতে ক্ষতিকর উপাদানও পেয়েছি। তাই তাদের জবাব আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা তাদের দ্রুত ইটিপির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে ও কোনো অবস্থাতেই নদীতে বর্জ্য না ফেলার নির্দেশ দিয়েছি। তারা এটি না মানলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাছাড়া হবিগঞ্জের সব শিল্প-কারখানাকেই আমরা পূর্ণাঙ্গ ইটিপির আওতায় আনার একটি পরিকল্পনা নিয়েছি। কারখানা কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে নোটিসও দেয়া হয়েছে।

সুতাংয়ে বর্জ্য ফেলার অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি প্রাণ কর্তৃপক্ষের। প্রাণ-আরএফএলের প্রতিষ্ঠান হবিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) হাসান মো. মঞ্জুরুল হক বলেন, প্রাণের নিজস্ব ইটিপি রয়েছে, তাই পানিতে বর্জ্য ফেলার প্রশ্নই ওঠে না। কারখানা সংলগ্ন খাল দিয়ে অনেক আগে থেকেই কালো পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এ পানি প্রাণের কারখানা থেকে নির্গত নয়।

পরিবেশ অধিদপ্তরের চিঠির বিষয়ে তিনি বলেন, চিঠির জবাবে অধিদপ্তরকে আমাদের বক্তব্য জানানো হয়েছে।

পরিবেশবাদীদের মতে, মাধবপুর থেকে হবিগঞ্জ পর্যন্ত যেসব শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে, তাদের বিষাক্ত বর্জ্যে প্রতিনিয়তই দূষিত হচ্ছে এখানকার পরিবেশ-প্রতিবেশ। তা সত্ত্বেও দূষণ রোধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। দূষণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণেও প্রশাসন নির্বিকার।

যদিও দূষণ রোধে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে দাবি করেন হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক মাহমুদুল কবীর মুরাদ। তিনি বলেন, হবিগঞ্জে অপরিকল্পিতভাবে অনেক শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে। এতে পরিবেশ ও নদী দূষণ হচ্ছে। কৃষি জমিকে অকৃষি দেখিয়ে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান আগে এখানে শিল্প-কারখানা গড়ে তুললেও বর্তমানে নতুন করে আর কাউকে কৃষি জমিতে শিল্প-কারখানা স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে না। কিন্তু এরই মধ্যে যেসব শিল্প-কারখানা স্থাপন করা হয়ে গেছে, সেগুলো তো আর বন্ধ করা সম্ভব নয়। তবে এসব কারখানার বর্জ্যের কারণে যাতে পরিবেশের ক্ষতি না হয়, সেজন্য সেন্ট্রাল ইটিপি স্থাপনের বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কাছে একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি মন্ত্রিপরিষদের সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে। তাছাড়া দূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরকেও পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। কিন্তু হবিগঞ্জে পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো শাখা না থাকায় সিলেট থেকে নিয়মিতভাবে এখানকার শিল্প-কারখানাগুলো নজরদারি করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই আমরা হবিগঞ্জে পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি শাখা স্থাপনের জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছি। সুতাং নদী ছাড়াও খোয়াই, সোনাইসহ হবিগঞ্জে আরো যেসব নদী ও খাল রয়েছে, সেগুলোর দূষণ রোধ করার পাশাপাশি পুনর্খনন ও সংস্কারের জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

নদী দূষণের সঙ্গে প্রাণ-আরএফএল ও স্কয়ার গ্রুপের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, শিল্পবর্জ্য পানিতে ফেলার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো একে অপরকে দোষারোপ করে থাকে। তাই দূষণের সঙ্গে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণের জন্য বিশেষজ্ঞ জনবল প্রয়োজন, যা আমাদের নেই।

সুতাং বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। এটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে উত্পত্তি হয়ে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশে প্রবেশের পর সুতাং নদী চুনারুঘাট থেকে উপজেলা শহরের মধ্য দিয়ে উত্তর-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে হবিগঞ্জ জেলা সদরের কিছুটা দূরে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে বাঁক নিয়ে লাখাই উপজেলা সদরের মধ্য দিয়ে কালনী নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। নদীটির দৈর্ঘ্য ৮২ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৩৬ মিটার ও গভীরতা ৪ মিটার। নদীটির অববাহিকার আয়তন ৪০০ বর্গকিলোমিটার। জোয়ার-ভাটার প্রভাব থেকে মুক্ত নদীটিতে সারা বছরই পানির প্রবাহ থাকে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত