বিন্দু তালুকদার, সুনামগঞ্জ

১৩ জানুয়ারি, ২০১৯ ২০:২৫

শাল্লায় শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ

সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফেরদৌসের অনিয়ম-দুর্নীতিতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন উপজেলার শিক্ষক সমাজ। দীর্ঘদিন ধরে তাঁর অন্যায় সহ্য করার পর অবশেষে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছেন শিক্ষকরা। শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যত্র বদলিসহ তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন বিভিন্ন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সহকারি শিক্ষকগণ।

শিক্ষা কর্মকর্তার অনিয়ম-দুর্নীতির দ্রুত প্রতিকার চেয়ে রোববার (১৩ জানুয়ারি) প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহা পরিচালক ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন অর্ধ শতাধিক শিক্ষক।

অভিযোগ পাওয়ার সত্যতা স্বীকার করে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা পঞ্চানন বালা বলেন,‘ শাল্লা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফেরদৌসের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগের তদন্ত করতে দুইজন সহকারি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা দিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

শিক্ষকরা অভিযোগে উল্লেখ করেন, শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফেরদৌস গত বছরের ৮ আগস্ট উপজেলা শিক্ষা অফিসার হিসেবে শাল্লায় যোগদান করেন। যোগদানের পর থেকেই তিনি নানা অজুহাতে শিক্ষকদের হয়রানি ও উৎকোচ আদায় করছেন। নীতিমালা লঙ্ঘন করে মোট অংকের টাকা হাতিয়ে বদলি বাণিজ্য করছেন। সরকারি বিভিন্ন খাতের টাকা আত্মসাত করছেন। নিজেকে তিনি শাল্লার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী হিসেবে দাবি করেন।

শিক্ষকরা অভিযোগে আরো উল্লেখ করেন, গোবিন্দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক সুমিতা রানী দাস রায় স্বামীর ঠিকানায় অন্য উপজেলায় প্রতিস্থাপক সাপেক্ষে বদলীর চেষ্টা করলে তৎকালীন শিক্ষা অফিসার সুমিতা রানী দাস রায়কে প্রতিস্থাপক ছাড়া বদলির আদেশ দেননি। কিন্তু মোহাম্মদ ফেরদৌস শাল্লায় যোগদানের কিছু দিনের মধ্যেই ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে অজ্ঞাত রেখে মোটা অংকের উৎকোচের বিনিময়ে সুমিতা রানী দাস রায়কে বদলীর আদেশ দেন। উপজেলার আগুয়াই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারি শিক্ষক অঞ্জলী রানী দাস ২০১৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৫ এপ্রিল মাস পর্যন্ত ৫ মাস বিনা অনুমতিতে অনুপস্থিত ছিলেন। তৎকালীন উপজেলা শিক্ষা অফিসার বিদ্যালয় পরিদর্শন করে অনুপস্থিতির সত্যতা পান এবং প্রধান শিক্ষক অনুপস্থিত দেখিয়ে মাসিক বিবরণী উপজেলা শিক্ষা অফিসে জমা দেন। যার কারণে ওই শিক্ষিকার ৫ মাসের বেতন স্থগিত করা হয়েছিল। কিন্তু মোহাম্মদ ফেরদৌস গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর মোটা অংকের উৎকোচের বিনিময়ে অনুপস্থিত ৫ মাসের বেতন-ভাতার ৪২,৬৩৫ টাকা ছাড় দেন। এছাড়া তিনি ২০১৮ সালের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব গোল্ডকাপ বরাদ্দকৃত টাকা চারটি ইউনিয়নে ২৫০০ টাকা করে ১০ হাজার টাকা ও উপজেলা পর্যায়ের ১৫ হাজার টাকাসহ মোট ২৫ টাকা টাকা খেলাধুলা না করিয়ে আত্মসাত করেন। ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরের প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য মালামাল ক্রয় বাবদ ৫০ হাজার টাকা এবং আনুষাঙ্গিক খরচ বাবদ ১০ হাজারসহ মোট ৬০ হাজার টাকা প্রতিবন্ধী শিশুদের কোন কিছু না দিয়ে সম্পূর্ণ টাকা আত্মসাৎ করেন। ২০১৮ সালের বিভিন্ন বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্ন সরবরাহ দিয়ে উপজেলার মোট ১৬,২৭৭ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে ১.৭০ টাকা হারে প্রতি সেট প্রশ্নপত্র কিনে, ১ম শ্রেণি- ৪ টাকা, ২য় শ্রেণি- ৬ টাকা, ৩য় শ্রেণি- ৭ টাকা, ৪র্থ শ্রেণি- ৮ টাকা, ৫ম শ্রেণি- ১০ টাকা হারে টাকা উত্তোলন করে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে প্রশ্ন সরবরাহ দিয়ে খরচ বাদে প্রায় ৬৫ হাজার টাকা উপজেলা শিক্ষা অফিসার ও জ্যেষ্ট সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারের নামের ব্যাংক হিসাবে ব্যাংকে জমা না করে পকেটস্থ করেন। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে নতুন ৮ জন সহকারি শিক্ষক উপজেলার বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদানের ৩ মাস পেরিয়ে গেলেও বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। শিক্ষা অফিসার ৮ জন শিক্ষকের কাছে জনপ্রতি ১০ হাজার টাকা করে উৎকোচ না দেওয়াতে বেতন ছাড় দিচ্ছেন না।

অভিযোগে আরো বলা হয়, উপজেলা শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ ফেরদৌস ডেপুটেশন বাণিজ্য করেন। ২০১৯-২০২০ শিক্ষাবর্ষে ডি.পি.এডে সুনামগঞ্জ পিটিআইয়ে উপজেলার ১২জন শিক্ষকের নামে ডেপুটেশন প্রদান করা হয়। কিন্তু ডেপুটেশনের তালিকায় ১১ নম্বরে থাকা হরিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক চম্পা রানী দাসের জ্যেষ্ঠতার ক্রমিকে নম্বর ছিল ৩১ এবং ১২ নম্বরে থাকা গঙ্গানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছন্দা চৌধুরীর জ্যেষ্ঠতার ক্রমিকে নম্বর ছিল ৬৩। ওই দুইজন শিক্ষকের নিকট হতে মোটা অংকের উৎকোচ নিয়ে নীতিমালা ও জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে প্রকৃত ডেপুটেশন প্রাপ্তদের বঞ্চিত করে তাদেরকে ডেপুটেশন প্রদান করা হয়।  তিনি উপজেলা সদরে শিক্ষকদের সামনেই বলেন ,‘আমি শিক্ষা অফিসার, তার মানে আমি শাল্লার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী। আমি যা বলব বা যা করব, তাই আইন।’ শিক্ষকদের বদলীর ক্ষেত্রে নীতিমালার জ্যেষ্ঠতাকে লঙ্ঘন করে যে শিক্ষক যত বেশি টাকা বেশি দেন তাকেই অনৈতিক সুযোগ দেন। তিনি প্রকাশ্যে বলেন,‘ সদরের বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসতে হলে দেড় লাখ টাকা, সদরের আশপাশে আসতে হলে এক লাখ এবং অন্যগুলোতে ৭০ হাজার টাকা করে যে শিক্ষক দিবেন তাদেরকেই তিনি বদলির প্রস্তাব পাঠাবেন। এছাড়াও পেনশন, কন্জুমার লোন, জিপিএফ লোন নিতে গেলেও তাকে উৎকোচ দিতে হয়। উৎকোচ ছাড়া তিনি কোন কাজ করেন না।

শিক্ষকদের অভিযোগের বিষয়ে শাল্লা উপজেলা শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ ফেরদৌসের সাথে কথা বলতে তাঁর ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে পরপর বেশ কয়েকবার চেষ্টা করলেও ফোন রিসিভ করেননি তিনি। এমনকি তাঁর মোবাইল ফোনে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও সাড়া দেননি তিনি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত