কমলগঞ্জ প্রতিনিধি

১৩ নভেম্বর, ২০১৯ ১৬:২১

ঊষালগ্নে সাঙ্গ হলো কমলগঞ্জের মণিপুরি মহারাসলীলা

বর্ণাঢ্য আয়োজনে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা ও কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে বুধবার ঊষালগ্নে সাঙ্গ হলো মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে মণিপুরি সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলা। কার্তিকের পূর্ণিমা তিথিতে এ কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ও আদমপুরে মণিপুরি সম্প্রদায়ের এ রাসোৎসব অনুষ্ঠিত হয়।

বুধবার (১৩ নভেম্বর) ঊষা লগ্নে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি ঘটে। মণিপুরি সম্প্রদায়ের এ বৃহত্তম উৎসব উপলক্ষে উভয় স্থানে বসেছিল রকমারি আয়োজনে বিশাল মেলা। রাসোৎসবে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে অগণিত ভক্তবৃন্দসহ দেশী-বিদেশী পর্যটকের ভিড়ে মুখরিত হয়েছিল কমলগঞ্জের মণিপুরি অঞ্চলগুলো। ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয় পুলিশ সদস্যদের ।

দামোদর মাস খ্যাত কার্তিক পূর্ণিমা তিথিতে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী মণিপুরিদের প্রধান ধর্মীয় মহোৎসব শ্রীশ্রী কৃষ্ণের মহারাসলীলা অনুসরণ। কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর জোড়া মণ্ডপ প্রাঙ্গণে মণিপুরি মহারাসলীলা সেবা সংঘের উদ্যোগে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি সম্প্রদায়ের ১৭৭ তম মহারাসলীলানুসরন উৎসব উপলক্ষে গত মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮টায় অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা সভা, গুণীজন সংবর্ধনা, রাসোৎসব উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারক সংকলনের মোড়ক উন্মোচন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

মণিপুরি মহারাসলীলা সেবা সংঘের সভাপতি প্রকৌশলী যোগেশ্বর সিংহের ও সাধারণ সম্পাদক শ্যাম সিংহের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক নাজিয়া শিরীন। বিশেষ অতিথি ছিলেন মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ বিপিএম (বার), অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মল্লিকা দে, কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার আশেকুল হক, জুড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অসীম চন্দ্র বণিক, সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (শ্রীমঙ্গল সার্কেল) আশরাফুজ্জামান, কমলগঞ্জ থানার ওসি আরিফুর রহমান, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, সিলেট এর নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার দে, রাজশাহী আর্ট কলেজের প্রভাষক চিত্রশিল্পী নারগিস পারভীন সোমা, মণিপুরি সমাজকল্যাণ সমিতির সভাপতি, মুক্তিযোদ্ধা আনন্দ মোহন সিংহ।

অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সাংবাদিক প্রণীত রঞ্জন দেবনাথ, মণিপুরি ললিতকলা একাডেমির গবেষণা কর্মকর্তা প্রভাস চন্দ্র সিংহ, রাসপূর্ণিমা-২০১৯ সংকলনের সম্পাদক নির্মল এস পলাশ প্রমুখ।

অনুষ্ঠানে মণিপুরি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিসরূপ হরিমোহন সিংহ, ডা. স্বপন  কুমার সিংহ, প্রভাক কুমার সিংহ, মৃদঙ্গ বাদক রাজেন্দ্র কুমার সিংহ ও ধনেশ সিংহকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। রাত ১২টা থেকে শনিবার ভোর পর্যন্ত চলে শ্রীশ্রী কৃষ্ণের মহারাসলীলানুসরণ।

অপরদিকে রাসোৎসব ২০১৯ উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে আদমপুর মণিপুরি কালচারাল কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণে মীতৈ মণিপুরি স¤প্রদায়ের ৩৪ তম রাস উৎসব ও আদমপুর তেতইগাঁও মধুমঙ্গল শর্ম্মা মণ্ডপ প্রাঙ্গণে মণিপুরি সাংস্কৃতিক পরিষদের আয়োজনে (মীতৈ মণিপুরি সম্প্রদায়ের) ৪র্থ বারের মতো রাস উৎসব নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালিত হয়। এখানে রাত সাড়ে রাত ১১টা থেকে বুধবার ভোর পর্যন্ত চলে শ্রীশ্রী কৃষ্ণের মহারাসলীলা উৎসব। ভোরের সূর্যোদয়ের পর অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি ঘটে এই মহামিলন অনুষ্ঠানের।

ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, ১৭৭৯ সালে মনিপুরের মহারাজা ভাগ্যচন্দ্র স্বপ্ন দৃষ্ট হয়ে যে নৃত্যগীতের প্রবর্তন করেছিলেন তাহাই রাসোৎসব। ভাগ্যচন্দ্রের পরবর্তী রাজাগনের বেশরিভাগই ছিলেন নৃত্যগীতে পারদর্শী এবং তারা নিজেরাও রাসনৃত্যে অংশগ্রহণ করতেন। এর ফলে মণিপুরি স¤প্রদায়ের মধ্যে এ কৃষ্টির ধারাবাহিকতায় কোন ছেদ পড়েনি। অতীতের সেই ধারাবাহিকতার সূত্র ধরেই কোন রূপ বিকৃতি ছাড়াই কমলগঞ্জে উদযাপিত হয়ে আসছে মণিপুরি স¤প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শ্রী কৃষ্ণের মহা রাসলীলা।

তুমুল হৈ-চৈ, আনন্দ-উৎসাহ, ঢাক, ঢোল, মৃদঙ্গ, করতাল এবং শঙ্খ ধ্বনির মধ্যদিয়ে রাধা-কৃষ্ণের লীলাকে ঘিরেই এ দিনটি বছরের অন্য সব দিন থেকে ভিন্ন আমেজ নিয়ে আসে কমলগঞ্জ উপজেলাবাসীর জীবনে। রাসলীলায় মনিপুরী নৃত্য শুধু কমলগঞ্জের নয় গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের তথা সমগ্র বিশ্বের নৃত্য কলার মধ্যে একটি বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে।

১৯২৬ সালের সিলেটের মাছিমপুরে মনিপুরী মেয়েদের পরিবেষ্টিত রাস নৃত্য উপভোগ করে মুগ্ধ হয়েছিলেন বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরে কবিগুরু কমলগঞ্জের নৃত্য শিক্ষক নীলেশ্বর মুখার্জীকে শান্তি নিকেতনে নিয়ে প্রবর্তন করেছিলেন মণিপুরি নৃত্য শিক্ষা। কমলগঞ্জে প্রায় এক মাস আগ থেকেই চলছিল রাসোৎসবের প্রস্তুতি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত