রিপন দে, মৌলভীবাজার

১০ নভেম্বর, ২০১৮ ০১:২৯

‘মুজিব কোট পরে, জয় বাংলা স্লোগান দিয়েই নির্বাচন করবো’

কেন বিরোধী শিবিরে, জানালেন সুলতান মনসুর

'কী ব্রিলিয়ান্ট ছিলো মনসুর'- গত বৃহস্পতিবার সুলতান মনসুর সম্পর্কে এমন মন্তব্য করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৃহস্পতিবার ঐক্যফ্রন্ট নেতারা গণভবনে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সাথে সংলাপে। সেই দলে ছিলেন এককালের আওয়ামী লীগ নেতা মনসুরও। সেই সংলাপেই সুলতান মনসুর নিয়ে আক্ষেপ ঝরে পড়ে প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে।

১৯৭৫’র পট পরিবর্তনের পর বৈরি সময়েও ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ। বঙ্গবন্ধুর নাম মুখে নেওয়াও যখন অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতো সেই সময়ে ভিপি পদে জয়ী হয়ে ডাকসু ভবনে বঙ্গবন্ধুর ছবি টানান তিনি। এরপর ছাত্রলীগের সভাপতিও হন ১৯৬৮ সালে রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া মনসুর।

তারও আগে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে প্রতিরোধ আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলেন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর। ওই সময়ে প্রায় ৪ বছর কাটাতে হয়েছে ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়ে আত্মগোপনে।

মেধা আর প্রখর নেতৃত্বগুণের কারণে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠেছিলেন। পেয়েছিলেন দলের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব। সামাদ-সুরঞ্জিতদের পর তাকে ধরা হতো সিলেট থেকে উঠে আসা আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ জাতীয় নেতা।

তবে ১/১১ এরপর উল্টে যায় সে হিসেব নিকেশ। সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিতি পান সুলতান মনসুর। হয়ে ওঠেন শেখ হাসিনার বিরাগভাজন। সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত অনেককেই পরবর্তীতে শেখ হাসিনা কাছে টেনে নিলেও মনসুরের আর ঠাঁই হয়নি সেখানে।

ফলে রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়েন মনসুর। দীর্ঘদিন রাজনীতিতে কোণঠাসা থেকে এবার তিনি ভিড়েছেন আরেক সাবেক আওয়ামী লীগার ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে। আওয়ামী লীগের এককালের এই ডাকসাইটে নেতা এবার মাঠে নেমেছেন নিজের পুরনো দলেরই বিরুদ্ধে। নবগঠিত সরকারবিরোধী জোট ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়ে ফের আলোচনায় এসেছেন সুলতান মনসুর। বিএনপি নেতাকর্মী ঠাসা ঐক্যফ্রন্টের সমাবেশে মুজিব কোট পরে অংশ নিয়ে আর “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু” স্লোগান দিয়েও আলোচনার জন্ম দিয়েছেন সুলতান মনসুর।

মুখে বঙ্গবন্ধুর নামে স্লোগান দিয়েও বঙ্গবন্ধুর দলের বিরোধী শিবিরে সক্রিয় হওয়া প্রসঙ্গে সুলতান মনসুর বলেন, “আমি আওয়ামী লীগ ছেড়ে আসিনি বরং আওয়ামী লীগ আমাকে ছেড়েছে। আমার পদ কেড়ে নেওয়া হল, রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হল। আমার রাজনৈতিক জীবনকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। '৭৫ পরবর্তী রাজনীতিতে আমার সক্রিয় ভূমিকা , স্বৈরাচারী বিরোধী আন্দোলনে আমার অবস্থান, দলে ও তৃনমূলে জনপ্রিয়তা, আমার সাংগঠনিক দক্ষতার কারণের রাজনীতিতে এক সুদূর প্রসারী ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছি আমি।''

তিনি বলেন- ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে সিলেট বিভাগের ১৯টি আসনের মধ্যে একমাত্র মৌলভীবাজার-২ আসনের তৃণমূল নেতাকর্মীরা একক প্রার্থী হিসেবে আমার নাম প্রস্তাব করেছিল। বাকি প্রতিটি আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী একাধিক প্রার্থী ছিলেন কিন্তু রহস্যজনক কারণে আমাকে মনোনয়ন বঞ্চিত করা হয়। কেনো দেওয়া হয়নাই তা আমি জানি না। সে সময় আমি নেত্রীর সাথে দেখা করতে চাই কিন্তু প্রথম এক সপ্তাহ আমাকে দেখা করতেই দেওয়া হয়নি । ৭ দিন চেষ্টা করে নেত্রীর সাথে দেখার করার সুযোগ পাই । তখন আমি দলের নেত্রী শেখ হাসিনাকে বললাম “আপা, আমার নাম তো একা এসেছে অন্যকোন নাম আসেনাই, কেনো আমাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নাই?” তখন তিনি আমাকে বললেন “একবার এমপি না হয়ে দেখো কেমন লাগে”। আমি জানি না তিনি কেনো এমন উত্তর দিয়েছিলেন কিন্তু এমপি হওয়া তো কোন চাকরী না যে আমি চাকরী করব। রাজনীতি একটি আদর্শ, আমি বঙ্গবন্ধুকে নেতা মেনেই তার আদর্শে জনসেবার জন্য রাজনীতিতে এসেছিলাম। ১৯৬৮ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দীনের আওয়ামীলীগের রাজনীতি শুরু করি। আমাকে দল থেকে দীর্ঘ সময় দূরে রাখা হলেও চিন্তার জায়গা থেকে আমি সবসময় রাজনীতিতে ছিলাম । আমি আজন্ম সেই আদর্শে রাজনীতি করে যাব। কোন হুমকি বা কোন বাধা বিপত্তি বা কোন লোভ-লালসা আমাকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে পারবে না'।

মনসুর বলেন, ষড়যন্ত্র করে আমাকে যখন রাজনীতি থেকে দূরে রাখা হল তখন আমার সামনে দুটি পথ খোলা ছিল। একটি রাজনীতি ছেড়ে দেয়া, আর অন্যটি রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা। কিন্তু রাজনীতি না করে মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে থাকা আমার জন্য সম্ভব না হওয়ার কারণে দ্বিতীয়টিই বেছে নিয়েছি। ৭৫-এ যখন অনেকে লোভে বা কেউ ভয়ে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি থেকে দূরে সরে গেছেন আমি সুলতান সে সময় রাজপথে ছিলাম। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করেছি , প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগ দিয়েছি। সেই প্রতিবাদের কারণে দীর্ঘ কয়েক বছর পাহাড়ে কাটিয়েছি। এরপর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ সারাদেশব্যপী ছাত্রলীগকে সংঘটিত করেছি, আমার রাজনীতির জীবন কেটেছে রাজপথের উত্তাল পিচঢালা পথে, সরকার বিরোধী আন্দোলনে। মাত্র পাঁচ বছর ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত সরকারী দলে ছিলাম তখন সারা দেশ ঘুরে দলকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সাংগঠনিক ভাবে সক্রিয় করেছি। ছাত্র জীবন থেকে শুরু করা সে রাজনীতি ছেড়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই দীর্ঘ অপেক্ষার পর আমি সক্রিয় রাজনীতি শুরু করেছি ।

সুলতান মনসুর বলেন, আমার রাজনীতি ছিল আদর্শের রাজনীতি। মৃত্যুকে পরোয়া না করে স্বাধীনতাবিরোধী ও তাদের দোসরদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সারা জীবন রাজপথে লড়াই করে মুজিব আদর্শের জানান দিইয়েছি। পদ না থাকতে পারে কিন্তু আওয়ামী লীগের সুলতান মনসুর হিসেবেই আমি রাজনীতিতে সক্রিয় থাকব। আমি অন্তরে মুজিব আদর্শ, মুখে জয় বাংলা স্লোগান ও গায়ে মুজিব কোট পরেই আজীবন রাজনীতি করে যাব। রাজনীতি কোন চাকরী বা ব্যবসা নয়। রাজনীতি হচ্ছে ঈমানের অঙ্গ, জনসেবা এবং দেশের মানুষের জন্য জনকল্যাণের জন্য কাজ করে যাওয়ার আমার রাজনীতির লক্ষ্য । জনসেবা করতে হলে এমপি হলেই করতে পারব নয়তো পারব না এমন কোন কথা নেই।

তবে আগামীতে যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয় আমি মুজিব কোট গায়ে দিয়ে এবং জয় বাংলা বলেই নির্বাচন করব তখন দেখা যাবে যারা আমাকে অন্যায় ভাবে মনোনয়ন দেয়নি তারা সঠিক ছিল নাকি আমি সঠিক ছিলাম।

ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ আরও বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যার প্রতিবাদে সিলেট থেকে প্রথম সশস্ত্র প্রতিবাদ মিছিল করেছিলাম আমি। সারা দেশে কারফিউ আর সেনা তৎপরতার মুখে যখন টুঁ-শব্দটি করার উপায় ছিল না, তখন জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে কাঁপিয়েছি। সেই সময়ে দেশব্যাপী ১০৪ জন শহীদ হয়েছিলেন। আমিও মারা যেতে পারতাম, কিন্তু মৃত্যুকে পরোয়া না করে সারা দেশ ও বিশ্ববাসীকে জানান দিয়েছিলাম যে বঙ্গবন্ধুর বাংলারা সব সন্তানেরা বেঈমান হয়ে যায় নাই। সেদিন জীবন বাজি রেখে যে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়, তাতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বঙ্গবন্ধুর মান উজ্জ্বল হয়। বিশ্ববাসীর টনক নড়ে যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে দেশের ভেতরে প্রতিবাদ প্রতিরোধ হচ্ছে। সেই প্রতিরোধের কারণে শাসকদের চক্ষুশূলে পরিণত হয়ে জীবন বাঁচাতে আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে দীর্ঘ ৪টি কাটিয়েছি ভারতের মেঘালয়ের গাড় পাহাড়ের পাদদেশে ঘন বনাঞ্চল ঘেরা দুর্গম পাহাড়ি এলাকায়। সেই আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে ধারণ করেও দলে থাকতে পারিনি গভীর ষড়যন্ত্রের মুখে অথচ যারা বঙ্গবন্ধুর বিরোধী ছিল, বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা করে চামড়া খুলে নিতে ছেয়েছিল তারাও ঠিকই আছে। এই আওয়ামীলীগ সেই আওয়ামী লীগ নেই । এটা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের আওয়ামী লীগ নয়।

আসছে নির্বাচনে প্রার্থী হবেন কিনা তা নির্ভর করে নির্বাচনের পরিবেশের উপর জানিয়ে তিনি বলেন, আমি সুলতান কোন পাতানো ভোটারবিহীন প্রহসনের নির্বচনে প্রার্থী হব না সেটা নিশ্চিত। তবে স্বচ্ছ নির্বাচন হলে প্রার্থী হব। জনসেবার এবং জনকল্যাণের জন্য রাজনীতি করি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি সারাজীবন করে যাব।

তিনি জানান, গণতন্ত্র ও মুক্তি সংগ্রামের চেতনায় একটি অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষে জাতীয় ঐক্যের পতাকাতলে সমবেত হয়ে প্রতিটি বাঙালির জেগে উঠবে। জনগণের অধিকার জনগণকে ফিরিয়ে দিতে হবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত