ছদরুল আমিন, ছাতক

১৪ জানুয়ারি, ২০১৯ ১৯:৪১

ছাতকে ফসলি জমি নষ্ট করছে লাফার্জ সিমেন্ট কারখানা

সুনামগঞ্জের ছাতকে অবস্থিত লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট কারখানার ক্ষতিকর বর্জ্য ও ধুলোবালিতে নষ্ট হচ্ছে সেখানকার ফসলি জমি। এতে করে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে পরিবেশ। পাশাপাশি এলাকার মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা হয়ে উঠেছে অসহনীয়। কারখানা কর্তৃপক্ষ দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টি জানলেও আমলে নিচ্ছে না।

এদিকে কারখানার অন্যতম কাঁচামাল মাটি সংগ্রহের কারণে এলাকার ফসলী জমি ধ্বংস করছে লাফার্জ হোলসিম সিমেন্ট কারখানা। কারখানার মাটি সংগ্রহের ভারী যান চলাচলে রাস্তাঘাট ভেঙ্গে যাচ্ছে। ধুলো উড়ে পরিবেশ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। কারখানার ডাস্ট, ধুলো ও কনভেয়ার বেল্টের শব্দসহ বিভিন্নভাবে পরিবেশ ধ্বংসের কারণে লাফার্জ হোলসিমের  বিরুদ্ধে এলাকার মানুষের রয়েছে চাপা ক্ষোভ ও উত্তেজনা। তবে অর্থলোভী স্থানীয় প্রভাবশালী মাটি ব্যবসায়ীদের কারণে এ ব্যাপারে তারা প্রকাশ্যে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারছেনা।

২০০৬ সালে ছাতকে সুরমা নদীর উত্তরপাড়া টেংগারগাঁও ও নোয়ারাই গ্রামের মধ্যবর্তী স্থানে প্রতিষ্ঠিত লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট কারখানা নামে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করে। পরবর্তীকালে এ কারখানাটির নামকরণ করা হয় লাফার্জ হোলসিম নামে। প্রতিষ্ঠাকালে ভূমি অধিগ্রহণ করার সময় ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকদের পুর্নবাসনসহ এলাকার উন্নয়নে সামাজিক দায়বদ্ধতার নামে বহু লোভনীয় সুযোগ-সুবিধার কথা বলা হয়েছিল।
উৎপাদনের প্রায় ১২ বছর পার হলেও স্থানীয়দের দেয়া কারখানা কর্তৃপক্ষের ওয়াদা পালন করা হয়নি। এসব নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকদের বড় বেশি ক্ষোভ না থাকলেও এলাকার পরিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে ধাবিত হওয়ার কারণে কারখানার বিরুদ্ধে তাদের রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। কারখানায় অবিরাম ক্লিংকার ও সিমেন্ট উৎপাদনের সময় এবং কারগো ও ট্রাকে সিমেন্ট সরবরাহে উড়ন্ত ডাস্ট, রাসায়নিক দ্রব্য, মাটি ও বালু কণা কারখানা সংলগ্ন নোয়ারাই, টেংগারগাঁও, বাতিরকান্দি, বাশটিলা, জয়নগর, মাড়ুয়া টিলা, মফিজ নগর, পাটিভাগ, টিলাগাঁও, বারকাহন, জোড়াপানিসহ কয়েকটি গ্রামের সবুজ পরিবেশ ধ্বংস করে দিচ্ছে।

এসব গ্রামের ঘর-বাড়িও ডাস্টের কারণে ধূসর রং ধারণ করেছে। ডাস্টের কারণে দীর্ঘ কয়েক কিলোমিটার জুড়ে বাতাস ও প্রকৃতির স্বাভাবিক পরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে। শিল্প কারখানায় ডাস্ট ডিবাইডার থাকা জরুরী হলেও লাফার্জ হোলসিম চটের বস্তা ঝুলিয়ে ডাস্ট নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও তা সম্ভব হচ্ছেনা। এদিকে ভারত থেকে মাটি ও চুনা পাথর আনার শর্তে কারখানাটি প্রতিষ্ঠিত হলেও পরিবেশ ধ্বংসের কারণ দেখিয়ে ভারতের পরিবেশ অধিদপ্তর লাফার্জ হোলসিমের মাটি সংগ্রহে  স্থায়ীভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ফলে লাফার্জ হোলসিম স্থানীয়ভাবে মাটির জন্য নতুন করে ভূমি অধিগ্রহণের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়।

পরবর্তীতে স্থানীয় কৃষকদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে ফসলী জমির মাটি সংগ্রহ করে যাচ্ছে লাফার্জ হোলসিম। কারখানা কর্তৃপক্ষ দ্রুত মাটি সংগ্রহ করে কারখানার অভ্যন্তরে বিশাল মাটির পাহাড় গড়ে তোলায় সংগৃহীত পাহাড়সম মাটির অতিরিক্ত চাপে ২০১১ সালে ছাতক সিমেন্ট কারখানায় সংযোগকৃত জালালাবাদ গ্যাসের হাইপ্রেসার লাইনে বিস্ফোরণ ঘটে। এ বিস্ফোরণের বিষয় নিয়ে ছাতক সিমেন্ট কারখানা ও জালালাবাদ গ্যাস কর্তৃপক্ষ সরাসরিভাবে লাফার্জ হোলসিমকে দায়ী করলে কর্তৃপক্ষ এর ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়।

এদিকে লাফার্জ হোলসিমের মাটি সংগ্রহের কারণে এলাকার সহস্রাধিক একর ফসলী জমি ইতিমধ্যেই জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। এসব ফসলী জমি বর্তমানে ফসল উৎপাদন এমনকি মৎস্য চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। মাটি সংগ্রহের কাজ অব্যাহত থাকায় ভবিষ্যতে এলাকার আরো ফসলী জমি ও টিলা ধ্বংস হওয়ার আশংকা রয়েছে। এলাকার সচেতন লোকজন পরিবেশ ও ফসলী  জমি ধ্বংসে স্থানীয়ভাবে একাধিক প্রতিবাদ সমাবেশ করলেও কারখানা কর্তৃপক্ষ এদিকে কোন নজর দিচ্ছে না। পরিবেশ ধ্বংসের কারণে কারখানা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও রয়েছে উচ্চ আদালতে।

পরিবেশবাদী সংগঠন, উপজেলা কৃষি বিভাগ পরিবেশ ও ফসলী জমি নষ্ট করার কারণে লাফার্জ হোলসিমের বিরুদ্ধে পরিবেশ নষ্টের একাধিক রিপোর্ট প্রদান করলেও কর্তৃপক্ষ তা আমলে নিচ্ছে না। ভারতের মেঘালয়ের খাসিয়া অঞ্চল থেকে লাফার্জ কারখানার অভ্যন্তর পর্যন্ত সক্রিয় দীর্ঘ ১৭ কিলোমিটার কনভেয়ার বেল্ট’র উচ্চ শব্দের কারণে ছাতক-দোয়ারার সহস্রাধিক পরিবারের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। শব্দ নিয়ন্ত্রক ব্যবহার না করেই উচ্চ শব্দের কনভেয়ার বেল্ট ব্যবহার করে যাচ্ছে লাফার্জ হোলসিম কর্তৃপক্ষ। ফলে এসব এলাকার স্বাভাবিক মানুষের মধ্যে নানা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।

শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠার সরকারি নীতিমালা থাকলেও লাফার্জ হোলসিম কারখানা অনেক কিছুই উপেক্ষা করে মানুষ ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে যাচ্ছে। স্থানীয় টেংগারগাঁও গ্রামের আইনুল ইসলাম ও বারকাহন গ্রামের এনামুল হক তালুকদার জানিয়েছেন, বর্তমানে কারখানা থেকে নির্গত ডাস্ট এলাকাবাসীর জন্য মারাত্মক বিপদজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারখানার স্বার্থের কারণে এলাকার ফসলী জমির ক্ষতি, স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্টসহ মারাত্মক শব্দ দূষণের সৃষ্টি হচ্ছে। স্থানীয় শিশুদের মধ্যে অনেক রোগ বালাইয়েরও সৃষ্টি হয়েছে।

এসব থেকে স্থায়ীভাবে মুক্তির জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আশু-হস্তক্ষেপ কামনা করে তারা আরো জানান, আশ-পাশ এলাকার প্রতিটি ঘরে-ঘরেই লাফার্জ হোলসিমের ক্ষতির চিহ্ন রয়েছে। শব্দ দূষণ ও পরিবেশ নষ্টের বিষয়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে এলাকাবাসী এবং নাগরিক পরিবেশ ও যুব সমাজ কল্যাণ সংস্থা একাধিক অভিযোগ দিয়েছে।  গত ৭ জানুয়ারি সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক বরাবরেও এব্যাপারে অভিযোগ দেয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এসবের শুধু তদন্তই চলছে, কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছেনা।

এ ব্যাপারে লাফার্জ হোলসিমের সহকারী কমিউনিকেশন কর্মকর্তা মোহাম্মদ উল্লাহ জানান, লাফার্জ হোলসিম স্থানীদের স্বার্থরক্ষায় সবসময় কাজ করে যাচ্ছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ-আপত্তির বিষয়গুলো গুরুত্ব সহকারে কর্তৃপক্ষ দ্রুত সমাধান করবেন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত